কাজিরবাজার ডেস্ক :
অসহযোগ আন্দোলনের অষ্টাদশ দিবসে ঢাকার অদূরে জয়দেবপুর রাজবাড়ি থেকে ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের বাঙালি জওয়ানদের সেনানিবাসে ফিরিয়ে নিতে ব্যর্থ হয়ে পাঞ্জাবী ব্রিগেডিয়ারের নেতৃত্বে সামরিক কর্তৃপক্ষ একদল সেনা জয়দেবপুর পাঠান। জয়দেবপুরে জনতা এবং সেনাবাহিনীর সদস্যদের মধ্যে সংঘর্ষ বাঁধে। সংঘর্ষে ৫০ জন শহীদ হন এবং প্রায় দুই শতাধিক আহত হন। সন্ধ্যায় জয়দেবপুর শহরে অনির্দিষ্টকালের জন্য সান্ধ্য আইন জারি করা হয়। জয়দেবপুরে নিরস্ত্র নাগরিকদের ওপর সেনাবাহিনীর গুলিবর্ষণের তীব্র নিন্দা জানিয়ে সন্ধ্যায় শেখ মুজিবুর রহমান বলেন, যারা বুলেট ও শক্তি দিয়ে গণআন্দোলনকে স্তব্ধ করবেন বলে ভেবেছেন তারা বোকার স্বর্গে বাস করছেন। বাংলাদেশের মানুষ সমস্যার শান্তিপূর্ণ সমাধান চায়। কিন্তু এর অর্থ এই নয়, তারা শক্তি প্রয়োগে ভয় পায়। জয়দেবপুরে নিরস্ত্র মানুষের ওপর গুলিবর্ষণ এবং হত্যার সংবাদ ছড়িয়ে পড়লে রাজধানী ঢাকায় বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। হাজার হাজার মানুষ লাঠি-সোটা, বর্শা-বল্লম নিয়ে রাজপথে সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে। একদিন বিরতির পর সকালে আওয়ামী লীগ প্রধান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের মধ্যে তৃতীয় দফা একান্ত বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। শেখ মুজিব আবারও জোর দিয়ে বলেন, সঙ্কট উত্তরণের একমাত্র উপায় হলো অবিলম্বে সামরিক আইন প্রত্যাহার করা এবং নির্বাচিত গণপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা অর্পণ করা। দেড় ঘণ্টাব্যাপী ওই বৈঠকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে কোন সহকারী উপস্থিত ছিলেন না। আজও অনেক মিছিল শেখ মুজিবের বাসভবনে যায়। শেখ মুজিব তাদের উদ্দেশে বলেন, ‘শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে হলেও আমরা আমাদের ভবিষ্যত বংশধরদের জন্য স্বাধীন দেশের নাগরিক হিসেবে বাঁচার ব্যবস্থা করে যাব।’ রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশে সরকারী-বেসরকারী ভবন ও বাসভবনে কালো পতাকা উত্তোলন করা হয়। সরকারী-আধাসরকারী ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে কর্মবিরতি চলে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকে। ছাত্র-ছাত্রী ও তরুণ-তরুণীদের কুচকাওয়াজ এবং অস্ত্র চালন প্রশিক্ষণ চলে। সন্ধ্যায় প্রেসিডেন্ট ভবনে উপদেষ্টা পর্যায়ের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। দুইঘণ্টা স্থায়ী এই বৈঠকে আওয়ামী লীগের পক্ষে সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, ড. কামাল হোসেন এবং সরকারের পক্ষে বিচারপতি এ.আর কর্নেলিয়াস, জেনারেল পীরজাদা ও কর্নেল হাসান অংশ নেন। ন্যাপ প্রধান মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী চট্টগ্রামে এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া অহেতুক ঢাকায় এসে সময় নষ্ট করছেন। ইয়াহিয়া খানের বোঝা উচিত শেখ মুজিবের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর ছাড়া পাকিস্তানকে রক্ষা করা সম্ভব নয়। তিনি আরও বলেন, জেনারেল ইয়াহিয়া খানের মনে রাখা উচিত যে, তিনি জনগণের প্রতিনিধি নন। সুতরাং জনগণের ওপর কর্তৃত্ব করার কোন অধিকার তার নেই। অন্যদিকে, পশ্চিম পাকিস্তানী নেতা জনাব মিয়া মমতাজ দৌলতানা, শওকত হায়াৎ খান ও মাওলানা মুফতি মাহমুদ এদিন ঢাকা আসেন। করাচীতে জাতীয় পরিষদের স্বতন্ত্র সদস্যসহ সংখ্যালঘিষ্ট দলসমূহের পার্লামেন্টারি পার্টির নেতারা এক বৈঠকে মিলিত হয়ে পশ্চিম পাকিস্তানে ভুট্টোবিরোধী একটি যুক্তফ্রন্ট গঠনের সিদ্ধান্ত নেন। পিপলস পার্টির চেয়ারম্যান জুলফিকার আলী ভুট্টো পশ্চিম পাকিস্তানে একটি গণআন্দোলন শুরুর লক্ষ্যে তার দলের প্রস্তুতি গ্রহণের কথা ঘোষণা করে সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ক্ষমতার বিষয়ে পিপলস পার্টিকে হিস্যা থেকে বঞ্চিত করার ষড়যন্ত্র করা হলে আমি চুপ করে বসে থাকব না। তিনি সাংবাদিকদের আরও বলেন, পূর্ব পাকিস্তানের লোকদের শক্তি দেখেছেন, এবার আপনারা পশ্চিম পাকিস্তানীদের শক্তি দেখতে পাবেন।