মানবজীবনে কোরআন-হাদীস

82

॥ মুহাম্মদ মনজুর হোসেন খান ॥

(পূর্ব প্রকাশের পর)
কুরআনুল করীমে বলা হয়েছে যে, “কেউ কোন সৎ কাজ করলে সে তার দশগুণ পাবে এবং কেউ কোন অসৎ কাজকরলে তাকে শুধু তারই প্রতিফল দেওয়া হবে, আর তাদের প্রতি জুলুম করা হবে না” (৬ ঃ ১৬০)। অর্থাৎ একটি ভাল কাজের জন্য আল্লাহ দশগুণ প্রতিদান দিয়ে থাকেন। রাসূল করীম (সা.)-এর একটি হাদীসের রহস্য উদঘাটিত হয়েছে এ ঘোষণার মধ্য দিয়ে। রাসূল (সা.) বলেছেন যে, যে রমজান মাসে এবং পরবর্তী শাওয়াল মাসে আরও ছয়টি সিয়াম পালন করবে সে যেন গোটা বছরের জন্য সিয়াম পালন করল। ইসলামের দৃষ্টিতে ৩৫৫ দিনে একটি চন্দ্র বছর পূর্ণ হয়। এবং মাস গণনা করা হয় ২৯ অথবা ৩০ দিনে। সুতরাং একজন মু’মিন মুসলিম রমজান মাসের অতিরিক্ত আরো ছয়টি রোজা রাখলে মূলত সে বছরে ৩৫ অথবা ৩৬ দিন সিয়াম পালন করে এবং প্রতিদিনের জন্য দশগুণ হিসাবে সে ৩৫০ দিন অথবা ৩৬০ দিনের সওয়াব পেয়ে যায়।
সূফীয়ায়ে কিরাম লক্ষ্য করেছেন যে, মানব মনের মধ্যে পশু স্বভাবও রয়েছে। এ স্বভাব মানুষের আত্মিক উন্নতির পথে বাঁধার সৃষ্টি করে। দেহকে আত্মার নিয়ন্ত্রণে আনতে হলে দৈহিক প্রেরণাকে সংযত করতে হয়। সমৃদ্ধ করতে হয় আত্মিক শক্তিকে। লক্ষ্য করা গেছেযে, দৈহিক প্রেরণাকে সংযত করতে হলে একদিকে ক্ষুধা-তৃষ্ণার কষ্ট সহ্য ও বিপুল তাড়নাকে পরিহার করতে হয়। অপর দিকে জিহ্বা ও মনের চাহিদা এবং অন্যান্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে নিয়ন্ত্রণ করা জরুরী। এভাবে দৈহিক প্রেরণাকে যত সফলভাবে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব, অন্য কোনভাবে তা সম্ভব নয়। মানুষ যখন তার পশু স্বভাবেরউপর আত্মিক ও বিবেকের প্রভুত্ব প্রতিষ্ঠা করতে পারে তখনই সে পূর্ণতার দিকে এগিয়ে যায়। পশু স্বভাব কখনো মাথাচাড়া দিয়ে উঠলেও আত্মসংযমের মাধ্যমে তাকে নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রাখা যায়। সে কারণেই সিয়ামের মতো। কঠোর সংযম সাধনার মাধ্যমে সে পশু স্বভাবকে নিয়ন্ত্রণের মধ্যে আনার চেষ্টা করে।
কেউ যদি কোন অন্যায় বা পাপকর্ম করে ফেলে তা হলেও সে সিয়াম পালন করে অনুশোচনা করবে ও অনুতপ্ত হবে। সে তার রিপুকে দমন করতে সচেষ্ট হবে। এভাবেই সে প্রশান্তি পাবে। পরিশুদ্ধ হবে তার অন্তর। এমন কি এক পর্যায়ে তার ইচ্ছাশক্তি তার নিয়ন্ত্রণে এসে যাবে। তখন সে পুনর্বার অন্যায় অপকর্ম করা থেকে বিরত থাকবে। পূর্বে আরো বলা হয়েছে যে, ফেরেশতাদের পানাহার করতে হয় না। এটা তাদের বৈশিষ্ট্য। সিয়ামের মাধ্যমে পানাহারকে সংযত করে মানুষ ক্রমান্বয়ে ফেরেশতাদের বৈশিষ্ট্যকেই গ্রহণ করে। বস্তুতপক্ষে সমস্ত কাজ-কর্মের মধ্য দিয়ে মানুষ মূলত আল্লাহর আদেশ-নির্দেশগুলোকে মেনে চলার চেষ্টা করে। এক সময় তাতে সে সফলও হয়। তখন যে আল্লাহর সন্তুষ্টিও অর্জন করে। এভাবেই সে এগিয়ে যায় আল্লাহর সান্নিধ্যে এবং এটাই হল মানুষের পরম লক্ষ্য।
হজ্বের শাব্দিক অর্থ সংকল্প করা। এর আরেকটি অর্থ কোন কিছুর উপর আধিপত্য স্থাপনের চেষ্টা করা। প্রচলিত অর্থে হজ্ব বলতে কা’বা ঘর তওয়াফ, সাফা-মারওয়া সাঈ, আরাফাত-মুযদালিফা ও মিনায় অবস্থান করাকে বুঝায়। বস্তুতপক্ষে হজ্বের অর্থ আরো ব্যাপক ও বিস্তীর্ণ। মুসলমানদের ধর্মীয় দায়িত্বাবলীর মধ্যে হজ্বের স্থান তৃতীয়। পূর্ণবয়স্ক ও সামর্থ্যবান প্রতিটি মু’মিন মুসলমানের জন্য হজ্ব ফরজ। নারী-পুরুষ নির্বিশেষে প্রত্যেককেই তার জীবদ্দশায় একবার মক্কায় যেতে হয়। হজ্ব পালনের মধ্যে দিয়েই সে নিজের অহংবোধক নির্মূল করার জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালায়। নিজের সত্তাকে একাকার করে ফেলে আল্লাহর ইচ্ছার সঙ্গে। আর যাদের হজ্বে যাওয়ার মতো আর্থিক সঙ্গতি নেই তারা এ দায়িত্ব থেকে মুক্ত। কিন্তু এমন কোন মুসলমান কি আছে যে, আল্লাহর ঘর কা’বায় হাজির হবার সামর্থ্য লাভের আশায় অল্প অল্প করে প্রয়োজনীয় অর্থ জোগাড় না করবে?
কুরআন মজীদে ইরশাদ হয়েছে : মানব জাতির জন্য সর্বপ্রথম যে গৃহ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল তাতো বাক্কায় (মক্কায়), তা বরকতময় ও বিশ্বজগতের দিশারী (৩ ঃ ৯৬)। হযরত আদম (আ.) প্রথমে যে ঘর নির্মাণ করেছিলেন, পরবর্তীতে হযরত ইবরাহীম (আ.) কেবলমাত্র তা পুননির্মাণ করেন। কেউ যদি কেবলমাত্র ইবরাহীম (আ.)-এর সময়কালকে হিসাবে আনে, তাহলেও কা’বাই হবে সবচেয়ে পুরানো ঘর। হযরত সুলায়মান (আ.) নির্মিত জেরুজালেমের ইবাদতগাহর চেয়েও কা’বা অধিক পুরাতন। কা’বা ঘরের চেয়ে পুরান কোন ইবাদতখানা দ্বিতীয়টি আর নেই। (অসমাপ্ত)