তিউনিসিয়ার নৌকা ডুবি ॥ জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি সামাদের ভাই সহ যাদের মর্মান্তিকভাবে চলে যেতে হলো

47
নিহত কামরান আহমদ মারুফ।

সাগরে ডুবে যাওয়ার আগে বড় ভাই মাছুমের হাত ধরে ছিলেন সিলেটের কামরান আহমদ মারুফ। মারুফকে বাঁচাতে দীর্ঘ আট ঘণ্টা সাগরে সাঁতার কেটেছেন মাছুম।
মারুফ তখন বলেছিল, ‘আমারে বাঁচানো যাইতনায় ভাই, পুরা শরীর ঠাণ্ডায় অবশ ওইযার। আমারে ছাড়ি দেও, তুমি বাঁচার চেষ্টা করো’। এই বলে মারুফ মাছুমের হাত ছেড়ে দিলে সাগরে তলিয়ে যায়।
সাগরে নিখোঁজ মারুফের বড় ভাই জেলা ছাত্রলীগের সাবেক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ক সম্পাদক মাসুদ আহমদ ভাগ্যক্রমে বেঁচে যাওয়া তার অনুজ মাছুমের কাছ থেকে শুনে হৃদয় বিদারক এমন ঘটনার বর্ণনা দেন। একইভাবে মোবাইল ফোনে তিন ভাতিজার মৃত্যুর খবর পৌঁছাতে গিয়ে হাউমাউ করে কাঁদছিলেন ভূমধ্যসাগর থেকে উদ্ধার হওয়া ফেঞ্চুগঞ্জের মুহিদপুরের বিলাল আহমদ।
উদ্ধার হওয়ার পর স্বজনদের কাছে রোমহর্ষক বর্ণনা দিয়ে তিনি বলেন, ‘আমি ইতা (এসব) বিশ্বাস করছি না, আমি বাছিয়া (বেঁচে) আছি, আর আমার ভাতিজাইন নাই’। ‘আমার ভাতিজাইনতরে (ভাতিজাদের) বাছাইয়া আল্লায় আমারে নিলো না কেনে?’
সাগরে নিখোঁজ লিটনের বাবা সিরাজ মিয়া বিলাপ করে বিলালের দেওয়া রোমকর্ষক ঘটনার বর্ণনা দিয়ে সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমি ১১ ঘণ্টা পানির লগে যুদ্ধ করিয়া বাছিয়া আছি।’ আমি কৈতাকি আছি, জানি না। ভাতিজাদের মরদেহ কৈ আছে, তাও জানি না। মাছ ধরার ট্রলার ১৬ জনকে তিউনিসিয়ায় তুলেছে।’
সাগরে নিখোঁজ হন ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি শাহরিয়ার আলম সামাদের ছোট ভাই আহসান হাবিব শামীম।
অতি আদরের ছোট ছেলেকে (আহসান হাবিব শামীম) হারিয়ে বিলাপ করছেন তার মা রাজনা বেগম।
স্বজনরা জানান, বৃহস্পতিবার (৯ মে) সেহেরির সময় মাকে ফোন করে শামীম বলেছিল ‘দীর্ঘপথ পায়ে হাঁটার পর এবার সাগর পাড়ি দেবো মা, দোয়া করো। শামীম তার মাকে তখন জানিয়েছিল তারা ৮০ জনের মতো ইতালিতে সাগর পাড়ি দেবেন।
নিহত শামীমের গ্রামের বাড়ি মৌলভীবাজারের কুলাউড়া উপজেলার ভুকশিমইল গ্রামে।
শামীমের মায়ের বিলাপ করার কথা জানিয়ে স্বজনরা বলেন, শামীমের এবার দাখিল পরীক্ষায় অংশ নেওয়ার কথা ছিল। লেখাপড়া ছেড়ে ইউরোপে যাওয়ার জন্য দালাল মারফতে চুক্তিতে শামীম রওয়ানা হন।
নিহতদের স্বজনরা অভিযোগ করেন, তাদের জাহাজে পাঠানোর কথা ছিল। কিন্তু প্লাস্টিকের ছোট ট্রলারে তোলা হয় ৮০ জন অভিবাসীকে। স্থান সংকুলান হচ্ছিলো না মোটেও। সাগরে আধা ঘণ্টা চলার পর প্রচণ্ড ঢেউয়ে ডুবে যায় ট্রলারটি। তাতে স্বপ্নের সমাধি হয় মৌলভীবাজার ও সিলেটের ছয় যুবকসহ ৬০ জনের বেশি লোকের।
সিলেটের নিহতরা হলেন- ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলার সেনেরবাজার কটালপুর এলাকার মুহিদপুর গ্রামের মন্টু মিয়ার ছেলে আহমদ হোসেন (২৪), একই গ্রামের হারুন মিয়ার ছেলে আব্দুল আজিজ (২৫), সিরাজ মিয়ার ছেলে লিটন মিয়া (২৪) ও মানিকোনা গ্রামের মৃত রফিক উদ্দিনের ছেলে আফজাল মোহাম্মদ (২৫)।
এ ঘটনায় নিহত অন্য দু’জন হলেন-মৌলভীবাজারের কুলাউড়া উপজেলার বকশিমইলের বাসিন্দা সিলেট জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি শাহরিয়ার আলম সামাদের ছোট ভাই শামীম আলম ও জেলা ছাত্রলীগের সাবেক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ক সম্পাদক মাসুদ আহমদের ছোট ভাই কামরান আহমদ (মারুফ)। তার বাড়ি গোলাপগঞ্জ উপজেলার শরীফগঞ্জ ইউনিয়নের কদুপুর গ্রামে। তার বাবার নাম ইয়াকুব আলী।
গত ৯ মে গভীর রাতে লিবিয়া উপকূল থেকে ৭৫ জন অভিবাসীবাহী একটি বড় নৌকা ইতালি পাড়ি জমায়। ভূমধ্যসাগরে গিয়ে নৌকাটি ডুবে গেলে প্রায় ৬০ জন অভিবাসী প্রাণ হারান। এর অধিকাংশই বাংলাদেশি নাগরিক বলে জানিয়েছে তিউনিসিয়ার রেড ক্রিসেন্ট।
সংস্থাটি বলছে, গভীর সাগরে বড় নৌকা থেকে অপেক্ষাকৃত ছোট একটি নৌকায় তোলা হলে কিছুক্ষণের মধ্যেই সেটি ডুবে যায়।
১৬ জনকে উদ্ধার করে শনিবার (১২ মে) সকালে জারযিজ শহরের তীরে নিয়ে আসেন তিউনিসিয়ার জেলেরা। উদ্ধার হওয়া অভিবাসীরা জানান, সাগরের ঠাণ্ডা পানিতে প্রায় আট ঘণ্টা ভেসে ছিলেন তারা। (খবর সংবাদদাতার)