মিয়ানমারের বিরুদ্ধে গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের যে অভিযোগ উঠেছে, আন্তর্জাতিক ফৌজদারি আদালত (আইসিসি) সে ব্যাপারে একটি যুগান্তকারী রায় দিয়েছেন। মিয়ানমার আইসিসির সদস্য না হওয়ায় আইসিসি দেশটির দায়ী ব্যক্তিদের বিচার করতে পারবে কি না, তা নিয়ে এক ধরনের সংশয় ছিল। গত বৃহস্পতিবার আইসিসির প্রি-ট্রায়াল চেম্বার-১-এর রায়ে বলা হয়েছে, রোহিঙ্গাদের মিয়ানমার থেকে জোরপূর্বক বহিষ্কার করে বাংলাদেশে পাঠানোসহ অন্যান্য অভিযোগ আইসিসি তদন্ত করতে পারবেন। রায়ে আইসিসির প্রসিকিউটরকে যৌক্তিক সময়ের মধ্যে তদন্ত সম্পন্ন করার নির্দেশও দেওয়া হয়েছে। এই রায়ের মাধ্যমে সদস্য নয় এমন কোনো দেশের অপরাধ তদন্তের ব্যাপারে আইসিসি এক দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। বিশ্বব্যাপী অনেকেই আইসিসির এই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছে। সম্প্রতি আসিয়ানভুক্ত দেশগুলোর যে ১৩২ জন এমপি আইসিসিতে বিচারের উদ্যোগ নেওয়ার জন্য নিরাপত্তা পরিষদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছিলেন, তাঁরাও এই সিদ্ধান্তের প্রশংসা করেছেন।
মিয়ানমার অনেক দিন ধরেই রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে নিষ্ঠুর নির্যাতন চালিয়ে আসছে এবং জোরপূর্বক তাদের বাংলাদেশে ঠেলে দিচ্ছে। একইভাবে ১৯৭৮ ও ১৯৯২ সালে লাখ লাখ রোহিঙ্গাকে বাংলাদেশে ঠেলে দেয়। পরবর্তীকালে তাদের মধ্যে কিছু রোহিঙ্গাকে ফেরত নিলেও বেশির ভাগ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে থেকে যায়। কারণ দেশটিতে রোহিঙ্গাদের জন্য নিরাপত্তা, নাগরিকত্ব, মৌলিক অধিকার বা সম্মানজনক বসবাসের কোনো সুযোগ রাখা হয়নি। এ অবস্থায় ২০১৭ সালে আবারও দেশটির সেনাবাহিনী রোহিঙ্গাদের ওপর বেপরোয়া আক্রমণ চালায়। হত্যা, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগসহ এমন কোনো মানবতাবিরোধী অপরাধ নেই, যা তারা করেনি। ফলে সাত লাখের বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে আসে। বিষয়টি জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের ব্যাপক মনোযোগ আকর্ষণ করে। নির্যাতিত রোহিঙ্গাদের রক্ষায় আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় নানাভাবে এগিয়ে আসে। একই প্রক্রিয়ায় মিয়ানমারের এই মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের দাবিও জোরদার হতে থাকে। মালয়েশিয়াসহ অনেক স্থানেই প্রতীকী বিচারের আয়োজন করা হয় এবং মিয়ানমারকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়। কিন্তু আইসিসির মতো একটি আন্তর্জাতিক আদালতের এমন উদ্যোগ এবারই প্রথম। মিয়ানমার আইসিসিকে যতই অস্বীকার করুক, এই আদালতের রায়ের একটি আন্তর্জাতিক গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে। মিয়ানমারকে তার ফল ভোগ করতেই হবে।
বাংলাদেশ এখনো দ্বিপক্ষীয় আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে রোহিঙ্গা সমস্যার একটি স্থায়ী ও সম্মানজনক সমাধান আশা করে। কিন্তু এ ব্যাপারে মিয়ানমারের সদিচ্ছার অভাব রয়েছে। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন বিষয়ে প্রায় এক বছর আগে দুই দেশের মধ্যে চুক্তি হয়েছে, এখনো প্রত্যাবাসন শুরু হয়নি। প্রত্যাবাসনের পূর্বশর্ত হিসেবে সেখানে যেসব উদ্যোগ নেওয়ার কথা ছিল, তার প্রায় কিছুই করা হয়নি। এ অবস্থায় রোহিঙ্গারাও সেখানে যেতে চাইবে না। আর তারা স্বেচ্ছায় যেতে না চাইলে তাদের জোর করেও পাঠানো যাবে না। এ অবস্থায় বাংলাদেশকে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের ওপর নির্ভর করতেই হবে। আমরা আশা করি, আইসিসির বর্তমান উদ্যোগ মিয়ানমারের সংবিৎ ফেরাবে এবং তারা রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ নেবে।