ইতিহাস গড়া জয় ॥ বাংলাদেশের কাছে ওয়েস্ট ইন্ডিজ হারল ইনিংস ও ১৮৪ রানে

70

স্পোর্টস ডেস্ক :
এক দর্শক প্ল্যাকার্ড নিয়ে স্টেডিয়ামে এসেছেন। তাতে লেখা, ‘২০০৯-বাংলাওয়াশ, ২০১৮-স্পিনওয়াশ’। আসলেই তাই ঘটেছে। ২০০৯ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজের মাটিতে ওয়েস্ট ইন্ডিজকে হোয়াইটওয়াশ করেছে বাংলাদেশ। এবার দেশের মাটিতেও ক্যারিবীয়দের হোয়াইটওয়াশ করল টাইগাররা। স্পিন বিষে নীল হয়ে গেল তারা। মেহেদী হাসান মিরাজের স্পিন জাদুর মায়ার জালে আটকা পড়ল। বাঘের থাবায় এমনই কাত হলো মিরপুর টেস্টে আড়াইদিনেই ইনিংস ও ১৮৪ রানের বড় ব্যবধানে হেরে হোয়াইটওয়াশের বিস্মৃতি ওয়েস্ট ইন্ডিজ ইতিহাসে যুক্ত হলো। আর বাংলাদেশ প্রথমবারের মতো কোন দলকে ইনিংসে হারিয়ে গড়ল ইতিহাস। ইতিহাসের পাতায় নিজেদের নাম যুক্ত করল। ইনিংসে জেতা সব দলের সঙ্গে এখন থেকে বাংলাদেশের নামটিও যুক্ত হলো। সাকিব আল হাসানের নেতৃত্বে তা করে দেখাল বাংলাদেশ।
সেই ইতিহাস গড়া হলো স্পিনারদের জাদুময় বোলিংয়েই। বিশেষ করে মেহেদী হাসান মিরাজ এমন ছোবলই দিলেন, তাতে ওয়েস্ট ইন্ডিজ ব্যাটসম্যানরা তছনছ হয়ে গেলেন। বাংলাদেশকে খেলতে হলো মাত্র একটি ইনিংস। প্রথম ইনিংসে মাহমুদুল্লাহ রিয়াদের টেস্ট ক্যারিয়ারসেরা ১৩৬, সাকিব আল হাসানের ৮০, অভিষেক টেস্ট খেলতে নামা ওপেনার সাদমান ইসলামের ৭৬ রানে ৫০৮ রানের বিশাল স্কোর গড়ে বাংলাদেশ। তখনই বোঝা হয়ে যায় চট্টগ্রাম টেস্টে হারের পর মিরপুর টেস্টেও হার হচ্ছে ওয়েস্ট ইন্ডিজের। তাই হলো। মিরাজের (৭/৫৮) রেকর্ড গড়া নৈপুণ্যে প্রথম ইনিংসে ১১১ রানের বেশি করতে পারল না ওয়েস্ট ইন্ডিজ। ফলোঅনে পড়ল। দেশের হয়ে প্রথম ডানহাতি অফস্পিনার হিসেবে ৭ উইকেট নিয়ে রেকর্ড গড়লেন মিরাজ। তাতে ওয়েস্ট ইন্ডিজকে আবারও ব্যাটিংয়ে নামতে হলো। এবার দ্বিতীয় ইনিংসে ব্যাটিংয়ে নেমে ২১৩ রান করতে পারল সফরকারীরা। শিমরন হেটমায়ার (৯৩) যদি হাল না ধরতে পারতেন তাহলে আরও আগেই গুটিয়ে যেত ওয়েস্ট ইন্ডিজ। এবারও মিরাজই (৫/৫৯) তার স্পিন বিষ ছড়িয়ে দেন।
দুই ইনিংস মিলিয়ে ৩৬ ওভার বোলিং করে ৩ মেডেনসহ ১১৭ রান খরচায় ১২ উইকেট নেন মিরাজ। দেশের হয়ে এক টেস্টে সবচেয়ে কম রান দিয়ে সবচেয়ে বেশি উইকেট নেয়ায় সবার ওপরে উঠে যান মিরাজ। আর দেশের হয়ে কম ইনিংস (৩৩ ইনিংস) খেলে ৭ বার ইনিংসে ৫ উইকেট নেয়ার ক্ষেত্রেও মিরাজই আছেন শীর্ষে। কি দুর্দান্ত বোলিংই না করলেন তিনি। তাতে করে ম্যাচসেরাও হন।
দ্বিতীয়দিন ৫ উইকেটে যখন ৭৫ রান ছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজ স্কোরবোর্ডে তখনই ফলোঅন এড়াতে ২৩৪ রান লাগত। তা যে ওয়েস্ট ইন্ডিজ পারবে না তা দ্বিতীয়দিন শেষ হতেই বোঝা গিয়েছিল। বাংলাদেশের প্রথম ইনিংস শেষ হতেই উইকেট যেভাবে স্পিনবান্ধব হয়ে উঠেছিল তাতেই ওয়েস্ট ইন্ডিজ শিবিরে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছিল। আউটগুলোর ধরনও এমন ছিল যেন ব্যাটিং করতেই ভয় পাচ্ছিলেন ক্যারিবীয় ব্যাটসম্যানরা। তৃতীয়দিনের শুরুতেই তাই বাকি ৫ উইকেটও হারিয়ে ফেলল ওয়েস্ট ইন্ডিজ। তৃতীয়দিন প্রথম ইনিংসে মাত্র ৭৬ বল খেলতে পারল তারা। মিরাজ আর সাকিবই শুধু বোলিং করলেন। ইনিংসের সর্বোচ্চ স্কোরটা যখন ৩৯ (হেটমায়ারের) রান হয়, তখন ব্যাটসম্যানদের বেহাল দশা বোঝাই যায়। এদিনটিতে প্রথম ইনিংসে আর মাত্র ৩৬ রান স্কোরবোর্ডে যোগ করতে পারে ওয়েস্ট ইন্ডিজ।
একইদশা দ্বিতীয় ইনিংসেও বজায় থাকে। এ ইনিংসে হেটমায়ারই (৯৩) আবারও সর্বোচ্চ স্কোরটা করেন। একমাত্র তিনিই বাংলাদেশ স্পিনারদের সামনে প্রতিরোধ গড়তে পারেন। দুর্দান্ত ব্যাটিংও করেন। মারমুখী হয়েও খেলেন। সাত রানের জন্য সেঞ্চুরি করতে পারেননি। তবে ৯২ বল খেলে এই রান করতে গিয়ে ১টি চারের বিপরীতে ৯টি ছক্কা হাঁকান। মিরাজ আর বাংলাদেশ স্পিনারদের একতরফা দাপটের সামনে প্রাচীর হয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন। শেষ পর্যন্ত সেই মিরাজই তাকে ঠেকান। দুই ম্যাচের টেস্ট সিরিজের চার ইনিংসে মিরাজের বলেই প্রতিবার আউট হয়ে সাজঘরে ফেরেন হেটমায়ার। হেটমায়ার আউট হতেই বাংলাদেশেরও ইনিংসের সঙ্গে রানের দিক দিয়েও বড় ব্যবধানে জেতার আশা বেড়ে যায়। এবার ২০০ রানের বেশি স্কোরবোর্ডে জমা হলেও ইতিহাসসেরা জয় মিলে যায় বাংলাদেশের।
প্ল্যাকার্ড নিয়ে আসা দর্শক তৃতীয়দিনের খেলা শুরু হওয়ার আগে থেকেই স্টেডিয়ামে হাজির। দ্বিতীয়দিন শেষ হওয়ার পরই তার ভেতর আত্মবিশ্বাস জেগে গেছে, ওয়েস্ট ইন্ডিজ ইনিংস ব্যবধানেই হারতে যাচ্ছে; সেটি আবার তৃতীয়দিনেই হতে পারে। তাইতো তিনি সকাল থেকেই প্লেকার্ডটি নিয়ে হাজির। ওয়েস্ট ইন্ডিজও সেই দর্শকের মন ভাঙ্গল না। তৃতীয়দিন মাত্র দুই সেশনেই ১৫ উইকেট হারিয়ে টেস্ট সিরিজে হোয়াইটওয়াশ হয়ে সিরিজ শেষ করল ওয়েস্ট ইন্ডিজ। প্রথম ইনিংসে যে ৫ উইকেট ছিল তা ১৩ ওভারের মধ্যে এবং দ্বিতীয় ইনিংসের ১০ উইকেট ৬০ ওভারের মধ্যে শেষ হলো। দুই ইনিংস মিলিয়ে ৯৬ ওভার খেলতে পারল ওয়েস্ট ইন্ডিজ। কি বিপর্যস্ত অবস্থা হলো। এ বছর জুলাইয়ে নিজ মাটিতে পেস আক্রমণ দিয়ে কি দাপটই দেখিয়েছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজ। এবার নিজ মাটিতে স্পিন দিয়ে সেই দাপটের জবাবটা ভাল করেই দিল বাংলাদেশ।
এমনভাবেই জিতল বাংলাদেশ, ইতিহাসের পাতায় নিজেদের নাম অন্যরকমভাবেই যুক্ত করল। বাংলাদেশ এর আগে ১২টি টেস্ট জিতেছিল। কখনই ইনিংস ব্যবধানে জিততে পারেনি। রানের দিক দিয়ে বড় জয়টি ছিল ২২৬ রানের, ২০০৫ সালে জিম্বাবুইয়ের বিপক্ষে। উইকেটের দিক দিয়ে ২০০৯ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজকে ৪ উইকেটে হারানো জয়টিই ছিল বড় জয়। এবার ১৩তম টেস্ট জয়টি যখন আসলো সেটি বাংলাদেশ টেস্ট ইতিহাসের সবচেয়ে বড় জয় হলো। চট্টগ্রাম টেস্টে ৬৪ রানে জিতে সিরিজে ১-০ ব্যবধানে এগিয়ে যাওয়ার পর রবিবার মিরপুর টেস্ট ইনিংস ও ১৮৪ রানে জিতে ওয়েস্ট ইন্ডিজকে ধবলধোলাই করল বাংলাদেশ। ওয়েস্ট ইন্ডিজের ২০টি উইকেটই বাংলাদেশ স্পিনাররা তুলে নিল।
টেস্ট ইতিহাসে এবারই প্রথম শুধু স্পিনার নিয়ে দল সাজালো বাংলাদেশ। ইতিহাস গড়তে যে তা দরকার ছিল তা এত বড় জয়েই প্রমাণ মিলে। টেস্ট ক্রিকেট ইতিহাসে রবিবারের আগ পর্যন্ত বাংলাদেশ ছাড়া সব দলই ইনিংস ব্যবধানে জেতার সুখস্মৃতি পেয়েছে। এবার বাংলাদেশও প্রথমবারের মতো সেই স্বাদ পেল। শুধু স্বাদই নিল না, প্রতিশোধও নিল। এ বছর জুলাইয়ে ওয়েস্ট ইন্ডিজে গিয়ে হোয়াইটওয়াশ হয় বাংলাদেশ। এবার দেশের মাটিতে পাল্টা জবাব দিল বাংলাদেশ।
ওয়েস্ট ইন্ডিজকে হোয়াইটওয়াশ করে তৃতীয়বারের মতো সিরিজের প্রতিটি ম্যাচ জেতার স্বাদ পেল বাংলাদেশ। চতুর্থবার সিরিজও জিতে নিল। জিম্বাবুইয়ের বিপক্ষে দুইবার (২০০৫ ও ২০১৪ সালে) এবং ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে দুইবার (২০০৯ ও ২০১৮ সালে) সিরিজ জিতল বাংলাদেশ। এর মধ্যে ওয়েস্ট ইন্ডিজকে দুইবার হোয়াইওয়াশ করল। জিম্বাবুইয়ে (৬ বার জয়) ছাড়া বড় কোন শক্তিশালী দলের মধ্যে শ্রীলঙ্কা, ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়াকে একবার করে টেস্টে হারানোর সঙ্গে ওয়েস্ট ইন্ডিজকে চারবার টেস্টে হারালো বাংলাদেশ। দেশের মাটিতে তৃতীয়বারের মতো টেস্ট সিরিজ জিতল বাংলাদেশ। জিম্বাবুইয়ের পর দ্বিতীয়বারের মতো কোন দলকে হোয়াইটওয়াশ করল বাংলাদেশ।
সাকিবের নেতৃত্বে এমন মধুর স্মৃতি মিলল। দেশের বাইরে বাংলাদেশ প্রথমবার টেস্ট সিরিজ জিতেছিল ২০০৯ সালে। ওয়েস্ট ইন্ডিজের মাটিতে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষেই। সেবার প্রথম টেস্টের শুরুতেই মাশরাফি বিন মর্তুজা ইনজুরিতে পড়াতে সাকিবই নেতৃত্ব দেন। দুই টেস্টেই নেতৃত্ব দিয়ে ওয়েস্ট ইন্ডিজকে হোয়াইটওয়াশ করেন। এবার ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে যখন দেশের মাটিতেও টেস্ট সিরিজ জিতল বাংলাদেশ, হোয়াইটওয়াশ করল; তখনও নেতৃত্বে থাকেন সাকিবই। কি ভাগ্য সাকিবের। নিজে সামনে থেকেই নেতৃত্ব দেন। আঙ্গুলের চোট সেরেই মাঠে নেমে পড়েন। নেমেই দুই টেস্টের তিন ইনিংসে ৩৮.৩৩ গড়ে ১১৫ রান করেন। বল হাতে নেন ৯ উইকেট। তাতেই অলরাউন্ড নৈপুণ্য দেখিয়ে সিরিজসেরা হন সাকিব। সাকিবের অলরাউন্ড নৈপুণ্যের সঙ্গে মিরাজের ঘূর্ণি জাদুতেই কাত হলো ওয়েস্ট ইন্ডিজ। তাতে বাংলাদেশ ইতিহাসও গড়লো।