চলে গেলেন কবি আল মাহমুদ

60

চলে গেলেন সোনালী কাবিনের কবি আল মাহমুদ। রাজধানীর একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শুক্রবার রাতে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। এক সপ্তাহ আগে গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় হাসপাতালে নেওয়া হয়েছিল তাঁকে। প্রথমে সিসিইউ, পরে আইসিইউতে রেখে চিকিৎসা দেওয়া হয় তাঁকে। শুক্রবার রাতে নেওয়া হয়েছিল লাইফ সাপোর্টে। এর কিছুক্ষণ পরই লোকান্তরিত হন ‘লোক লোকান্তর’-এর কবি, যিনি লিখেছেন ‘আত্মবিক্রয়ের স্বর্ণ কোনোকালে সঞ্চয় করিনি/আহত বিক্ষত করে চারদিকে চতুর ভ্রুকুটি;/ভালোবাসা দাও যদি আমি দেব আমার চুম্বন,/ছলনা জানি না বলে আর কোনো ব্যবসা শিখিনি;…। সোনালী কাবিন কাব্যের প্রথম সনেটেই তাঁর সগর্ব উচ্চারণ, ‘…পরাজিত হয় না কবিরা…।’ এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, ‘সারা জীবনই আমার কেটেছে সংগ্রামের মধ্য দিয়ে, লড়াই করতে হয়েছে বাঁচার জন্য। এখনো লড়াই করেই বেঁচে আছি।’
মফস্বল থেকে ঢাকায় এসেছিলেন কবিতা চর্চার জন্য। কবিতা তাঁকে খ্যাতি দিয়েছে। আধুনিক বাংলা কবিতার ত্রিশ দশকীয় ভাবধারায় ভাটি বাংলার জনজীবন, গ্রামীণ দৃশ্যপট, নদীনির্ভর জনপদ, চরাঞ্চলের কর্মমুখর জীবনচাঞ্চল্য ও নর-নারীর চিরন্তন প্রেম-বিরহের বিষয়কে অবলম্বন করে আধুনিক বাংলা ভাষার প্রচলিত কাঠামোয় অত্যন্ত স্বাভাবিক স্বতঃস্ফূর্ততায় আঞ্চলিক শব্দের সুন্দর প্রয়োগে কাব্যরসিকদের মধ্যে নতুন পুলক সৃষ্টি করেন। কবি আল মাহমুদ বিশ্বাস করতেন, ‘কবিতা হচ্ছে মানুষের স্বপ্ন। স্বপ্নের ভেতরে কিছুটা পরিভ্রমণ। বাস্তবতার সঙ্গে এই স্বপ্নের সম্পর্কটা হতে পারে বাস্তবতায় পা রেখে স্বপ্নের ভেতর উড়াল দেওয়ার মতো। কবির প্রকৃত কাজ হলো মানুষকে, তাঁর জাতিকে স্বপ্ন দেখানো।’ তিনি সেই স্বপ্নটা সব সময় দেখাতে চেষ্টা করেছেন বলেও উল্লেখ করেছেন এক সাক্ষাৎকারে। লোক লোকান্তর, কালের কলস, সোনালী কাবিন, মায়াবী পর্দা দুলে ওঠো ইত্যাদি তাঁর উল্লেখযোগ্য কবিতার বই। প্রথম উপন্যাস কবি ও কোলাহল।
বাংলা সাহিত্যের অন্যতম প্রধান এই কবি বাংলা কবিতাকে নতুন আঙ্গিকে, চেতনায় ও বাক্ভঙ্গিতে বিশেষভাবে সমৃদ্ধ করেছেন। টানা ছয় দশকের সাহিত্যচর্চায় তিনি নিজস্ব একটি পাঠকগোষ্ঠীও সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছিলেন। আলোড়ন সৃষ্টি করতে পেরেছিলেন মানুষের মধ্যে। তিনি বলেছেন, ‘আমি মনে করি সাহিত্য হচ্ছে মানুষের জন্য। সাহিত্য ব্যক্তিজীবনের জন্য স্বপ্ন। আমি সব সময় জীবন, মানুষ ও স্বদেশকে প্রাধান্য দিয়ে এসেছি। আমি কল্যাণ চাই। চাই সুন্দর-স্বপ্নময় স্বদেশ।’ তাঁর দার্ঢ্য উচ্চারণ, ‘কবি কিছু করতে চান। সমাজ তিনি বদলাতে চান, সামগ্রিক পরিস্থিতি বদলাতে চান।’ এই পরিবর্তনের স্বপ্ন দেখেছেন তিনি আমৃত্যু। কৈশোরোত্তীর্ণকালেই দীক্ষা নিয়েছিলেন সাম্যবাদের। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছিলেন। সাংবাদিকতা পেশায় ছিলেন। সরকারি কর্মকর্তা হিসেবেও তিনি দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। সাহিত্যকীর্তির জন্য বাংলা একাডেমি পুরস্কারসহ অসংখ্য পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। তাঁর মৃত্যু বাংলা সাহিত্যের জন্য এক অপূরণীয় ক্ষতি। কবি আল মাহমুদ বেঁচে থাকবেন অগণিত ভক্ত-পাঠকের হৃদয়ে।