বিশ্ব মা দিবস আজ

147

কাজিরবাজার ডেস্ক :
‘মধুর আমার মায়ের হাসি চাঁদের মুখে ঝরে, মাকে মনে পড়ে আমার মাকে মনে পড়ে।’ গলার সুর যেমনই থাক না কেন নিজের অজান্তেই মাকে নিয়ে এমন অসংখ্য গানের লাইন গেয়ে ওঠেন অনেকেই। কিন্তু সব মায়ের ভাগ্যে সন্তানের ভালোবাসা জোটে না। সন্তানসহ পরিবার-পরিজন নিয়ে জীবনের শেষ সময়টুকু আনন্দে কাটাতে পারেন না অনেকেই। তাদেরই একজন জহুরা খাতুন (আনুমানিক ৯০ বছর)। পরিবার, সন্তান জমিজমা থাকলেও শেষ বয়সে কাটাতে হচ্ছে বৃদ্ধাশ্রমে।
গত বৃহস্পতিবার উত্তরখান থানার মৈনারটেকের ‘আপন নিবাসে’ কথা হয় তার সঙ্গে। আলাপকালে অশ্রম্নস্বজল নয়নে এ প্রতিবেদকে তিনি বলেন, একদিন তার সবই ছিল, কপাল দোষে আজ এই অবস্থা হয়েছে। স্বামী মারা যাওয়ার পর সন্তানরা যার যার মতো সংসার পেতে আলাদা হয়ে যায়। কিন্তু কারো কাছেই মায়ের জায়গা হয়নি। ফলে ৫ বছর আগে অভিমান করে বাড়ি থেকে বের হয়ে যান। তারপর কিভাবে এখানে এসেছেন সে কথা ভালো করে বলতে পারেন না তিনি। আশ্রম সংশ্লিষ্টরা জানান, তাকে পুরান ঢাকার একটি গলি থেকে কুড়িয়ে পেয়ে এখানে আনা হয়েছে। শুধু জহুরা খাতুনই নয় বৃদ্ধাশ্রমে ঠাঁই হওয়া অন্তত অর্ধশত মায়ের জীবনের গল্পগুলো আরও করুণ।
জহুরার মতো যেসব মা শেষ বয়সে সন্তানের সান্নিধ্য পান না, পরিবারের সঙ্গে থাকতে পারেন না, তাদের আশ্রয় হয়েছে এই বৃদ্ধাশ্রম। সহায়-সম্বলহীন এসব মায়ের বেঁচে থাকা নিয়ে যত না চিন্তা তার চেয়ে বেশি চিন্তা মৃত্যুর পর শেষকৃত্য নিয়ে। এসব ভেবেই চোখে জল চলে আসে প্রায় শতবর্ষী সালমা খাতুনের। তিনি জানান, জীবন তো কোনো মতো শেষই। কিন্তু মরার সময়ও সন্তানরা পাশে থাকবে না। কোথায় দাফন হবে তাও জানেন না।
সরেজমিন আশ্রমটিতে দেখা গেছে, দোতালা ভবনের ৫টি কক্ষে অন্তত ৫০ জন বৃদ্ধা থাকেন। দোতলার তিনটি কক্ষের একটিতে পাশাপাশি বিছনায় প্রায় ১৫ জন অশীতিপর বৃদ্ধার কেউ শুয়ে কেউ বসে আছেন, কেউবা একদৃষ্টিতে জানালার বাইরে তাকিয়ে আছেন। দোতলার গ্রিলে ধরে আকাশ পানে তাকিয়ে কী যেন ভাবছেন আরেক মা। কাছে গিয়ে সন্তানদের কথা জিজ্ঞেস করতেই চোখ দুটো ছলছল করে ওঠে তার। সন্তানদের ব্যাপারে কোনো কথা বলেননি তিনি।
আশ্রম কর্তৃপক্ষ জানান, এখানকার সবাইকে বিভিন্ন জায়গা থেকে একরকম কুড়িয়ে আনা হয়েছে। নারায়ণগঞ্জের রূপসী মার্কেট এলাকা থেকে শতবর্ষী সালমা খাতুন, দয়াগঞ্জ এলাকা থেকে ৯৫ বছরের সরবানু, বনানী পার্কে পরে থাকা ৯০ বছর বয়সি রাবেয়া খাতুন, ঢাকা মেডিকেল থেকে ৯১ বছরের জরিনা বেগমসহ ৫০ জন বৃদ্ধাকে বিভিন্ন জায়গা থেকে আনা হয়েছে। তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, পরিবারে থাকার জায়গা না পেয়েই রাস্তায় বেরিয়েছিলেন। কেউ বা ছেলের বউ অথবা সন্তানদের কাছ থেকে কষ্ট পেয়ে ঘর ছেড়ে চলে এসেছেন। কারো সন্তানের সামর্থ্য থাকার পরও মাকে দেখাশোনা করেনি। তাই শেষ বয়সে পরিবার ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন তারা।
আলাপকালে আশ্রমটির তত্ত্বাবধায়ক শামছুন্নাহার যায়যায়দিনকে বলেন, পরিবার-পরিজনহীন হয়ে নিবাসটিতে থাকা এই মায়েদের বেশিরভাগই মানসিকভাবে কিছুটা অসুস্থ। সবাই কমবেশি শারীরিকভাবেও অসুস্থ। ইতোমধ্যে ২০ জন একেবারে শয্যাশায়ী হয়েছেন। সবারই চিকিৎসক দেখানোর প্রয়োজন হয়। প্রতিদিনই ডায়াবেটিস, প্রেসার, গ্যাসের ওষুধের মতো কমন মেডিসিন দিতে হয়। সবচেয়ে কষ্টের ব্যাপার হলো এখানে কোনো মা মারা গেলেও সন্তান বা স্বজনেরা খোঁজ নেন না। দাফন করার জন্যও সন্তানেরা আসেন না।
বৃদ্ধাশ্রমের পরিচালক সৈয়দা সেলিনা হক শেলী যায়যায়দিনকে বলেন, প্রায় এক যুগ আগে বিভিন্ন সময়ে ৭ জন বৃদ্ধাকে রাস্তা থেকে কুড়িয়ে পান। এরপর শুধুমাত্র মানবিক কারণে সহায়সম্বলহীন অসহায় বৃদ্ধাদের নিয়ে ২০১০ সালের ৮ মার্চ ‘আপন নিবাস’ নামের এই বৃদ্ধাশ্রম গড়ে তোলেন। এখানে যারা আছেন তাদের বেশিরভাগই ছিন্নমূল, হতদরিদ্র। ফলে নিজেদের প্রচেষ্টা, মাঝে-মধ্যে স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ও কিছু মানুষের দান-সদকা, জাকাত-ফিতরা, কুরবানির পশুর চামড়ার টাকা-পয়সায় এটি পরিচালিত হচ্ছে। এখন পর্যন্ত ২৭ জনকে পরিবারের কাছে বুঝিয়ে দেয়া হয়েছে। এখানে বসবাসরত ৩৭ জন মা মারা গেছেন। এদের দাফনের জন্য স্থানীয় কবরস্থানে জায়গা দিতে চায় না। কর্তৃপক্ষ যদি উত্তরখানের টালাবর ও মধুরজান গণ-কবরস্থানে একটা ব্যবস্থা করে দিত সুবিধা হতো। পাশাপাশি সরকার ও সমাজের বিত্তশালীদের কেউ একটি স্থায়ী আবাসন ব্যবস্থা করে দিলে কিছুটা হলেও কষ্ট লাঘব হতো।
শেষ বয়সে এসে বৃদ্ধাশ্রমে অনেক মায়ের করুণ জীবনাচার সম্পর্কে পাবনা মানসিক হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. তন্ময় প্রকাশ বিশ্বাস যায়যায়দিনকে বলেন, পৃথিবীতে সন্তানের কাছে ভালোবাসার সর্বোচ্চ আধার হলো মা। মায়ের অনুগ্রহ ছাড়া কোনো প্রাণীর জন্মই সম্ভব না। সন্তানের জন্য বিপুল ত্যাগ স্বীকারের ক্ষেত্রে মায়ের বিকল্প কেউ নেই। কিন্তু সমাজে অনেকেই আছেন শুধু স্বার্থের জন্য মা-বাবার ভরণপোষণ দেন না। মূলত নৈতিকতা ও মূল্যবোধের অভাবেই এমনটা হচ্ছে। তাছাড়া বিশ্বায়নের এই যুগে বিশেষ করে প্রাশ্চাত্য সংস্কৃতির প্রভাবে জয়েন ফ্যামেলি (একান্নবর্তী পরিবার) প্রথা ভেঙে নিউক্লিয়ার ফ্যামিলি (ছোট পরিবার) প্রধান্য পাওয়ায় ব্যক্তির আত্মকেন্দ্রিকতা বাড়ছে। তবে ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রীয় সচেতনতা এটা কমাতে পারে বলে তিনি মন্তব্য করেন।
মা দিবসের কর্মসূচি: এদিকে প্রতিবছর মে মাসের দ্বিতীয় রোববার সারাবিশ্বে দিবসটি পালিত হয়। ইউরোপ-আমেরিকায় ঘটা করে দিবসটি পালন করলেও বাংলাদেশে এর ইতিহাস খুব বেশি দিনের নয়। তবে গত কয়েক বছর ধরে দিবসটি নিয়ে বিভিন্ন সংগঠনকে সরব থাকতে দেখা গেছে। এ ধারাবহিকতায় বিশ্ব মা দিবস-২০১৯ উপলক্ষে আজ সকাল সাড়ে ১০টায় ঢাকা ক্লাবের স্যামসন এইচ চৌধুরী সেন্টারে এক অনারম্বড় অনুষ্ঠানের মাধ্যমে কিছু রতœগর্ভ মায়ের হাতে ‘রতœগর্ভা মা অ্যাওয়ার্ড’ তুলে দেবে আয়োজক প্রতিষ্ঠান আজাদ প্রোডাক্টস। সকাল ১১টায় মহাখালীর রাওয়া কনভেনশন সেন্টারে ইউনিভার্সাল মেডিকেল কলেজ হাসপতালের উদ্যোগে ১০ জন মাকে গরবিনী মা-২০১৯ শীর্ষক বিশেষ সম্মাননা দেয়া হবে। এছাড়া সরকারের মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তর উদ্যোগে জেলা-উপজেলা পর্যায়ের মহিলাবিষয়ক কর্মকর্তারা স্থানীয়ভাবে দিবসটি উদযাপন করবেন।
প্রসঙ্গত, যুক্তরাষ্ট্রের আনা জার্ভিস ও তার মেয়ে আনা মারিয়া রিভস জার্ভিসের উদ্যোগে মা দিবসের সূচনা হয়। ১৯০৮ সালের ১০ মে যুক্তরাষ্ট্রের পূর্ব ভার্জিনিয়ার গ্রাফইনের গির্জায় আনুষ্ঠানিকভাবে মা দিবস পালন শুরু হয়। ১৯১১ সাল থেকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিটি রাজ্যে মা দিবস পালনের ঘোষণা দেয়া হয়। পরে ১৯১৪ সালের ৮ মে মার্কিন কংগ্রেস মে মাসের দ্বিতীয় রোববারকে মা দিবস হিসেবে ঘোষণা করে।