যদি রাত পোহালে শোনা যেত …

15

ডাঃ মামুন আল মাহতাব স্বপ্নীল

ক্যালেন্ডারের বারোটি পাতা উল্টিয়ে আবারও ১৫ আগষ্ট, আবারও শোকাতুর বাংলাদেশ। আবারও হিসাব কষবে বাঙালি, আর একটু হলেই তো ইতিহাসটা অন্যরকম হতে পারত। বঙ্গবন্ধু ৩২-এ না থেকে যদি থাকতেন গণভবনে! রক্ষীবাহিনী যদি সাক্ষী গোপালের মতো দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ইতিহাসের সাক্ষী না হয়ে স্বাক্ষর রাখত ইতিহাসে, কিংবা জেনারেল সফিউল্লাহ যদি তার দায়িত্বটা একটুখানিও পালন করতেন! যদি হামলার শুরুতেই শহীদ না হতেন শেখ কামাল, কিংবা কর্নেল জামিল যদি পৌঁছে যেতেন ৩২-এ! বাস্তবে অবশ্য এসবের কিছুই হয়নি। অল্পকিছু বিপথগামী সেনা সদস্য ১৫ আগষ্টের রাতে ঠিক-ঠিকই পৌঁছে গিয়েছিল ৩২-এ। ঘটিয়েছিল বাঙালির ইতিহাসে সবচেয়ে দুর্ভাগ্যজনক হত্যাকান্ড। তাদের কপাল ভাল, সে সময়টায় বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর শীর্ষপদ দুটিতে কর্মরত ছিলেন যথাক্রমে সেনাবাহিনীর অকর্মন্যতম আর ধুরন্ধরতম কর্মকর্তা দু’জন। তারা সেদিন বিনা বাধায় যাত্রা শুরু করেছিল ইতিহাসের আঁস্তাকুড়ের দিকে আর জাতির জন্য পিছনে ছেড়ে গিয়েছিল হাজার বছরের জন্য একটি আক্ষেপ, ‘যদি রাত পোহালে শোনা যেত বঙ্গবন্ধু মরে নাই … …’।
গানটা যতবারই শুনি মনে হয় সত্যি সত্যি যদি তাই হতো, যদি রক্ষী বাহিনীর সদস্যরা আটকে দিত ৩২-এর দিকে এগুতে থাকা কর্নেল ফারুকের নিঃসঙ্গ ট্যাঙ্কটা। তাদের মেশিনগানের গুলিতে ঝাঝড়া হয়ে যেত খুনী ফারুকের শরীরটা। যদি বঙ্গবন্ধুর ফোন পেয়েই জেনারেল সফিউল্লাহ ৩২-এ পাঠিয়ে দিতেন দুই প্লাটুন কমান্ডো। শেখ কামাল হয়তো তখনো ৩২-এ নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা সেন্ট্রিদের নিয়ে কোনমতে ঠেকিয়ে রেখেছেন ঘাতক সেনাদের। তাদের সঙ্গে ৩২-এর পেছনের দেয়াল টপকে যোগ দিয়েছেন কর্ণেল জামিল। আর এরই মাঝে পৌঁছে গেছে কমান্ডোরাও। সামনে-পিছনে সাঁড়াশি আক্রমণে পর্যুদস্ত ঘাতকের দল। সূর্যের আলো ফুটতে ফুটতে পরিস্থিতি কমান্ডোদের নিয়ন্ত্রণে। রাতভর গোলাগুলির শব্দে দিশেহারা নগরবাসী ভোরবেলা বাংলাদেশ বেতারের ঘোষণায় জানতে পারলো ব্যর্থ করে দেয়া হয়েছে অভ্যুত্থান প্রচেষ্টা। হামলাকারীদের হামলায় আহত চারজন পুলিশ সদস্য সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন, তবে নিরাপদে আছেন বঙ্গবন্ধু আর তার পরিবারের সদস্যরা।
অলীক এ কল্পনা কোনদিনও বাস্তব হবার না। জুলস ভার্নের সাইন্স ফিকশনের বেশিরভাগই আজ বাস্তব। আমাদের নিজেদেরই আছে একাধিক সাবমেরিন। আর প্রতিবেশী ভারতের চন্দ্রযান ছুটছে চন্দ্র বিজয়ে। কল্পনাতেই রয়ে গেছে শুধু জুলস ভার্নের টাইমমেশিন। তা না হলে ইতিহাসের অঘটনগুলোকে শুদ্ধ করে ইতিহাসকে সঠিক ইতিহাসের পথে ঠিকই ফিরিয়ে আনা যেত। আর তা করা গেলে কি হতো ভেবে কি দেখেছেন কখনো?
ধরুন, ১৫ আগষ্ট-এর অভ্যুত্থান প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে। বয়সের কারণে দায়িত্ব থেকে অবসর নিয়েছেন বঙ্গবন্ধু। গত দশ বছর ধরেই দক্ষতার সঙ্গে দেশ পরিচালনা করছেন তারই সুযোগ্য কন্যা শেখ হাসিনা। জাতির পিতা জাতির অভিভাবক হিসেবে এখনও জাতিকে দিক-নির্দেশনা দিচ্ছেন। আগামী বছর মুজিব বর্ষকে সামনে রেখে উৎসবের উত্তেজনায় ভাসছে পুরো দেশ। মুজিব বর্ষকে স্মরণীয় করে রাখতে নানা উদ্যোগ নিয়েছেন শেখ হাসিনা সরকার। মুজিব বর্ষে উদ্বোধন হতে যাচ্ছে নিজস্ব অর্থায়নে নির্মিত টেকনাফ-সেন্টমার্টিন সাগর সেতু। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরপরই যমুনা সেতুর পরিকল্পনা করেছিলেন বঙ্গবন্ধুর সরকার। আশির দশকের মাঝামাঝি উদ্বোধন করা হয়েছে যমুনার ওপর সড়ক ও রেল সেতু। বিশ্ব ব্যাংকের অর্থায়নে নির্মিত হয়েছে যমুনা সেতু। আর বছর দশেক আগে মাওয়া আর আরিচা পয়েন্টে নির্মাণ করা হয়েছে জোড়া পদ্মা সেতু। বিদেশী অর্থায়ন এতে ছিল সামান্যই। এবারে যখন টেকনাফ-সেন্টমার্টিন সাগর সেতুর পরিকল্পনা করা হচ্ছিল তখন তাতে অর্থায়নের কথা ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র-ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন-বিশ্ব ব্যাংক-এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক-ইসলামিক ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের একটি কনসোর্টিয়ামের। কিন্তু শেষ মুহূর্তে কোন কারণ ছাড়াই বেঁকে বসেছিল ডোনাররা। কারণ, অবশ্য দেশের মানুষ ভালই জানে। এই ব্রিজটি নির্মিত হলে ‘সেন্টমার্টিন বিশেষ পর্যটন অঞ্চলে’ বিদেশী বিনিয়োগের হিড়িক পড়বে। অর্থনীতিবিদরা হিসাব কষে দেখিয়েছেন এতে দেশের জিডিপি বাড়বে ০.৫ শতাংশ। এমনিতেই গত চার বছর ধরে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি থাকছে দুই অঙ্কের ঘরে। আর এখন এই বাড়তি প্রবৃদ্ধি যোগ হলে এদেশকে দাবায় রাখে সাধ্য কার? ধারণা করা হচ্ছে ২০৩১-এর মধ্যেই উন্নত দেশে পরিণত হবে বাংলাদেশ। সে কারণেই শেষ মুহূর্তে সরে পড়া বিদেশী দাতাদের। তাতে অবশ্য পিছপা হননি শেখ হাসিনার সরকার। নিজস্ব অর্থায়নেই এগিয়ে ‘টেকনাফ-সেন্টমার্টিন বঙ্গবন্ধু সাগর সেতু’-র নির্মাণ কাজ।
শুধু কি তাই? মুজিব বর্ষে বাংলাদেশ পরিণত হতে যাচ্ছে বিদ্যুত রফতানিকারক দেশে। এ বছরই বরিশালে স্থাপিত হয়েছে দেশের অষ্টম পারমাণবিক বিদ্যুত কেন্দ্রটি। প্রথমটি স্থাপিত হয়েছিল আশির দশকের শুরুতে বঙ্গবন্ধুর আমলে। বাংলাদেশ এখন শতভাগ পারমাণবিক বিদ্যুতনির্ভর দেশ। তেল-কয়লা-গ্যাস পুড়িয়ে বিদ্যুত উৎপাদন এদেশে এখন ইতিহাসের বিষয়। সস্তা বিদ্যুত আর সস্তা শ্রমের হাতছানিতে এদেশে হুমড়ি খেয়ে পরছে বিদেশী বিনিয়োগকারীরা আর সেই সঙ্গে লাফিয়ে-লাফিয়ে বাড়ছে উন্নয়নের সূচকগুলো। একবার যদি বিদ্যুত রফতানি শুরু হয়, তাহলে এদেশ যে কোথায় গিয়ে থামবে তা এক উপরওয়ালাই জানেন। শুধু যে দেশের চেহারাই বদলে দিয়েছেন বঙ্গবন্ধু তাই নয়, একাত্তরের চেতনায়, রাষ্ট্রীয় চার মূলনীতির ভিত্তিতে বাংলাদেশকে তিনি প্রতিষ্ঠিত করেছেন একটি সত্যিকারের অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র হিসেবে। এদেশে সত্যি-সত্যিই ‘ধর্ম যার যার কিন্তু উৎসব সবার’। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি সফররত বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে তো বলেই বসেছেন, ‘ধর্মীয় সম্প্রীতি দেখতে বিশেষজ্ঞদের উচিত বাংলাদেশে যাওয়া’। এনিয়ে সম্প্রতি চ্যানেল ’৭১-এর টকশোতে তুমুল আলোচনা হলো। টকশো শেষে বেরিয়ে আসতে আসতে সেসব নিয়েই গল্প করছিলেন ‘আন্তর্জাতিক ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি’-র সভাপতি বিশিষ্ট সাংবাদিক জনাব শাহরিয়ার কবির ও ‘সম্প্রীতি বাংলাদেশে’র আহ্বায়ক নাট্য ব্যক্তিত্ব পিযূষ বন্দ্যোপাধ্যায়। ’৭১-এর যুদ্ধাপরাধীদের বিচার সুষ্ঠুভাবে শেষ করায় বঙ্গবন্ধু’র বাংলাদেশ এখন সারা পৃথিবীতে রোল মডেল। আন্তর্জাতিক ঘাতক দালার নির্মূল কমিটির ব্যানারে শাহরিয়ার কবিররা এখন কাজ করছেন বিশ্বের দেশে দেশে মানবতাবিরোধী অপরাধে দোষীদের আইনের আওতায় আনতে। সামনেই রোহিঙ্গাদের বিষয়ে কথা বলতে চীনে যাচ্ছেন তিনি। বলছিলেন বন্ধু পিযূষ বন্দ্যোপাধ্যায়কে। পিযূষ দা’র ব্যস্ততাও ইদানীং বড্ড বেশি। বাংলাদেশে আন্তঃধর্মীয় সম্প্রীতির উদাহরণ বিশ্বের দেশে-দেশে ছড়িয়ে দিতে কাজ করছেন তার সংগঠন সম্প্রীতি বিশ্ব। দৌড়াদৌড়ির শেষ নেই তারও।
আলোচনায় ছেদ টেনে যার যার বাড়ির পথ ধরেন তারা। কল্পনার জাল বিস্তারে ছেদ টানার পালা এবার আমারও। পিতা হারানোর শোকে ভারাক্রান্ত যখন হৃদয়, কি হতে পারত আর কি হলো না সেই হিসাব কষতে গিয়ে পাওয়া না পাওয়ার বিশাল ব্যবধানে বিষন্ন তখন মন। তারপর একসময় নিজেকেই প্রবোধ দেই, হতে তো পারত আরও খারাপ। না ও তো থাকতে পারতেন জননেত্রী শেখ হাসিনা। উনিশে হয়নি তো কি, উনচল্লিশে তো হবে। আমি না দেখলেও দেখবে তো সুকন্যা আর সূর্য। তাই বা কম কিসে?
লেখক : সদস্য সচিব, সম্প্রীতি বাংলাদেশ।