কাজিরবাজার ডেস্ক :
নিজের ভাইকে দলের বিভিন্ন দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেয়া আবারও ফিরিয়ে আনা নাটক নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে জাপা চেয়ারম্যান এইচএম এরশাদকে নিয়ে আলোচনা তুমুল। এরমধ্যে হঠাৎ করে নিজের সব সম্পত্তি ট্রাস্টের নামে দিয়ে নতুন করে চমক সৃষ্টি করেছেন বারবার মত পাল্টানো নেতা এরশাদ। এ ঘটনায় জাতীয় পার্টির নেতাকর্মীদের মধ্যে রীতিমতো হুলস্থূল সৃষ্টি হয়েছে।
নেতাকর্মীরা বলছেন, হঠাৎ করেই কেন ট্রাস্ট গঠন করলেন তিনি। তাছাড়া নিজের স্ত্রী ও ভাইদের বাদ দিয়ে ট্রাস্ট গঠন নিয়ে আছে নানা আলোচনা। অনেকে বলছেন, মত পাল্টানো রাজনীতিকদের মধ্যে এরশাদের জুড়ি নেই। তাই খেয়াল খুশিমতো হয়তো যে কোন সময় বোর্ড সদস্যের নাম বদলে দিতে পারেন। শেষ পর্যন্ত ট্রাস্ট থাকবে কিনা এ নিয়ে সন্দেহ। তবে নাম প্রকাশ না করার শর্তে এরশাদের ঘনিষ্ঠজনরা জানিয়েছেন, নিজের অবর্তমানে সম্পত্তি নিয়ে বিরোধ নিরসনেই ট্রাস্ট গঠন করেছেন এরশাদ। দিন দিন সাবেক এই রাষ্ট্রপতির শারীরিক অবস্থার অবনতি হওয়ায় ইতোমধ্যে তার দেশে বিদেশে থাকা সম্পদ নিয়ে পারিবারিক বিরোধ সৃষ্টি হয়েছে। বিশেষ করে রওশন এরশাদ নিজেই এই বিরোধ সৃষ্টির অন্যতম হোতা বলছেন কেউ কেউ। যদিও দীর্ঘদিন এরশাদের সঙ্গে থাকেন না রওশন। গুলশান দুই নম্বরে নিজ বাস ভবনে আলাদা থাকেন এরশাদের স্ত্রী। আর জাপা চেয়ারম্যান থাকেন বারিধারার প্রেসিডেন্ট পার্কের বাসায়। যেখানে তার আপনজন বলতে কেউ নেই। বাসার কাজের লোকজন নিয়েই তার সংসার। তারাই তাকে সব সময় দেখাশোনা করেন। সর্বশেষ অসুস্থতার জন্য তাকে সিঙ্গাপুরে নেয়া হলে সঙ্গে যান ছোট ভাই ও তার স্ত্রী। দলের দায়িত্বশীল একাধিক সূত্রে জানা গেছে, নির্বাচনের আগে হঠাৎ করেই গুরুতর অসুস্থ হয়ে যান সাবেক এই সেনা প্রধান। আকস্মিকভাবেই সয্যাশায়ী হয়ে পড়েন তিনি। এজন্য দেশে কিংবা দেশের বাইরে ভুল চিকিৎসার জন্য তার এমন হয়েছে বলে ধারণা নেতাদের। দিন দিন শারীরিক অবস্থার অবনতি হওয়ার বিষয়টি এরশাদ নিজেও বুঝতে পারছেন। তাই সর্বশেষ জন্মদিনের অনুষ্ঠানে এরশাদ নিজেই বলেছিলেন, ‘এটাই হয়তো আমার শেষ জন্মদিন। আর কোনদিন আমার উপস্থিতিতে হয়তো জন্মদিন পালন হবে না’।
এরই ধারাবাহিকতায় অসুস্থ জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ একটি ট্রাস্ট গঠন করে তাতে নিজের সব স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি দান করেছেন। ৯০ বছর বয়সী সাবেক এই সামরিক শাসক নিজেও ট্রাস্টি বোর্ডে সদস্য হিসেবে আছেন। রবিবার রাতে পাঁচ সদস্যের এই ট্রাস্ট গঠন করা হয়েছে বলে জাতীয় পার্টির সভাপতিম-লীর সদস্য খালেদ আক্তার এবং দলটির উপদফতর সম্পাদক এম এ রাজ্জাক খান জানিয়েছেন। দলের গুরুত্বপূর্ণ পদে থাকা স্ত্রী রওশন এরশাদ ও ভাই জিএম কাদেরকে ট্রাস্টি বোর্ডে রাখেননি এরশাদ। এ বিষয়ে জানতে চাইলে কোন কথা বলতে রাজি হননি জিএম কাদের।
বোর্ডের অন্য সদস্যরা হলেন- এরশাদের ছেলে এরিক এরশাদ, একান্ত সচিব ও আপন ভাগ্নে অবসরপ্রাপ্ত মেজর খালেদ আক্তার, চাচাত ভাই মুকুল ও তার ব্যক্তিগত কর্মকর্তা মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর। দলে পদায়ন, পদচ্যুতির নানা নাটকীয়তার মধ্যে এরশাদের বারিধারার বাসভবনে কয়েক দিন ধরেই আনাগোনা বেড়েছে তার সাবেক স্ত্রী বিদিশা এরশাদের। তাদের ছেলে এরিক এরশাদ থাকেন বাবার সঙ্গেই। এরশাদও বিভিন্ন সফরে অন্য নেতাদের সঙ্গে এরিককে নিয়ে যান।
এই বিষয়ে জানতে চাইলে বিদিশা বলেন আমি জাতীয় পার্টির কেউ না। জাতীয় পার্টির সঙ্গে আমার কোন সম্পৃক্ততাও নেই। আমি আমার ছেলেকে দেখতে সেখানে যাই।
ইউনিয়ন ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের সদস্য এরশাদ একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের হলফনামায় লিখেছিলেন, তার নগদ টাকার পরিমাণ ২৮ লাখের মতো। হলফনামায় এরশাদ বার্ষিক আয় দেখান ১ কোটি ৭ লাখ টাকা। ব্যবসা থেকে তিনি আয় করেন দুই লাখ ৬ হাজার ৫০০ টাকা। ইউনিয়নের ব্যাংক থেকে সম্মানী হিসেবে ৭৪ লাখ ৭১ হাজার ১০ টাকা পান এরশাদ।
এছাড়াও ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে তার ৩৭ লাখ ৬৯ হাজার ৪৬ টাকা জমা রয়েছে। বিভিন্ন শেয়ারে এরশাদের অর্থের পরিমাণ ৪৪ কোটি ১০ হাজার টাকা। তার সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ ও এফডিআর ৯ কোটি ২০ লাখ টাকা; ডিপিএস রয়েছে ৯ লাখ টাকার।
এরশাদ লিখেছিলেন, গুলশান ও বারিধারায় তার দুটি ফ্ল্যাট রয়েছে, যার দাম এক কোটি ২৪ লাখ টাকার কিছু বেশি। এর বাইরে ৭৭ লাখ টাকা দামের একটি দোকান রয়েছে তার। যানবাহনের মধ্যে তার রয়েছে ৫৫ লাখ টাকা দামের ল্যান্ড ক্রুজার জিপ, ১৮ লাখ টাকা দামের নিশান কার এবং ৭৫ লাখ ৫০ হাজার টাকা দামের আরেকটি ল্যান্ড ক্রুজার জিপ।
বেশ কিছু দিন ধরে শারীরিকভাবে অসুস্থ এরশাদ গত ৩০ ডিসেম্বরের একাদশ সংসদ নির্বাচনে একদিনও প্রচারে যাননি। নির্বাচনের আগে চিকিৎসার জন্য সিঙ্গাপুরে গিয়েছিলেন তিনি। সেখান থেকে ফেরার পর নির্বাচনের দিন ভোট দিতেও নির্বাচনী এলাকা রংপুরে যাননি এরশাদ। গত ৬ জানুয়ারি আইনপ্রণেতা হিসেবে শপথ নেন এরশাদ, তবে তিনি সংসদে গিয়েছিলেন হুইল চেয়ারে চড়ে। এরপর ২০ জানুয়ারি আবার সিঙ্গাপুর গিয়েছিলেন এরশাদ। তখন জাতীয় পার্টির পক্ষ থেকে জানানো হয়েছিল, রক্তে হিমোগ্লোবিন ও লিভারের সমস্যায় ভুগছেন তিনি। বর্তমানে বিরোধী দলের নেতার দায়িত্ব পালন করছেন জাপা চেয়ারম্যান।
জানা গেছে, ট্রাস্টের সম্পত্তির মধ্যে রয়েছে- এরশাদের বারিধারার প্রেসিডেন্ট পার্কের বাসা, গুলশানের দুটি ফ্ল্যাট, বাংলামোটরের দোকান, রংপুরের কোল্ড স্টরেজ, পল্লী নিবাস, রংপুরে জাতীয় পার্টির কার্যালয়, ১০ কোটি টাকার ব্যাংক ফিক্সড ডিপোজিট।
জাতীয় পার্টির একাধিক শীর্ষ নেতা জানিয়েছেন, গত প্রায় পাঁচ বছর আগে এরশাদের প্রেস সচিব সুনীল শুভ রায় ও জাপা নেতা-চলচ্চিত্র পরিচালক বাদল খন্দকার মিলে ‘পল্লীবন্ধু ট্রাস্ট’ গঠন করেছিলেন। এরশাদের অবর্তমানে সকল সম্পদ এই ট্রাস্টের আওতায় থাকবে মূলত এমন পরিকল্পনার অংশ হিসেবে ট্রাস্ট গঠন হয়েছিল। কিন্তু এতে সম্মত হননি এরশাদ। তাই পুরনো ট্রাস্টের কার্যক্রম আর সামনের দিকে যায়নি। এখন এরশাদ নিজেই ট্রাস্ট গঠন করেছেন। যেখানে নিজের সকল সম্পত্তি দিয়ে যাচ্ছেন তিনি।