অধ্যাপক হাসান আবদুল কাইয়ূম
কুরআন মজিদ আল্লাহ জাল্লা শানুহুর কালাম। এই কালাম চিরন্তন, শাশ্বত এবং পবিত্রতম। কুরআন মজিদকে যারা অসম্মান করে তারা পশুর চেয়েও নিকৃষ্ট। কুরআন মজিদ সম্পর্কে আল্লাহ জাল্লা শানুহু ইরশাদ করেন : ইন্নাহু লা কুরআনুন কারিম, ফী কিতাবিম মাক্নুন, লা ইয়ামাস্সুহু ইল্লাল মুতাহহারুন্ তানযীলুম মির রব্বিল ‘আলামীন- নিশ্চয়ই এ সম্মানিত কুরআন, যা আছে সুরক্ষিত কিতাবে, যারা পুতপবিত্র তারা ব্যতীত অন্য কেউ তা স্পর্শ করে না, এ নাযিল হয়েছে রব্বুল ‘আলামীনের নিকট হতে (সূরা ওয়াকিয়া : আয়াত ৭৭-৮০)।
কুরআন মজিদ নাযিলের সূচনা হয় ৬১০ খ্রিস্টাব্দের রমাদান মাসে, আর শেষ হয় ৬৩২ খ্রিস্টাব্দে। সর্বপ্রথম যে কয়খানি আয়াতে কারিমা নাযিল হয় তার মধ্যে পাঠ করার তাকিদ, সৃষ্টিজগতের স্রষ্টার পরিচয়, মানব সৃষ্টি, লেখাপড়া, বিদ্যা অর্জন প্রভৃতি বিষয় রয়েছে। প্রথম নাযিলকৃত আয়াতে কারিমাগুলো হচ্ছে : ইক্রা বি ইস্মি রব্বিকাল্লাযী খালাক, খালাকাল, ইনসানা মিন ‘আলাক-ইক্রা ওয়া রব্বুকাল্ আক্রামাল্লাযী ‘আল্লামা বিল্ কালাম-‘আল্লামাল ইনসানা মালাম ইয়া’লাম- পাঠ কর তোমার রব্-এর নামে, যিনি সৃষ্টি করেছেন, সৃষ্টি করেছেন মানুষকে ‘আলাক হতে, পাঠ কর, আর তোমার রব্ মহামহিমান্বিত, যিনি কলমের সাহায্যে শিক্ষা দিয়েছেন, শিক্ষা দিয়েছেন মানুষকে যা সে জানত না। (সূরা ‘আলাক : আয়াত (১-৫)।
কুরআন মজিদে জ্ঞানরাজ্যের তাবত বিষয় রয়েছে। বিজ্ঞান আজ পর্যন্ত যা কিছু আবিষ্কার করেছে তার সব কিছুই কুরআন বহু পূর্বেই রয়েছে, আগামীতে যা কিছু হয়ত আবিষ্কৃত হবে তাও কুরআন মজিদে বিধৃত আছে। মরিস বুকাইলি তাঁর রচিত বাইবেল কুরআন এ্যান্ড সায়েন্স গ্রন্থে বৈজ্ঞানিক যুক্তি দিয়ে কুরআনের শ্রেষ্ঠত্ব উপস্থাপন করেছেন। উক্ত গ্রন্থের উপসংহারে তিনি বলেছেন : কুরআন সর্বশেষ আসমানী কিতাব, যা নাযিল হয় তওরাত, যবুর ও ইঞ্জিল (বাইবেল)-এর পরে। কুরআনের আয়াতসমূহে স্ববিরোধিতা নেই, কোনরূপ বৈপরীত্যও নেই। কিছু ধর্মগ্রন্থের বাণীসমূহে মানুষের হস্তক্ষেপের অসংখ্য দৃষ্টান্ত রয়েছে, কিন্তু কুরআন তা থেকে একেবারে মুক্ত। নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে কুরআন সর্বতোভাবে নির্ভুল এবং এক অনন্য কিতাব। এ ছাড়াও কুরআন মজিদে এমন সব আয়াত ও বাণী রয়েছে, যা আধুনিক বিজ্ঞানের সঙ্গে সম্পৃক্ত। …কুরআন এমন কিছু আয়াতে কারিমা রয়েছে যার অর্থ কিংবা ব্যাখ্যা করা আগে আদৌও সম্ভব হয়নি। আধুনিককালে এসে বিজ্ঞানের চরম উৎকর্ষের ফলে গবেষণা, আবিষ্কার ও তথ্যগত জ্ঞানের আলোকে সে সব আয়াতের অর্থ, ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ করা সম্ভব হচ্ছে।
কুরআন মজিদ এমন এক গ্রন্থ, যা কোটি কোটি হাফিজ হিফ্জ হিফ্জ করেছে এবং এই ধারা সেই প্রথমকাল হতেই চালু হয়ে আসছে। যে কারণে এই মহাগ্রন্থের কোনরূপ হেরফের হয়নি বা কোন কালেও হবে না। এই কিতাব যতবার তিলাওয়াত করা হয় ততবারই নিত্যনতুন প্রতীয়মান হয়, হৃদয় অনুভব পবিত্রতার ছোঁয়া গভীর থেকে গভীরতর হয়ে ওঠে। এই গ্রন্থে হিফাজতের দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন আল্লাহ্ জাল্লা শানুহু নিজেই। ইরশাদ হয়েছে : ইন্না নাহুনু নায্যালনাযযিকরা ওয়া ইন্না লাহু লাহাফিযুনÑ আমিই কুরআন নাযিল করেছি এবং আমি এর সংরক্ষক। (সূরা হিজর : আয়াত ৯)।
হযরত আলী রাদি আল্লাহু তা’আলা আন্হু বলেন : শোন! আমি হযরত রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলায়হি ওয়া সাল্লামকে বলতে শুনেছি যে, হুঁশিয়ার হও! শীঘ্রই একটা বড় ফিতœা মাথাচাড়া দিয়ে উঠবে। আমি আরজ করলাম, সে ফিতœা থেকে মুক্তি পাওয়ার উপায় কি হবে? তিনি বললেন : আল্লাহুর কিতাব! এই কিতাবে তোমাদের পূর্ববর্তীদের অবস্থার বর্ণনা আছে এবং তোমাদের পরবর্তীতে যা কিছু ঘটবে তারও ভবিষ্যদ্বাণী রয়েছে। এতে তোমাদের পরস্পরের বিষয়সমূহের মীমাংসাও রয়েছে। এই কিতাবই চূড়ান্ত ফয়সালা। যে ব্যক্তি এই কিতাবকে অবজ্ঞা করবে আল্লাহ্ তাকে ধ্বংস করবেন। (তিরমিযী শরীফ)।
কুরআন মজিদ পৃথিবীর মানুষকে সত্য ও অসত্যের মধ্যে, ন্যায় ও অন্যায়ের মধ্যে পার্থক্য নির্ণয় করে দেয় এবং সৎপথের দিশা দেয়। এ এমন এক মহাগ্রন্থ, যা যুগের সমগ্র চাহিদাকে মেটাতে সক্ষম এবং সমগ্র মানব জাতির জন্য পথপ্রদর্শক। কুরআন মজিদে ইরশাদ হয়েছে : হাজা বালাগুল লিন্ নাসি ওয়া লি ইউন্যারু বিহি-এ মানুষের জন্য এক বার্তা, যাতে এর দ্বারা ওরা সতর্ক হয়। (সূরা ইব্রাহীম : আয়াত ৫২)। আল্লাহ্ জাল্লা শানুহু ইরশাদ করেন : ওয়া লাকাদ র্সরাফনা ফী হাযাল কুরআনি লি ইয়ায্যাক্কারু- আর আমি অবশ্যই এই কুরআনে বহু বিষয় বার বার বিবৃত করেছি যাতে ওরা ্উপদেশ গ্রহণ করে। (সূরা বনী ইসরাইল : আয়াত ৪১), ওয়া লাকাদ ইয়াস্সারনাল কুরআন লিযযিক্র-কুরআন আমি সহজ করে দিয়েছি উপদেশ গ্রহণের জন্য। (সূরা কামার : আয়াত ২২), ইন্ হুয়া ইল্লা যিক্রুল্ লিল্ আলামীনÑ এটা তো বিশ্বজগতের জন্য উপদেশ। (সূরা তাকবীর : আয়াত ২৭)।
কুরআন মজিদের মাধ্যমে মানুষ মনুষ্যত্বের পূর্ণ বৈশিষ্ট্য লাভ করতে পারে, যা অন্য কোন কিতাব দ্বারা সম্ভব নয়। এতে রয়েছে ন্যায়, ইন্সাফ ও আদল প্রতিষ্ঠার সত্যিকার দিকনির্দেশনা এবং কার্যকর বিধি-বিধান। এতে রয়েছে তাবত অন্যায়-অবিচার থেকে মুক্ত করে একটি সুন্দর পৃথিবী গড়ার সুষ্পষ্ট পথ ও পাথেয়। ইরশাদ হয়েছে : ইন্নাহু লা কাউলু ফাস্্লুন- নিশ্চয়ই এতে রয়েছে ফয়সালার বাণী। (সূরা তারিক : আয়াত ১৩)।
কুরআন মজিদ এমন এক অনন্য কিতাব যা তিলাওয়াত করলে অশেষ সওয়াব লাভ করা যায় এবং হিফ্জ বা মুখস্থ করলে অন্তরের কলুষতা দূরীভূত হয়ে একজন পরিচ্ছন্ন মানুষ হওয়া যায়, সেই সঙ্গে প্রকৃত জ্ঞানের অধিকারী হওয়া যায়। হযরত ‘আলী রাদি আল্লাহ তা’আলা আন্হু থেকে বর্ণিত আছে যে, হযরত রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলায়হি ওয়া সাল্লাম বলেছেন : মান্ কারা আল কুরআন ফাস্তাজহারাহু ফা হাল্লা হালালাহু ওয়া র্হারামা হারামাহু আদ্খালাহুল জান্নাতা ওয়া শাফ্্ফা’আহু আশরিন্ মিন্ আহলি বায়তিহীন কুল্লুহুম কাদ্ ওয়াজাবাত লাহুন্নারÑ যে কুরআন পাঠ করে ও মুখস্থ করে, এতে যে সমস্ত হালালের উল্লেখ রয়েছে সেগুলোকে হালাল জানে এবং যে সমস্ত হারামের উল্লেখ রয়েছে সেগুলোকে হারাম জানে সে জান্নাতে দাখিল হবে এবং জাহান্নাম অবধারিত ছিল তার পরিবার-পরিজনের মধ্যে এমন দশ ব্যক্তির জন্য সে সুপারিশ করলে আল্লাহ্ তা কবুল করবেন (তিরমিযী শরীফ, আহমদ)। হযরত উসমান রাদি আল্লাহু তা’আলা আন্হু থেকে বর্ণিত আছে যে, হযরত রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলায়হি ওয়া সাল্লাম বলেছেন : খায়রুকুম মান্ তা’আল্লামাল্্ কুরআন ওয়া ‘আল্লামাহু-তোমাদের মধ্যে উত্তম হচ্ছে ওই ব্যক্তি যে নিজে কুরআন শেখে এবং অন্যকে তা শিক্ষা দেয়। (বুখারী শরীফ, মুসলিম শরীফ)। হযরত মু’আয জুহানী রাদি আল্লাহু তা’আলা আন্হু থেকে বর্ণিত আছে যে, হযরত রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলায়হি ওয়া সাল্লাম বলেছেন : যে ব্যক্তি কুরআন পাঠ করে এবং তাতে যা রয়েছে সে অনুযায়ী কর্ম করে তার আব্বা-আম্মাকে কিয়ামতের দিন রবি কিরণের চেয়েও অধিকতর উজ্জ্বল মুকুট পরানো হবে। (আবু দাউদ শরীফ)।
কুরআন মজিদকে যারা প্রত্যাখ্যান করে কিংবা অবজ্ঞা করে অথবা অবমাননা করে তাদের জন্য কঠিন শাস্তির ঘোষণা দিয়েছেন আল্লাহ্ জাল্লা শানুহু। ইরশাদ হয়েছে : যারা তাদের নিকট কুরআন আসবার পর তা প্রত্যাখ্যান করে তাদের দেয়া হবে কঠিন শাস্তি। আর নিশ্চয়ই এ এক মহিমময় গ্রন্থ। কোন মিথ্যা এতে অনুপ্রবেশ করতে পারে না- সামনে থেকেও পারে না, পেছন থেকেও পারে না। এ প্রজ্ঞাময়, প্রশংসার্হ আল্লাহর নিকট হতে অবতীর্ণ। (সূরা হা-মীম আস্ সাজ্দা : আয়াত ৪১-৪২), এই কিতাব প্রজ্ঞাময়, সর্বজ্ঞের নিকট হতে, এর আয়াতসমূহ সুস্পষ্ট, সুবিন্যস্ত। (সূরা হুদ : আয়াত ১)। আল্লাহ্ জাল্লা শানুহু ইরশাদ করেন : এ (কুরআন) আমি নাযিল করেছি এবং এর বিধানকে অবশ্য পালনীয় করেছি, এতে আমি নাযিল করেছি সুস্পষ্ট আয়াতসমূহ যাতে তোমরা উপদেশ গ্রহণ কর। (সূরা নূও : আয়াত ১)।
আল্লাহ্ জাল্লা শানুহু কুরআন মজিদকে বিজ্ঞানময় গ্রন্থ হিসেবে অভিহিত করে ইরশাদ করেন : ওয়াল কুরআনিল হাকীম-ইন্নাকা লা মিনাল মুরসালিন-আলা সিরাতিল মুস্তাকিম-তানযিলাল্ আযীযির রহীম- শপথ বিজ্ঞানময় কুরআনের, (হে রসূল) নিশ্চয়ই আপনি রসূলগণের অন্তর্ভুক্ত, আপনি সরল পথের ওপর প্রতিষ্ঠিত। কুরআন নাযিল হয়েছে পরাক্রমশালী পরম দয়ালু আল্লাহ্র নিকট হতে। (সূরা ইয়াসিন : আয়াত ২-৫)। কুরআন একেবারে নির্ভুল কিতাব। এ সম্পর্কে ইরশাদ হয়েছে : যালিকাল কিতাবু লা রায়বা ফিহিÑ এ হচ্ছে সেই কিতাব, যাতে কোনরূপ সন্দেহ নেই। (সূরা বাকারা : আয়াত ২)।
কুরআন মজিদ মানুষকে পবিত্র করে এবং জ্ঞান-বিজ্ঞানের শিক্ষা প্রদান করে। এ সম্পর্কে কুরআন মজিদে ইরশাদ হয়েছে : আকাশম-লী ও পৃথিবীতে যা কিছু আছে সবই পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করে আল্লাহ্র, যিনি মালিক মহাপবিত্র পরাক্রমশীল প্রজ্ঞাময়। তিনি উম্মীদের মধ্যে একজন রসুল প্রেরণ করেছেন তাদের মাঝ থেকেই যিনি তাদের নিকট তিলাওয়াত করেন তাঁর (আল্লাহর) আয়াতসমূহ ও তাদের পবিত্র করেন এবং শিক্ষা দেন কিতাব ও হিকমত। (সূরা জুমু’আ : আয়াত ১-২), এই কিতাব পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময় আল্লাহর নিকট হতে অবতীর্ণ। (সূরা জাসিয়া : আয়াত ২)।
পবিত্রতম মহাগ্রন্থ আল-কুরআনুল কারিম অনুযায়ী যিন্দিগী গড়ে তোলার মাধ্যমেই কেবল প্রকৃত সুখ ও শান্তির পৃথিবী গড়ে তোলা সম্ভব। প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মাদুর রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলায়হি ওয়া সাল্লাম বিদায় হজের দীর্ঘ ভাষণের একপর্যায়ে বলেছিলেন : আমি তোমাদের জন্য রেখে যাচ্ছি আল্লাহর কিতাব ও তাঁর রসুলের সুন্নাহ। তোমরা যদি এই দুটোকে আঁকড়ে ধর তা হলে পথভ্রষ্ট হবে না।
কুরআন মজিদে ইরশাদ হয়েছে : তোমরা তোমাদের রব্-এর অভিমুখী হও এবং তাঁর নিকট আত্মসমর্পণ কর তোমাদের নিকট আযাব আসবার আগেই। (সূরা যুমার : আয়াত ৫৪)।
কুরআন মজিদের পবিত্রতা রক্ষা করা এবং কুরআনের দিকনির্দেশনা অনুযায়ী জীবন গড়ে তোলার মধ্যেই মনুষ্য জীবনের সফলতা নিহিত রয়েছে।