একুশ মানে মাথা নত না করা। কথাটির যথার্থতা বার বার প্রমাণিত হয়েছে বাংলাদেশে। একুশ শিখিয়েছে অন্যায়, অবিচার ও অধিকারহীনতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদী, প্রতিরোধী হতে। প্রতিরোধের আগুন জ্বলে দ্বিগুণ দারুণ… আনে মুক্তি, আলো আনে শত প্রাণে। বায়ান্নর সেই ঐতিহাসিক একুশে ফেব্রুয়ারি ৬৬ বছর পেরিয়ে ৬৭ বছরে পদার্পণ করেছে। অমর একুশের চেতনা আজও অমলিন। সেদিন মৃত্যুঞ্জয়ী বাংলার তরুণরা মাতৃভাষার জন্য বুকের তাজা রক্ত দিয়ে স্বাজাত্যবোধের যে মশাল প্রজ্বলিত করেছিলেন, সেই আলো দেশের সীমানা অতিক্রম করে ছড়িয়ে পড়েছে আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে। বর্তমানে এই দিনটি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালন করা হচ্ছে বিশ্বের সর্বত্র।
মাতৃভাষার জন্য আত্মদানের এমন নজির বিশ্বে আর নেই। রাষ্ট্র, সমাজ ও ব্যক্তি জীবনে একুশের প্রভাব এতটাই সর্বব্যাপী যে, ভাষা শহীদদের আত্মত্যাগ বৃথা যায়নি। আত্মপরিচয় বিস্মৃত জাতিকে স্বরূপের সন্ধান দিয়েছে মহান একুশ। জাতি হিসেবে একতাবদ্ধ করেছে যেমন, তেমনি জুগিয়েছে অপরিমেয় শক্তি ও সাহস। অদম্য আত্মবিশ্বাসে করেছে বলীয়ান। একুশ বাঙালীর আবহমানকালের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির বিভিন্ন রতœভান্ডারের সঙ্গে যুক্ত করেছে বাঙালী জাতিকে। দিয়েছে সঠিক পথের সন্ধান। একুশের পথ ধরে তাই গণঅভ্যুত্থান পেরিয়ে স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধে বাঙালী পেয়েছে স্বাধীন সার্বভৌম ভাষাভিত্তিক এক দেশ। বাঙালী ও বাংলাদেশ যতদিন থাকবে ধরার বুকে, ততদিন থাকবে অমলিন বাংলা ভাষা ও অমর একুশে। কারণ একুশের শিকড় প্রোথিত বাঙালীর চেতনার গভীরে। একুশ বাঙালীকে অন্যায়, অবিচার ও অধিকারহীনতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে শিখিয়েছে। তাই এ দেশের মানুষ কখনই সামরিক ও স্বৈরশাসনের কাছে মাথা নত করেনি। আপোস করেনি গণতন্ত্র ও মৌলিক অধিকারের প্রশ্নে। আর এসব কিছুরই প্রেরণা হয়ে আছে মহান একুশে। বাঙালীর জীবন জুড়ে একুশ ভালবাসার অনন্য প্রতীক হয়ে আছে। সে ভালবাসা শুধু মাতৃভাষা বাংলার প্রতি প্রীতিতেই সীমাবদ্ধ নয়। বরং বাঙালীর ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি হতে শুরু করে যা কিছু মহৎ ও মানবিক, সর্বত্রই সুবিস্তৃত তার মমতাময়ী আলো। উনিশ শ’ বায়ান্ন সালের ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’ আলোকের ঝর্ণাধারা হয়ে ধুইয়ে দেয় সব কালিমা। কিন্তু সেই ভাষাকে ভালবেসে বাংলা ভাষা পুরোপুরি প্রচলন করা যায়নি এখনও। যেহেতু বাংলা ভাষার তেমন আর্থিক মূল্য দাঁড়াচ্ছে না, তাই বিশ্বসভায় এর অবস্থান পোক্ত হয়ে উঠতে পারছে না। উচ্চ আদালতসহ দাফতরিক কাজে স্বাধীনতার পর বাংলা চালু হলেও পঁচাত্তর পরবর্তী সামরিক জান্তা শাসকের সময়ে বাংলা ভাষা সঙ্কুচিত হতে থাকে। সরকার বাংলাকে জাতিসংঘের দাফতরিক ভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠার দাবি তুললেও এ খাতে ব্যাপক অর্থ সংস্থানের অভাবে তা সম্ভব হচ্ছে না। যেমন সম্ভব হয়নি উচ্চশিক্ষার প্রতিটি স্তরে বাংলা ভাষাকে অপরিহার্য ও আবশ্যিক করে তোলা। তথাপি একুশ আসে বাঙালীর প্রাণের আবাহনে, সাহসের বরাভয়ে প্রতিবছর। প্রতিবারই একুশ আসে নিত্যনতুন চেতনা নিয়ে, আসে শপথ নিয়ে। সেই অগ্নি শপথ ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার আবাহনে এবং সন্ত্রাস ও জঙ্গীবাদের বিপক্ষে দাঁড়ানোর। একুশ শক্তি ও সাহস জোগায় প্রতিবারই বাঙালীর চিত্তজুড়ে। একুশে ফেব্রুয়ারি বাঙালীকে একাত্তরের মতো প্রতিবাদী প্রতিরোধী সাহসে শত্রুকে প্রতিহত করার প্রেরণা জোগায়। একুশ মৌলবাদ, জঙ্গীবাদ, সন্ত্রাসবাদ, দুর্নীতি, নাশকতা, নৃশংসতা ও মাদকের বিরুদ্ধে আপোসহীন লড়াইয়ের প্রেরণা হয়ে এসেছে। বাঙালী এই দিনে আবার জেগে ওঠে বাঙালী জাতীয়তাবাদের মন্ত্রে। গণতন্ত্র ও উন্নয়নকে সুসংহত করার সুদূর অঙ্গীকারে।