মেধার লালন উন্নত চরিত্র গঠন ও ইসলামী হাযিব তামাদ্দুন রক্ষায় ॥ বাংলাদেশ আনজুমানে তালামীযে ইসলামিয়ার ৩৫ বছর

509

মোহাম্মদ আবুল কালাম আজাদ

আল্লাহ রাব্বুল আলামীন মানুষকে একটি লক্ষ্য নিয়ে এ পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন। এজন্য মানুষ হচ্ছে আল্লাহর খলিফা বা প্রতিনিধি। সে লক্ষ্য হচ্ছে, তাঁর ইবাদত করা। সঠিক পথে মানুষকে পরিচালিত করা। সে জন্য যুগ যুগে নবী ও রাসুল প্রেরণ করা হয়েছে। এ ধারা শেষ নবী হযরত মোহাম্মদ (সা:) আসার মধ্যে সমাপ্তি টানা হয়েছে। আর কোন নবী বা রাসূল এ পৃথিবীতে আসবেন না। নবী মোহাম্মদ (সা:) এর দেখানো পথে পরিচালিত করতে দাওয়াত অব্যাহত থাকবে। সে দাওয়াত দিবেন কারা? তারা হচ্ছেন আলেমগণ। তারা পরবর্তী সময় থেকে নিয়ে এখন পর্যন্ত পবিত্র কুরআনের নির্দেশ-‘তুমি মানব জাতিকে তোমার রবের পথে ডাক’ এ নির্দেশ পালন করে যাচ্ছেন।
পঞ্চদশ হিজরী শতকের শুরুতে ইসলামী পুনর্জাগরণ ও বিপ্লবের শুরু হয়। কিন্তু এ সময় ইসলামী বিরোধী শক্তিগুলো গোটা মুসলিম বিশ্বকে ধূলিস্যাৎ করতে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে গভীর ষড়যন্ত্রের জাল বুনতে থাকে। তারা বিভিন্ন চমকপ্রদ লেখা আর আত্মঘাতী প্রকাশনার মাধ্যমে ইসলামী সাহিত্য ও সংস্কৃতিকে বিনষ্ট করার জন্য সর্বোচ্চ শক্তি ব্যয় করে। বিশেষ করে জাতি গড়ার ভবিষ্যৎ কারিগর ছাত্র সমাজকে এ পথে টানতে শুরু করে। এ ষড়যন্ত্র থেকে আমাদের দেশ বাংলাদেশও মুক্ত থাকেনি। ভারত উপমহাদেশে এ ষড়যন্ত্রে ভূমিকা পালন করতে থাকে মওদুদীবাদ ও ওহাবীবাদ নামে দুটি ভ্রান্তমতবাদ। এমনই নাজুক পরিস্থিতি পর্যক্ষণ করেন এদেশে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের আকীদা বিশ্বাস লালনকারী ওলামায়ে কেরামগণ। তারা এ বিভ্রান্তকারীদের হাত থেকে ছাত্র সমাজকে রক্ষা করতে এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (সা:)’র নির্দেশিত পথে পরিচালিত করতে ১৯৮০ সালের ১৮ই ফেব্র“য়ারী প্রতিষ্ঠা করেন ‘বাংলাদেশ আনজুমানে তালামীযে ইসলামিয়া’ নামক একটি ছাত্র সংগঠন। প্রতিষ্ঠার পর থেকে এ সংগঠন ছাত্র সমাজের স্বার্থ রক্ষাসহ দেশ ও ধর্মের স্বকীয় বৈশিষ্ট্য বজায় রাখতে সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করে যাচ্ছে। আজ এ সংগঠনের বয়স ৩৫ বছর। এ দীর্ঘ পথ পরিক্রমা পাড়ি দিতে এ সংগঠন অনেক ঝড় তুফানের মোকাবেলা করতে হয়েছে। ওহাবীবাদ আর মওদুদীবাদের নানা ষড়যন্ত্রের শিকার হয়েছে। কিন্তু সত্য পথের উপর অটল ‘বাংলাদেশ আনজুমানে তালামীযে ইসলামিয়া’কে কোন কিছুই দাবিয়ে রাখতে পারেনি। তারা এ সংগঠনের নেতা-কর্মীকে অনেক লোভ লালসা দিয়েছে, কিন্তু তালামীয প্রত্যাখ্যান করেছে। অনেক ভয়ও দেখিয়েছে, তারা দুর্বার বেগে ছুটে চলেছে। তাদের সকল ষড়যন্ত্রে জাল ছিন্ন করে তারা মদিনার ইসলামের উপর অটল অবিচল থেকে সামনে এগিয়ে ছুটেছে। কোন কিছুই তাদের রুখতে পারেনি। ভয়, হামলা-মামলা রুখতে পারেনি আল্লাহ ও তার রাসূলের পথ থেকে। এক ঝাঁক আবাবিল ফৌজের শান্তি শৃংখল আদর্শ দেখে কবি রচনা করেছেন-‘ তালামীয মানে বিপ্লবী চেতনা, মজলুম জনতার শক্তি, মদিনার পথে মোরা ডাকছি’।
‘বাংলাদেশ আনজুমানে তালামীযে ইসলামিয়া’ হচ্ছে একটি ইসলামী ছাত্র সংগঠন। এ সংগঠনের আদর্শ দেখে দেশ বিখ্যাত ওলামে কেরাম ও ইসলামি চিন্তাবিদদের প্রশংসা পেয়েছে। ভারত উপমহাদেশের প্রখ্যাত আলেমে দ্বীন বিশ্বকারী আল্লামা ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ (রাহ.)এর মোবারক হাতে গড়া এ সংগঠনটি ইসলাম বিদ্বেষীদের সকল ষড়যন্ত্রের মোকাবেলা করেছে।
এ দেশে নাস্তিক তাসলিমা নাসরীন ইসলামের বিরুদ্ধে যখন অবস্থান নিয়েছিল, তখন সিলেটের জমিন থেকে তালামীযে ইসলামিয়া প্রতিরোধের ডাক দেয়। শেষ পর্যন্ত তাসলিমা নাসরিনকে দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়। দেশের মানুষ সে দিন তালামীযের এ আন্দোলনকে মোবারকবাদ জানিয়ে ক্লান্ত হয়নি, তারা রাজপথে নেমে তালামীযের শক্তিকে বৃদ্ধি করেছে। কিন্তু ইসলামী আন্দোলনের নামে তালামীযে ইসলামিয়া কোন প্রকার ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপে জড়িয়ে পড়েনি। তারা গণতান্ত্রিক উপায়ে সকল আন্দোলন চালিয়েছে।
বাংলাদেশে ঐতিহ্যবাহী বিদ্যাপীঠ শাহজালাল বিজ্ঞান প্রযুক্তি বিশ্বকিদ্যালয়ে নাস্তিকের নামে নামকরণ করার ষড়যন্ত্র হয়েছিল। তখন আল্লামা ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ (রাহ.) এর ডাকে তালামীযে ইসলামিয়া ময়দানে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। তৎকালীন সরকার শেষ পর্যন্ত এ নামকরণ থেকে সরে দাঁড়ায়। সম্প্রতি শাবিতে মূর্তি নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেয় কর্তৃপক্ষ। জেগে উঠে তালামীযে ইসলামিয়া ছাত্র সংগঠন। তারা আধ্যাত্মিক রাজধানী শাহজালালের পবিত্র ভূমিতে মূর্তি নির্মাণের প্রতিবাদে জেগে উঠে। সরকারকে এ ব্যাপারে বাস্তবসম্মত দিক নির্দেশনামূলক যৌক্তিক দাবী উপস্থাপন করলে সরকার মূর্তি নির্মাণে নিষেধাজ্ঞা জারি করে। এভাবে গঠনমূলক আন্দোলনে তালামীযে ইসলামিয়া অনন্য ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে।
এ দেশের আলেম উলামা ও হাজার হাজার মাদরাসার শতাধিক বছরের দাবী আরবী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা। তৎকালীন বিএনপি সরকারকে এ যুক্তি দাবী জানালে বাধা হয়ে দাঁড়ায় ইসলাম নামধারী একটি গোষ্ঠী। ইসলামী আরবী বিশ্ববিদ্যারয় প্রতিষ্ঠার দাবীতে তালামীযে ইসলামিয়া এদেশে ইসলামী ছাত্র সংগঠনগুলোকে একত্র করে গঠন করে ‘সর্বদলীয় ইসলামী ছাত্র আন্দোলন।’ যার প্রথম কাতারে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তৎকালীন তালামীযে ইসলামিয়ার কেন্দ্রীয় সভাপতি বর্তমান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক মাওলানা আহমদ হাসান চৌধুরী, সাধারণ সম্পাদক লন্ডন প্রবাসী মাওলানা এমএ কাদির আল হাসান।
একটি ইসলামী গোষ্ঠি শুরু করলো আরো গভীর চক্রান্ত। তারা বিএনপি সরকারকে পরামর্শ দিয়ে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ন্যস্ত করলো মাদরাসাগুলো। আল্লামা ফুলতলী ছাহেব কিবলা (রাহ.)সহ এদেশে আলেম উলামা দেখতে পেলেন এ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে মাদরাসা পরিচালিত হলে মাদরাসার স্বকীয় বৈশিষ্ট্য বিনষ্ট নির্ঘাত। আল্লামা ফুলতলী ছাহেব কিবলা (রাহ.) ডাক দিলেন ঢাকামুখী লংমার্চের। এ ঐতিহাসিক লংমার্চে সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করে তালামীযে ইসলামিয়ার প্রতিটি নেতা কর্মী। তাদের প্রাণপ্রিয় নেতা ও মুর্শিদ কিবলাহর এ লংমার্চকে সফল ও স্বার্থক করে তুলতে তালামীয সে দিন বেনজির দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিল। অবশেষে সমকালীন সরকারের টনক নরলো। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবর্তে ন্যস্ত করা হলো ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে।
ইসলামি আকিদা বিশ্বাসকে অপব্যাখ্যার অসংখ্য জবাব দিয়েছে তালামীযে ইসলামিয়া। বিশ্ববিদ্যালয়ে মাদরাসার ছাত্রদের ভর্তি জটিলতা সৃষ্টি করে বাধা দেয়া হয়েছিল। তালামীযে ইসলামিয়া ছাত্র সমাজের কল্যাণের স্বার্থে প্রতিবাদের পর প্রতিবাদ করতে লাগলো। তারা এ দাবী আদায়েও সফল হয়েছে।
বিভিন্ন সময়ে ইসলামের নামে উগ্রতা ও জঙ্গিবাদের জন্ম হয়। তেমনি নাস্তিকরা আস্ফালন শুরু করে। তালামীযে ইসলামিয়া এ দুটি বিষাক্ত মতবাদের প্রতিবাদ মিছিল মিটিং করেছে। এদেশে সুন্নি জনতাকে সাথে নিয়ে তীব্র প্রতিরোধ আন্দোলন গড়ে তুলে। তালামীয ইসলামিয়া মেধার লালন, উন্নত চরিত্র গঠন ও মানবিক যোগ্যতা বিকাশে অবিরাম কাজ করে যাচ্ছে। গরীব মেধাবী অসহায়দের পাশে দাঁড়িয়ে তাকে জ্ঞানর্জনে সহায়তার হাত বাড়িয়ে চলেছে। তালামীয বহুবার আক্রান্ত হয়েছে। কিন্তু আক্রমণের পরিবর্তে ধৈর্য্যের সাথে মোকাবেলা করেছে। আজবধি কোন প্রমাণ নেই তালামীযে ইসলামিয়া হল দখল, ক্ষমতার জন্য, প্রতিপক্ষকে আক্রমণ করেছে, রক্তপাত করেছে। কোন ছাত্রের হাতে অস্ত্র তুলে দিয়েছে। বাংলাদেশে এ নজির আর কেউ দেখাতে না পারলেও তালামীযে ইসলামিয়া ছাত্র সংগঠন দেখাতে পারবে। তালামীযে ইসলামিয়া ছাত্র সমাজের স্বার্থকে তথা ছাত্র সমাজের সমস্যা সমাধানে সদা তৎপর রয়েছে। তারা জন্মলগ্ন থেকে পাঁচ দফা কর্মসূচি নিয়ে এগিয়ে চলেছে। এর প্রধান কর্মসূচি হচ্ছে-‘ ইসলামী আর্দশ তথা আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের আকীদা বিশ্বাসকে মুসলিম ছাত্র সমাজে প্রকাশ করা।’
‘বাংলাদেশ আনজুমানে তালামীযে ইসলামিয়া’-এর লক্ষ লক্ষ কর্মী আজ দেশের প্রতিটি জনপদে। একটি শান্তিপ্রিয় ইসলামি ছাত্র সংগঠন  তালামীয দেশ, ধর্ম ও বিশেষ করে এদেশের ছাত্র সমাজের কল্যাণের ধারাবাহিকতা রক্ষা করে এগিয়ে যাক এ প্রত্যাশা আজকের এ দিনে।

লেখক: সাংবাদিক ও সাবেক সভাপতি, বাংলাদেশ আনজুমানে তালামীযে ইসলামিয়া, ওসমানীনগর উপজেলা।