খোশ আমদেদ মাহে রমজান

104

অধ্যাপক মনিরুল ইসলাম রফিক :
রহমতের সুসংবাদবাহী মাহে রমজানের আজ ষষ্ঠ দিবস। চলমান মাহে রমজান আমাদের চেতনা সমৃদ্ধির মৌসুম। বর্তমান সমাজে ‘চেতনা’ শব্দটি বহুল ব্যবহৃত শব্দ। যে কোন ব্যাপারে সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক কার্যপরিসরে মৃতপ্রায় ও উদাসীন এ সমাজকে জাগিয়ে তোলার জন্য আমরা ‘চেতনা’র প্রয়োগ করি। কিন্তু একটি বিশেষ চেতনা জাগরূক করতে পারলে আমাদের হাজার অচেতন অবস্থা কেটে উঠত। মানুষ ধনের প্রতিযোগিতা, মানের প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হতো না; অবতীর্ণ হতো সত্যনিষ্ঠ ও আমানতদার প্রমাণের প্রতিযোগিতায়। কিভাবে সততার সঙ্গে অল্পে তুষ্ট থেকে জীবন কাটানো যায় তা খুঁজে বের করত সচেতন মানুষ। ফলে লাভ হতো যে, প্রতিযোগিতার বাজারে দুর্বল শ্রেণী মাঠে মারা যেত না, ক্ষণস্থায়ী দুনিয়ার লোভ ও স্বার্থে মানুষ যা-তা করার সাহস পেত না, দুর্নীতি আর দুর্নীতিবাজ দুটোই নিপাত যেত। লোকেরা আপনাতে আপনি মগ্ন হতো। অন্যের অনিষ্ট চিন্তা না করে ত্যাগী মনোভাব নিয়ে সমাজ সুন্দরে অবদান রাখত। সে বিশেষ চেতনাটি হলো আখিরাতের ভয় বা পরকালীন চেতনা। মনে মনে এ হিসাবটা বার বার করে দেখা যায় যে, আমার সুনির্দিষ্ট এ দুনিয়াবী জীবনের পরে বহুত কষ্টার্জিত ধনসম্পদ আমার সঙ্গে সঙ্গে থাকছে কিনা। বস্তুত দেখা যায়, বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ বাদশাহ থেকে নগণ্য ফকির পর্যন্ত জন্মকালীন যে অসহায় অবস্থায় ভূমিষ্ঠ হয়, ঠিক একই অসহায় ও নিঃস্ব বদনে ভূগর্ভে (মাটির নিচে) চলে যেতে হয়। কোন এক মহত্তর চেতনা শক্তির অভাবে বনী আদম আজ পথভ্রষ্ট, দিকভ্রান্ত, ধনবৈভবের প্রতিযোগিতায় এখন না পারছে নিজের জন্য চিন্তা করতে আর না পারছে অন্যের দিকে সাহায্যের হাত বাড়াতে। মানব জীবনের এ এক বড় ত্রুটি, বড় বোকামি বৈ কিছু নয়।
অনেক আগের একটি কাহিনী আজো সমাজের মুরব্বিশ্রেণীর মুখে শোনা যায়। কোন এক বাদশাহ তার বাঁদিকে খুব ভালোবাসতেন। এ ভালোবাসার উপহারস্বরূপ তিনি বাঁদিকে একটি শাহী ক্ষমতা দান করলেন। তা হলো: যদি তুমি কোন বোকা লোক পাও তবে তার মুখে থুথু নিক্ষেপ করবে। এরপর থেকে থুথু খাওয়ার ভয়ে শাহী মহলে সবাই চিন্তাভাবনা করে চলতে লাগল। এমনকি শিক্ষিত প-িতরাও বেশ সতর্ক। বাঁদি কোথাও বোকা লোক পেল না যার মুখে থুথু ফেলা যায়। একদিন বাদশাহর কঠিন অসুখ। তিনি মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছেন। সবাইকে ডেকে ডেকে আখেরি বিদায় নিচ্ছেন। বাঁদিকেও ডেকে বিদায় চাচ্ছেন তিনি। বাদশাহ বলছেন: বাঁদি আমি চললাম। বাঁদি, বাদশাহ নামদার, আপনি কোথায় যাচ্ছেন? উত্তরে বাদশাহ: আমি এমন জায়গায় যাচ্ছি যেখান থেকে কেউ কোন দিন ফিরে আসে না। বাঁদি: বাদশাহ সালামত! আপনার সঙ্গে সেবা কার্যের বাঁদি, লোকজন, বিছানাপত্র, সৈন্যসামন্ত, তখত ইত্যাদির ব্যবস্থা করা হয়েছে? বাদশাহ বললেন: না বাঁদি! ওখানে দাসদাসি, সৈন্যসামন্ত, লোকজন, বিছানাপত্র কিছুই নেয়া যায় না। তবে যে জিনিসের বিনিময়ে এগুলোর চেয়ে বেশি দামী বিছানাপত্র, সেবিকা, আরাম আয়েশ পাওয়া যায় আমি তো তার কিছুই সংগ্রহ করিনি, বাঁদি। আমি যে আজ রিক্তহস্ত। এত কিছু থেকেও আজ শূন্য হাতে আমাকে বিদায় নিতে হচ্ছে, বাঁদি। আমি জীবনে এত বোকামি করেছি। আজ আমি বুঝতে পেরেছি আমার মতো বোকা আর একটি নেই। বাঁদি: বাদশা মহান! আজ থেকে বারো বছর আগে আপনি আমাকে থুথু নিক্ষেপের ক্ষমতা অর্পণ করেছিলেন। আমি এতদিন তেমন কোন বোকা লোক না পেয়ে সেই ক্ষমতা ব্যবহার করতে পারেনি। আজ আমি বুঝতে পারছি আপনি সেই বোকা। এই ক্ষণস্থায়ী দুনিয়াতে আরাম-আয়েশের জন্য আপনার যা দরকার এ সবই আপনি করেছেন, বরং অনেক বাড়িয়ে করেছেন। দাসি দরকার একজন, করেছেন হাজারজন। হাতি-ঘোড়া, দালান-কৌটা সব করেছেন এই রূপ। অথচ চিরকাল যেখানে থাকতে হবে সেখানকার জন্য আপনি কিছুই করেননি। তাই আপনি সেই বোকাশ্রেষ্ঠ- যার মুখে এই অধম বাঁদি থুথু নিক্ষেপ করতে পারে! কোরানে এসেছে (ওয়া তাজাওয়াদু ফাঈন্না খাইরাজ্জাদিত্ তাকওয়া) অর্থাৎ, হে মানুষেরা! তোমরা পাথেয় সংগ্রহ করে নাও তবে মনে রেখো যে, তাকওয়াই হলো উত্তম পাথেয়। তাকওয়া মানেই হলো পরকালীন জবাবদিহিতার মানসিকতায় উজ্জীবিত হয়ে হালাল-হারাম বাছবিচার করে চলা। আসলে দুনিয়ার বুকে খুব নগণ্য পরিমাণ মানুষই পরকালকে অস্বীকার করে। অপরপক্ষে প্রায় সকলেই আখিরাতকে মানুষের অবধারিত চিরস্থায়ী মঞ্জিল হিসেবে বিশ্বাস করে। কিন্তু সমস্যা হলো, কাজের মাঝে এ বিশ্বাস সংরক্ষণ করে না। এতেই বিপত্তি। আখিরাতের জন্য তো বটেই, দুনিয়ার সুখ-সৌন্দর্যের জন্যও চাই পরকালীন সচেতনতা সর্বক্ষণ। মাহে রমজান সে সুযোগ এনে দিয়েছে।