কাজিরবাজার ডেস্ক :
অহিংস আন্দোলনের চতুর্থ দিনে সারা বাংলায় অফিস আদালতে পূর্ণ কর্মবিরতি চলে। রাজধানী ঢাকায় দিনব্যাপী সভা ও শোভাযাত্রা অনুষ্ঠিত হয়। সরকারী ও বেসরকারী ভবনের শীর্ষে এবং যানবাহনে কালো পতাকা ওড়ে। প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খান কড়া নিরাপত্তার মধ্যে করাচী থেকে ঢাকায় আসেন। বিমানবন্দরে সামরিক গভর্ণর লে. জেনারেল টিক্কা খান তাকে স্বাগত জানান। কোন সাংবাদিক ও বাঙালিকে এ সময় বিমানবন্দরে প্রবেশ করতে দেয়া হয়নি। কবি সুফিয়া কামালের সভাপতিত্বে তোপখানা রোডে মহিলাদের এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে বেতার ও টিভি শিল্পীবৃন্দ দেশাত্মবোধক গান পরিবেশন করেন। উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীর সদস্যরা ভ্রাম্যমান ট্রাকে গণসঙ্গীত, পথনাটক পরিবেশন করেন। নতুন সামরিক বিধি জারির প্রতিবাদে স্বাধীন বাংলা কেন্দ্রীয় ছাত্রসংগ্রাম পরিষদ বায়তুল মোকাররম প্রাঙ্গণে জনসভার আয়োজন করে। সভায় ছাত্র নেতৃবৃন্দ অবিলম্বে বাংলাদেশ থেকে সৈন্য প্রত্যাহারের জন্য প্রেসিডেন্টের প্রতি আহ্বান জানান। বাংলাদেশকে স্বাধীন ঘোষণা করেন। তারা বলেন, পূর্ব বাংলায় শেখ মুজিবই আইন জারি করবেন। পশ্চিম পাকিস্তানের শাসন এখানে চলবে না। পৃথিবীর কোন শক্তিই আমাদের স্বাধীনতাকে নস্যাৎ করতে পারবে না। খুলনার হাদিস পার্কের জনসভায় বাংলা জাতীয় লীগ প্রধান আতাউর রহমান খান বলেন, বাংলার প্রতিটি মানুষ আজ বঙ্গবন্ধুর পেছনে একতাবদ্ধ। তিনি বলেন, রেডিও, টিভি, ইপিআর, পুলিশবাহিনী, সেক্রেটারিয়েট প্রভৃতি আজ আওয়ামী লীগ প্রধানের আজ্ঞাবাহী। পিপলস পার্টির চেয়ারম্যান জুলফিকার আলী ভুট্টো করাচীতে এক সংবাদ সম্মেলনে নতুন দাবি উত্থাপন করে বলেন, কেন্দ্রে আওয়ামী লীগ ও পিপলস পার্টির সমন্বয়ে কোয়ালিশন সরকার গঠন করতে হবে। ভুট্টো করাচীতে সাংবাদিকদের বলেন, একটি কায়েমী স্বার্থবাদী মহল পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের ঐক্যে ফাটল ধরাতে চায়। তিনি আরও বলেন, দুই অংশের ভৌগোলিক দূরত্বের কারণে সংখ্যাগরিষ্ঠের শাসনের প্রশ্ন প্রযোজ্য হবে না। কেন্দ্রে ক্ষমতা দেশের দুই অংশের সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের কাছে এবং প্রদেশগুলোর ক্ষমতা সংশ্লিষ্ট প্রদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের কাছে হস্তান্তর করতে হবে। পিডিপি নেতা নুরুল আমীন ভুট্টোর প্রস্তাবকে অবাস্তব ও নৈরাশ্যজনক বলে অভিহিত করেন। পশ্চিম পাকিস্তানের বিভিন্ন রাজনৈতিক দল চলমান সঙ্কটের জন্য ভুট্টোকে দায়ী করেন। করাচীতে এক জনসভায় কয়েকজন প্রখ্যাত রাজনৈতিক নেতা বলেন, জনাব ভুট্টো পশ্চিম পাকিস্তানের পক্ষ থেকে অনেক কথাই বলেছেন। কিন্তু তিনি ভুলে গেছেন তার পিপলস পার্টি এই অঞ্চলে শতকরা আটত্রিশ ভাগ ভোটও পাননি। তারা বলেন, ক্ষমতা লাভ করার জন্য আওয়ামী লীগই একমাত্র দল। রাতে ঢাকায় প্রাদেশিক আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দীন আহমদ বিবৃতির মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু ঘোষিত অহিংস অসহযোগ আন্দোলনের ব্যাখ্যা করে বলেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের এই আহ্বানে জনগণের নিরঙ্কুশ সাড়া পাওয়া গেছে। বিবৃতিতে তিনি দীর্ঘস্থায়ী সংগ্রামের লক্ষ্যে ত্যাগ স্বীকার করতে জনগণকে প্রস্তুত হতে বলেন। তিনি ৩৫ দফা নির্দেশনা মেনে চলার দিকেও গুরুত্বারোপ করেন। আগের দিন বিভিন্ন স্থানে চেকপোস্ট বসানোর যে নির্দেশনা দিয়েছিল ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ তা আজ নানাবিধ অসুবিধার কারণে উঠিয়ে নেয়া হয়। পাক আর্মির গত কালকের ঘটনার নিন্দা জানায় চট্টগ্রাম সংগ্রাম পরিষদের নেতারা। সেই সঙ্গে বিহারী-বাঙালীদের ধৈর্য ধারণের আহ্বান করা হয়। জহুর আহমেদ চৌধুরী বলেন, ব্যারাকের বাসিন্দাদের ব্যারাকের মাঝেই থাকা দরকার। বিকেলে লালদীঘিতে এক জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। এই সভায় উপস্থিত ছিলেন- জহুর আহমেদ চৌধুরী, এম.এ. আজিজ, এম.এ. হান্নান, এম.এ. মান্নান, মৌলভী সৈয়দ আহমেদ, এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী, ইদ্রিস আলম, এম.আর. সিদ্দিকী, অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, সৈয়দ আলী আহসান, ড. আনিসুজ্জামান, আবুল ফজল, অধ্যাপক মমতাজ উদ্দিন। সভায় পাকিস্তানের সামরিক তৎপরতার কথা বলা হয়। সবাইকে প্রস্তুত থাকার আহ্বান জানানো হয়। সেদিন লাখ মানুষের ‘জয় বাংলা’ ধ্বনিতে মুখরিত হয় লালদীঘি ময়দান। সন্ধ্যায় ‘চট্টগ্রাম শিল্প-সাহিত্য পরিষদ’-এর শিল্পীরা মঞ্চস্থ করে অধ্যাপক মমতাজ উদ্দিন লিখিত নাটক ‘এবারের সংগ্রাম’। এদিন রাতে ঘটে মর্মান্তিক এক ঘটনা। হালিশহরের চুনা ফ্যাক্টরির মোড়ে কয়েকজন বিহারী জল্লাদ চকবাজারের উর্দুগলির ঘটনার প্রতিশোধ হিসেবে তিনজন বাঙালি যুবককে প্রকাশ্যে জবাই করে। চট্টগ্রামের মাটি রক্তাক্ত হলো মুক্তিকামী বাঙালিদের রক্তে।