আমি যুগে যুগে আসি, আসিয়াছি… ॥ ১২২তম নজরুল জয়ন্তী আজ

25

কাজিরবাজার ডেস্ক :
‘মিথ্যা শুনিনি ভাই,/এই হৃদয়ের চেয়ে বড় কোন মন্দির-কাবা নাই।’ হ্যাঁ, এই তো নজরুল। এভাবে আর কে পারে বলতে? কবিতা গানসহ সৃষ্টিশীল নানা মাধ্যমে অসাম্প্রদায়িক চেতনা, প্রেম সাম্য ও মানবতার বাণী প্রচার করে গেছেন কবি। মানবিকতার কবি বিদ্রোহ ও বিপ্লবের কবি ‘ঝাঁকড়া চুলের বাবরি দোলানো মহান পুরুষের আজ জন্মদিন।
আজ ১১ জ্যৈষ্ঠ মঙ্গলবার ১২২তম নজরুল জয়ন্তী। ১৩০৬ বঙ্গাব্দের এই দিনে পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার আসানসোল মহকুমার চুরুলিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। কবির ভাষায়: আমি যুগে যুগে আসি, আসিয়াছি পুনঃ মহাবিপ্লব হেতু…।
প্রতি বছর নজরুল জয়ন্তী উপলক্ষে জাতীয় পর্যায়ে বিপুল কর্মসূচী গ্রহণ করা হলেও, এ বছর করোনাভাইরাস পরিস্থিতির কারণে বাসার বাইরে কোন আনুষ্ঠানিকতা থাকছে না।
তবে সকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় অবস্থিত কবির মাজারে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ করবেন কবির ভক্ত অনুরাগীরা। সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও সংগঠনের পক্ষ থেকে কবির প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করা হবে। এছাড়াও বাংলাদেশ টেলিভিশন, বাংলাদেশ বেতারসহ বেসরকারী বিভিন্ন টেলিভিশন ও রেডিও কবির জন্মদিন উপলক্ষে বিশেষ অনুষ্ঠানমালা প্রচার করবে।
দিবসটি উপলক্ষে বাণী দিয়েছেন রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
বর্ণাঢ্য জীবনের অধিকারী কাজী নজরুল ইসলাম অতি দরিদ্র পরিবারের সন্তান। পড়ালেখা শুরু করেন মক্তবে। কিন্তু বাবার মৃত্যুর পর দারিদ্র্যের কারণে তার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা বেশি দূর এগোয়নি। মাত্র ১০ বছর বয়সেই গোটা পরিবারের ভার কাঁধে নিতে হয় তাঁকে। জীবিকার প্রয়োজনে এমনকি রুটির দোকানে কাজ করেন। তরুণ বয়সে সেনা সদস্য হিসেবে যোগ দিয়েছেন যুদ্ধেও। সাংবাদিকতা পেশার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন তিনি। করেছেন রাজনীতিও।
সাহিত্য চর্চার শুরুটাও বালক বয়সে। লেটো দলে যোগ দিয়ে শুরু হয় তার সাহিত্যচর্চা। নজরুলের কবিতা, ছোটগল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ বাংলা সাহিত্যকে দিয়েছে বিপুল সমৃদ্ধি। কবি বিশেষ আলোড়ন তুলেন ‘বিদ্রোহী’ কবিতা লিখে। শোষকের বিরুদ্ধে নিজের অবস্থান পরিস্কার করে তিনি লিখেছিলেন, …আমি ত্রাস সঞ্চারি ভুবনে সহসা সঞ্চারি ভূমিকম্প।/ধরি বাসুকির ফণা জাপটি,/ধরি স্বর্গীয় দূত জিব্রাইলের আগুনের পাখা শাপটি!/আমি দেব-শিশু, আমি চঞ্চল,/আমি ধৃষ্ট, আমি দাঁত দিয়া ছিঁড়ি বিশ্বমায়ের অঞ্চল…। কাছাকাছি সময়ে রচিত তাঁর আরেকটি বিখ্যাত কবিতা ‘কামাল পাশা।’ এতে ভারতীয় মুসলিমদের খিলাফত আন্দোলনের অসারতা সম্বন্ধে তার দৃষ্টিভঙ্গি এবং সমকালীন আন্তর্জাতিক ইতিহাস-চেতনার পরিচয় পাওয়া যায়। ১৯২২ সালে প্রকাশিত হয় তার সাড়াজাগানো কবিতা সঙ্কলন ‘অগ্নিবীণা।’ কাব্যগ্রন্থটি বাংলা কাব্যের ভুবনে পালাবদল ঘটাতে সক্ষম হয়। প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে এর প্রথম সংস্করণ নিঃশেষ হয়ে যায়। পরে খুব দ্রুত আরও কয়েকটি নতুন সংস্করণ প্রকাশিত হয়। ‘বিদ্রোহী’, ‘কামাল পাশা’ ছাড়াও এই কাব্যগ্রন্থের ‘প্রলয়োল্লাাস’, ‘আগমনী’, ‘খেয়াপারের তরণী’, ‘শাত-ইল্-আরব’ কবিতাগুলো তুমুল হৈচৈ ফেলে দেয় সর্বত্র।
কাজী নজরুল ইসলাম গদ্য রচনার বেলায়ও ছিলেন স্বতন্ত্র চিন্তার। তার প্রথম গদ্য ‘বাউ-ুলের আত্মকাহিনী’ ১৯১৯ সালে সওগাত পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। সৈনিক জীবনে করাচী সেনানিবাসে বসে এটি রচনা করেন তিনি। এখান থেকে তার সাহিত্যিক জীবনের মূল সূচনা ঘটেছিল বলে ধারণা করা হয়। সেনানিবাসেই তিনি লিখেছেন ‘হেনা’, ‘ব্যথার দান’, ‘মেহের নেগার’ ও ‘ঘুমের ঘোরে’ গল্পগুলো। ১৯২২ সালে প্রকাশিত হয় নজরুলের গল্প সঙ্কলন ‘ব্যথার দান।’ একই বছর প্রকাশিত হয় প্রবন্ধ সঙ্কলন ‘যুগবাণী।’
তবে নজরুলের সৃষ্টির অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অংশ জুড়ে আছে সঙ্গীত। বৈচিত্র্যময় বাংলা গানের সবচেয়ে বড় ভা-ার রেখে গেছেন কবি। প্রায় সাড়ে ৩ হাজার গান রচনা করেন তিনি। সুর বৈচিত্র্যে ভরপুর এসব গান বাংলা সঙ্গীতকে অনন্য উচ্চতায় আসীন করেছে। তার সৃষ্ট রাগগুলোও দারুণ বিস্ময় জাগায়।
তবে জীবনের বড় অংশ জুড়ে ছিল নানা লাঞ্ছনা আর গঞ্জনা। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৪২ সালে অগ্রজ রবীন্দ্রনাথের ‘ট্র্যাজেডি’র আশঙ্কাকে সত্য প্রমাণ করেন। এ বছর চির বিদ্রোহী রণক্লান্ত নজরুল বাকশক্তি ও মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে শিশুর মতো হয়ে যান। এ অবস্থায় ১৯৭২ সালে রাজনীতির কবি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ভারত থেকে কাজী নজরুল ইসলামকে সপরিবারে বাংলাদেশে নিয়ে আসেন। নজরুলকে জাতীয় কবির মর্যাদা দেন। কবির জীবনের শেষ দিনগুলো কাটে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে (তৎকালীন পিজি হাসপাতাল)। দীর্ঘ রোগ ভোগের পর এখানেই ১৯৭৬ সালের ২৯ আগস্ট পৃথিবীকে চির বিদায় জানান তিনি। কবিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদের পাশে সমাহিত করা হয়।
রাষ্ট্রপতির বাণী ॥ নজরুল জয়ন্তী উপলক্ষে দেয়া বাণীতে রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ বলেছেন, কাজী নজরুল ইসলাম আমাদের অন্তহীন প্রেরণার উৎস। কবির ক্ষুরধার অগ্নিঝরা লেখনী শোষিত নির্যাতিত ও বঞ্চিতদের অধিকার আদায়ে সোচ্চার করে। শিক্ষা দেয় অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে। নতুন প্রজন্ম নজরুলের কর্ম চর্চার মাধ্যমে নিজেদের সমৃদ্ধ করতে সক্ষম হবে বলে আশা প্রকাশ করেন রাষ্ট্রপতি।
প্রধানমন্ত্রীর বাণী ॥ পৃথক বাণীতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, বাংলা সাহিত্যে কবি কাজী নজরুল ইসলাম এক অবস্মরণীয় নাম। তার শিকল ভাঙ্গার গানে জেগে উঠেছিল ঝিমিয়ে পড়া বাঙালি সমাজ। সাম্য, মানবতা, তারুণ্য ও দ্রোহের কবি তিনি। নজরুল অসাম্প্রদায়িক, বৈষম্যহীন ও শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠার যে স্বপ্ন দেখেছেন তা বাস্তবায়নের জন্য বর্তমান সরকার কাজ করছে বলেও বাণীতে উল্লেখ করেন প্রধানমন্ত্রী।
নজরুল জয়ন্তীর অনুষ্ঠানমালা ॥ করোনার বাধার মুখে জাতীয় পর্যায়ে নজরুল জয়ন্তী উদ্যাপনের সুযোগ তেমন নেই। কবির স্মৃতিবিজড়িত ত্রিশাল বা কুমিল্লায় এবার থাকছে না কোন কর্মসূচী। প্রতিবছর সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় ও অধীনস্থ প্রতিষ্ঠানগুলোর পক্ষ থেকে বিভিন্ন কর্মসূচী গ্রহণ করা হয়। এবার আর তা হচ্ছে না। তবে ভার্চুয়ালি বহুবিধ অনুষ্ঠানমালার আয়োজন করা হবে।
ছায়ানটে আজ অনলাইনে বিশেষ অনুষ্ঠানের আয়োজন করবে। অনুষ্ঠান থেকে নাচ গান কবিতায় প্রিয় কবিকে শ্রদ্ধা ভালবাসা জানাবেন প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক শিক্ষার্থীরা।
সত্যেন সে শিল্পীগোষ্ঠী সন্ধ্যা ৭টায় তাদের ফেসবুক পেজ থেকে লাইভ করবে। ‘চির উন্নত মম শির’ শীর্ষক আয়োজনে থাকবে নজরুলের কবিতা ও নৃত্যায়োজন।
আন্তর্জাতিক নজরুল চর্চাকেন্দ্র রাত সাড়ে ৮টায় প্রীতি সম্মিলনীর আয়োজন করবে। এতে জুমে যুক্ত হবেন সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ।
এদিকে, সৃষ্টি নামের একটি সংগঠন মঙ্গলবার থেকে তিন দিনব্যাপী অনুষ্ঠানমালা আয়োজন করেছে। তারও আগে সোমবার থেকে শুরু হয়েছে দুই দিনব্যাপী ‘আমিই নজরুল’ শীর্ষক আন্তর্জাতিক নজরুল উৎসব। ‘মুক্ত আসর’ আয়োজিত উৎসবে বাংলাদেশ ভারত যুক্তরাষ্ট্র যুক্তরাজ্য ও পর্তুগাল থেকে ৩২ জন নজরুল গবেষক, লেখক ও নজরুল সঙ্গীত শিল্পী অংশগ্রহণ করবেন বলে জানিয়েছেন আয়োজকরা।