ভুঁইফোড় সংগঠনের বিরুদ্ধে হার্ডলাইনে আওয়ামী লীগ ॥ কাউকেই ন্যূনতম ছাড় নয় ॥ এসব সংগঠনের অনুষ্ঠানে যোগ না দিতে মন্ত্রী-এমপিদের বারণ

16

কাজিরবাজার ডেস্ক :
দলের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্নকারী কথিত ভুঁইফোড় সংগঠনের বিরুদ্ধে আবারও হার্ডলাইনে আওয়ামী লীগের হাইকমান্ড। ক্ষমতায় থাকার সুযোগে সংগঠনের নামে ব্যাঙের ছাতার মতো কথিত ‘দোকান খুলে’ দলের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্নকারী এসব ভুঁইফোড়-ধান্ধাবাজ সংগঠনের বিরুদ্ধে কঠোর এ্যাকশনে নেমেছে দলটি। এখন থেকে বিতর্কিত ও দলকে বিব্রতকর অবস্থার মুখে ফেলে দেয়া এসব অবৈধ সংগঠনের কাউকেই ন্যূনতম ছাড় দেবে না আওয়ামী লীগ। ছাড় পাবে না এসব ভ্ুঁইফোড় সংগঠনের পৃষ্ঠপোষক, মদদদানকারীও। আর এসব ভুঁইফোড় সংগঠনের কোন অনুষ্ঠানে যোগ না দিতেও দলের মন্ত্রী-এমপি-নেতাদের বারণ করে দিয়েছে দলটি।
দলটির একাধিক সূত্রে জানা গেছে, সরকারী দলের নামে এসব ভুঁইফোড় সংগঠন খুলে ক্ষমতার দাপট দেখানো ব্যক্তি, তদ্বির বাণিজ্য, ধান্ধাবাজি, চাঁদাবাজি, দখলদারী কিংবা অনৈতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে শুধু সাংগঠনিক ও আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণই নয়, পাশাপাশি সরকার ও দলের মন্ত্রী-এমপি কিংবা নেতাদের মধ্যে কারা কারা এসব কথিত ভুঁইফোড় সংগঠনকে পৃষ্ঠপোষকতা, মদদ কিংবা নেপথ্যে থেকে উৎসাহিত করছে, তাদের ব্যাপারেও খোঁজখবর নিতে শুরু করেছে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নীতিনির্ধারক নেতারা। তাঁদের মতে, গঠনতন্ত্রের বাইরে অনুমোদিত দোকান খুলে অবৈধ কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে কঠোর এ্যাকশন শুরু হয়েছে। এসব অপকর্মের সঙ্গে জড়িত যত বড় ক্ষমতাধর ব্যক্তি বা নেতাই হোন না কেন, এবার কাউকেই আর ছাড় দেয়া হবে না।
গত শনিবার আওয়ামী লীগের সম্পাদকমণ্ডলীর সভায় আওয়ামী লীগের নামে গড়ে ওঠা অসংখ্য ভুঁইফোড় ও নামসর্বস্ব সংগঠনের মাধ্যমে দল ও সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করার বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়। করোনার সংক্রমণ বৃদ্ধির কারণে এতদিন কিছুটা চুপচাপ থাকলেও এখন থেকে আবারও এসব কথিত সংগঠনের বিরুদ্ধে কঠোর এ্যাকশন গ্রহণের দাবি ওঠে বৈঠকে।
বৈঠকে এমন আলোচনার পরপরই দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের নির্দেশে শনিবার দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে ‘আওয়ামী মুক্তিযোদ্ধা প্রজন্ম লীগ’-এর প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর অনুষ্ঠান বন্ধ করে দিয়ে তাদের মঞ্চসহ সবকিছু সরিয়ে নিতে ওই সংগঠনের নেতাকর্মীদের বাধ্য করা হয়। সাফ জানিয়ে দেয়া হয়- আওয়ামী লীগের নাম ভাঙ্গিয়ে আর কোন ভুঁইফোড় সংগঠনকে কোন ধরনের তৎপরতা চালাতে দেয়া হবে না। এমনকি এসব সংগঠনের পরিচয় দিয়ে কোথাও কোন ধরনের অনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগ এলে তাদের আইনের হাতে সোপর্দ করার কথাও জানিয়ে দেন কেন্দ্রীয় নেতারা।
এ ব্যাপারে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, মুক্তিযোদ্ধা প্রজন্মের ব্যাপারে আমাদের কোন দ্বিমত নেই। কিন্তু লীগ আর আওয়ামী যখন যুক্ত হয় তখন এখানে আমাদের সংশ্লিষ্টতা এসে যায়। এখানে আমাদের ভাবমূর্তির বিষয়টি এসে যায়। কারণ এসব দোকান অনেকে খুলে থাকে চাঁদাবাজির জন্য। এগুলোর বেশিরভাগই আসলে চাঁদাবাজির প্রতিষ্ঠান। তবে সবাই চাঁদাবাজি করে, তা নয়। কিছু কিছু প্রতিষ্ঠান আছে যারা চাঁদাবাজিনির্ভর। আগামীতে এসব নামসর্বস্ব সংগঠনের কোন কর্মসূচীতে দলের কেন্দ্রীয় নেতারা অতিথি হিসেবে না যায়, সেজন্য কেন্দ্রীয় নেতাদের প্রতি অনুরোধ জানান ওবায়দুল কাদের।
কেন্দ্রীয় নেতারা আগামীতে যেহেতু ভুঁইফোড় সংগঠনগুলোতে যাবেন না, সেহেতু মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীরাও যাতে সেখানে না যান, সেটাও নিশ্চিত করার বিষয়টি আলোচনায় আসে। পরে সম্পাদকমণ্ডলীর এই প্রস্তাব মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীদের অবহিত করে কেন্দ্রীয় নেতাদের মতো তাঁদেরও ভুঁইফোড় সংগঠনের কোন কর্মসূচীতে অতিথি হিসেবে যোগদান থেকে বিরত থাকার অনুরোধ জানানো হবে বলে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে আওয়ামী লীগ। একই সঙ্গে এসব সংগঠনের অপতৎপরতা বন্ধে প্রশাসনিক ব্যবস্থা গ্রহণেরও আহ্বান জানানো হয়।
এ ব্যাপারে আওয়ামী লীগের একাধিক কেন্দ্রীয় নেতা বলেন, যারা সংগঠনের নামের আগে ‘আওয়ামী’ বা ‘লীগ’ শব্দ ব্যবহার করে সংগঠন করে দলের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করছে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। এ ব্যাপারে দলের শীর্ষ পর্যায় হার্ডলাইনে। আমরা ২০১৫ সালে কথিত এসব ভুঁইফোড় সংগঠনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছিলাম, তখন জড়িত অনেককেই গ্রেফতার হয়ে কারাগারে যেতে হয়েছে। এরপরে আরও কথিত এসব সংগঠন গজে উঠেছে। এবার কাউকে আর ছাড় দেয়া হবে না। তবে এটা ঠিক যে, কিছু নেতার অসাবধানতার সুযোগ নিয়ে অগঠনতান্ত্রিকভাবে গড়ে ওঠা এসব প্যাডসর্বস্ব সংগঠনের সুযোগসন্ধানীরা নানা অপকর্ম করে। এ ব্যাপারে সবার সতর্ক হওয়া দরকার।
আওয়ামী লীগের উপকমিটি থেকে বহিষ্কৃত ব্যবসায়িক আলোচিত-সমালোচিত নেত্রী হেলেনা জাহাঙ্গীরের বিরুদ্ধে কঠোর এ্যাকশন গ্রহণের পর থেকে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে ক্ষমতার টানা তিন মেয়াদে ব্যাঙের ছাড়ার মতো গজিয়ে ওঠা ভুঁইফোড়, অনেকের মতে দোকান খুলে দাপট দেখানো বিতর্কিত ব্যক্তিদের মধ্যে। হেলেনা জাহাঙ্গীরের মতো তাদের ভাগ্যেও জড়িয়ে পড়ার ভয়ে অনেকেই এখন গা ঢাকা দিয়েছে, আবার অনেক ভুঁইফোড় সংগঠনের শীর্ষ বিতর্কিত ব্যক্তিদের তৎপরতাও থেমে গেছে আওয়ামী লীগের কঠোর এ্যাকশনের খবর পেয়ে।
প্রতিবছর শোকের মাস এলে এসব ভুঁইফোড় সংগঠনের ধান্ধাবাজ নেতার ঢাউস ঢাউস ছবি দিয়ে নানা ধরনের পোস্টার-লিফলেট-ব্যানার রাজধানী ছেয়ে ফেলার চিত্র দেখা গেলেও এবার সরকার ও আওয়ামী লীগের কঠোর এ্যাকশনের খবর পেয়ে সেই চিত্র যেন হঠাৎ করেই বদলে যায়।
দলটির একাধিক নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ইতোমধ্যে আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারকদের পক্ষ থেকে বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা ও দলের কিছু নেতাকে দায়িত্ব দিয়েছেন এসব বিতর্কিত ভুঁইফোড় সংগঠনের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের ব্যাপারে খোঁজ খবর নিতে। খোঁজ নেয়া হচ্ছে এসব বিতর্কিত ব্যক্তিদের অতীত কর্মকাণ্ড ও সম্পদের হিসাবও। অনুসন্ধানে যাদের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগের নাম ভাঙ্গিয়ে অবৈধ সুযোগ-সুবিধা গ্রহণের অভিযোগ পাওয়া যাবে, তাদের বিরুদ্ধে হেলেনা জাহাঙ্গীরের মতোই কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে। এক্ষেত্রে এসব ভুঁইফোড় সংগঠনের পৃষ্ঠপোষক কিংবা মদদদানকারীরও ছাড় পাবে না বলে জানা গেছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকার সুযোগ নিতে দেশে ‘আওয়ামী’ ও ‘লীগ’ কিংবা বঙ্গবন্ধু পরিবারের সদস্যদের নাম ব্যবসার করে জন্ম নেয়া ভুঁইফোড় সংগঠনের সংখ্যা দিন দিন আশঙ্কাজনকহারে বাড়ছে। প্রতিনিয়ত এমন শব্দ জুড়ে দিয়ে বিভিন্ন সংগঠনের জন্ম নিচ্ছে। সুযোগসন্ধানী ও ভুঁইফোড় শতাধিক সংগঠনের নেতাদের নানা বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের কারণে মূল দল আওয়ামী লীগকে প্রায়শই বিভিন্ন ধরনের বিব্রতকর পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হচ্ছে। অথচ আওয়ামী লীগের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী এসব দলের কোন অস্তিত্ব নেই কিংবা মূল দলের আনুষ্ঠানিক কোন স্বীকৃতি নেই।
আওয়ামী লীগের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী, দলের সহযোগী ও ভাতৃপ্রতীম সংগঠনের সংখ্যা মাত্র ১০টি। সর্বশেষ সহযোগী সংগঠনের স্বীকৃতি পেয়েছে অওয়ামী মৎস্যজীবী লীগ। অন্য সহযোগী সংগঠনগুলো হলো- যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ, মহিলা আওয়ামী লীগ, যুব মহিলা লীগ, তাঁতী লীগ, কৃষক লীগ, বঙ্গবন্ধু আইনজীবী পরিষদ ও স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদ। এ ছাড়া ভাতৃপ্রতীম সংগঠন হচ্ছে ছাত্রলীগ ও জাতীয় শ্রমিক লীগ।
এসব সহযোগী ও ভাতৃপ্রতীম সংগঠন ছাড়াও কিছু সমমনা সংগঠন রয়েছে সেগুলো নিজেদের ইতিবাচক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে আওয়ামী লীগের সরাসরি সমর্থন নিয়ে কাজ করছে। দলের চরম দুঃসময়ে এসব সমমনা সংগঠন রাজপথে সাহসী ভূমিকা পালনের পাশাপাশি সারাদেশে জাতির পিতার আদর্শ এবং আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক শক্তি বৃদ্ধিতে সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে।
এসব সংগঠন আওয়ামী লীগের সহযোগী কিংবা ভাতৃপ্রতীম সংগঠনের মর্যাদা না পেলেও দলের নীতিনির্ধারক নেতারা তাদের মর্যাদার সঙ্গেই দেখেন এবং পৃষ্ঠপোষকতা করেন। বঙ্গবন্ধু পরিষদ, বঙ্গবন্ধু সাংস্কৃতিক জোট, শেখ রাসেল শিশু-কিশোর পরিষদ, বঙ্গবন্ধু শিশু-কিশোর মেলা, জয় বাংলা সাংস্কৃতিক ঐক্যজোট, একাত্তরের প্রজন্ম লীগ, মহিলা শ্রমিক লীগসহ বেশ কিছু সংগঠন রয়েছে। এসব সংগঠনের বিষয়ে দলের নেতাদের মনোভাব ইতিবাচক এবং তাদের কর্মকাণ্ড মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে সারাদেশে বিকশিত করতেই বিশেষ ভূমিকা রাখছে।
তবে ২০০৯ সালের পর প্রায় যুগেরও বেশি সময় ধরে ব্যাঙের ছাতার মতো অসংখ্য বিতর্কিত ভুঁইফোড় সংগঠন গড়ে উঠেছে, যাদের কারণে মূল দল আওয়ামী লীগকে অসংখ্যবার বিব্রতকর পরিস্থিতির মুখে পড়তে হয়েছে। এসব সংগঠন গড়ে তোলার প্রধান লক্ষ্যই হচ্ছে ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে তদ্বির বাণিজ্য, দখল কিংবা অনৈতিক আর্থিক সুবিধা গ্রহণের লক্ষ্যে। শুধু এসব অবৈধ সংগঠনই নয়, মূল দলের উপকমিটিতেও ঢুকে পড়া কিছু বিতর্কিত ব্যক্তির কারণেও আওয়ামী লীগকে চরম বিতর্কিতের মুখে পড়তে হয়। খোঁজ নিয়ে দেখা যায়, এসব বিতর্কিত নেতাদের উপকমিটিতে প্রবেশে দলের জ্যেষ্ঠ নেতা বা মন্ত্রীদের তদ্বির ছিল। এ বিষয়টিও আমলে নিয়ে আওয়ামী লীগ ভুঁইফোড় নেতাদের পাশাপাশি তাদের পৃষ্ঠপোষকদেরও আলাদা তালিকা তৈরির কাজে মাঠে নেমেছে। দলের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্নকারী যত বড় ব্যক্তি বা নেতাই হোন না কেন, এবার আর ন্যূনতম ছাড় পাবে না বলেও হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারক নেতারা।