আল্লাহ্ অস্তিত্বের ধারণা ॥ আধুনিক বিজ্ঞান ও দর্শন সূক্ষ্মতত্ত্ব

275

মুহাম্মদ মনজুর হোসেন খান

আল্লাহ্র অস্তিত্বের ধারণা ও স্বীকৃতি মানব প্রকৃতির মধ্যেই বিদ্যমান। “সূরা ২৯, আয়াত ৬১, ৬৩”। কিন্তু সর্বকালে ও সর্বদেশে আল্লাহ্র ধারণা, তাঁর প্রকৃতি প্রভৃতির রূপ একই রকম ছিল না; এমনকি বর্তমানেও নেই। তাছাড়া ধর্মে আল্লাহ্র অস্তিত্বের বিষয়টি প্রধান কেন্দ্রবিন্দু হলেও দৃশ্যত বিভিন্ন ধর্মে আল্লাহ্র প্রকৃতি, গুণাগুণ, সংখ্যা প্রভৃতির মধ্যে বিস্তর পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। এহেন পরিস্থিতিতে ধর্মীয় ইতিহাস পর্যালোচনা করে আদিতে প্রত্যেক ধর্মই যে এক আল্লাহ্র দিকে মানুষকে আহ্বান জানিয়েছে সেটি নিরূপণ করা প্রয়োজন। তাছাড়া বর্তমান যুগ জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিস্ময়কর আবিষ্কারের যুগ। এমতাবস্থায় বিজ্ঞানী এবং দার্শনিকদের মন থেকে আল্লাহ্র অস্তিত্বের ধারণা কি মুছে গেছে, না প্রখ্যাত সব বিজ্ঞানী ও দার্শনিক আল্লাহ্র অস্তিত্বে বিশ্বাস রাখেন- এ বিষয়ে দৃষ্টি দেওয়া সময়ের দাবী। কিন্তু আমার জানা মতে, বাংলা ভাষায় ঠিক এই আংগিকে উল্লেখযোগ্য গবেষণামূলক প্রবন্ধ বা গ্রন্থ খুব কমই লক্ষ্য করা যায় বিধায় বর্তমান প্রবন্ধের উদ্দেশ্য হচ্ছে “আল্লাহ্ সম্পর্কে দর্শন, পরিবেশ, বিজ্ঞান ও ধর্মের দৃষ্টিভঙ্গি” নিরূপণ করা।  উপরোক্ত উদ্দেশ্য অনুসারে সাধারণভাবে মানুষের মনে আল্লাহ্র ধারণা, বিজ্ঞানে আল্লাহ্র ধারণা, দর্শনে আল্লাহ্র ধারণা, বিভিন্ন ধর্মে আল্লাহ্র ধারণা, একত্মবাদের ধারণা, আল্লাহ্র সঙ্গে জীব জগতের সম্পর্ক, আল্লাহ্র প্রকৃতি, আল্লাহ্র অস্তিত্ব এবং সবশেষে আল্লাহ্র সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক বিষয়ে বিভক্ত করে প্রবন্ধের আলোচনাকে সীমাবদ্ধ রাখা হয়েছে। নিম্নে এতদ্সম্পর্কিত বিষয়ে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করা হল :
মানুষের মনে আল্লাহ্র ধারণা বিষয়ে বলতে গেলে প্রথমেই যেটা বলা প্রয়োজন মনে হয় সেটি হলো, মানুষ কমবেশী ধর্মভাবাপন্ন। আদিম যুগ থেকে বর্তমানকাল অবধি প্রত্যেক সমাজই জগতের একজন স্রষ্টা আছে বলে বিশ্বাস করে। “আমিনুল ইসলাম, জগৎ জীবন দর্শন (বাংলা একাডেমী, ঢাকা, প্রথম পুন:মুদ্রণ, ১৯৯৫), পৃ. ১৭৭”। কেননা মানুষের প্রকৃতিতে ও অনুভূতিতে একজন সৃষ্টিকর্তা ও অধিকর্তার ধারণা জন্মগতভাবে সম্পৃক্ত রয়েছে। এটা হচ্ছে তার অবচেতন মনের একটি অনিবার্য অংশ। আর এই কারণেই যারা আল্লাহ কে পেতে আগ্রহী হয় না, তাদের আগ্রহ উদ্দীপনা অন্য কোন কৃত্রিম জিনিসের দিকেই ধাবিত হয়। মানুষ মাত্রই নিজের অন্তরে এই বাসনা পোষণ করতে বাধ্য যে, এমন কোন বস্তুু ব্যক্তি বা সত্তা তার নাগালের মধ্যে আসুক যার সামনে সে তার জীবনের শ্রেষ্ঠতম উপলব্ধিকে উৎসর্গ করতে পারে। তবে এটা ঠিক যে, এ অনুভূতি যেহেতু  প্রকৃত গত তাই তা প্রথমে স্বাভাবিক আকারেই প্রকাশিত হয়। এর প্রথামিক ঝোঁক থাকে নিজের প্রকৃত ইলাহ্ (মাবুদ)- এর দিকে, পরে অবস্থা ও পরিবেশের প্রভাবে তা ভ্রান্তির দিকে মোড় নেয়। আর তাই মানুষ যখন কিছুদিন একটি বিশেষ জীবন ধারায় অভ্যস্ত হয়ে ওঠে তখন সেটার মধ্যেও সে এক ধরনের স্বাদ পেতে থাকে। এই করণে যে সমস্ত মহাপন্ডিতকে আল্লাহ্ নেই বলতে শোনা যায় তারাও আল্লাহ্কে আপন উপাস্য হিসেবে মেনে না নিলেও অপর একজন উপাস্যের প্রয়োজন থেকে নিজেকে নির্লিপ্ত রাখতে পারেন না। এ প্রসঙ্গে বিবিসিতে ১৯৫৯ সনে ফ্রিম্যানকে দেয়া বাট্রান্ড রাসেলের একটি কথোপকথনকে এখানে উল্লেখ করা মনে হয় মোটেও  অপ্রাসংগিত হবে না। ফ্রিম্যান রাসেলকে জিজ্ঞাসা করেন, “আপনি কি সার্বিকভাবে অংক ও দর্শন চর্চাকে ধর্মীয় চর্চার শ্রেষ্ঠ বিকল্প হিসেবে পেয়েছেন?” রাসেল উত্তর দেন, “জী, হ্যা, নিশ্চিতভাবে আমি চল্লিশ বছর বয়স পর্যন্ত এই প্রশান্তি থেকে বঞ্চিত ছিলাম যার সম্পর্কে প্লেটো বলেছেন, ‘আপনি অংক শাস্ত্র দ্বারা তা লাভ করতে পারেন, সত্যি এটা একটা চিরন্তন বিশ্ব, কালোত্তীর্ণ জগৎ। যেখানে আমি সেই প্রশান্তি লাভ করেছি, যা ধর্মের মধ্যে পাওয়া যায়।” “ড. ওয়াহীদুদ্দীন খান, আধুনিক চিন্তাধারা বনাম ধর্ম, অনুবাদক, আব্দুল মতীন জালালাবাদী (ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, ঢাকা, ১৯৮৮) পৃ. ২০২”। মানব প্রকৃতির এইস্বরূপটিই পবিত্র কুরআনের নিম্নোক্ত আয়াতে পরিষ্কারভাবে ফুটে উঠেছে, “যদি অবিশ্বাসীদের তুমি জিজ্ঞেস কর, কে তাদের সৃষ্টি করেছে? তারা নিশ্চয় বলবে- আল্লাহ্ তবু তারা সত্য পথ থেকে কী করে বিপথগামী হয়?” সূরা ৪৩, আয়াত ৮৭”
শুধু তাই নয়, প্রকৃত আল্লাহকে ভুলে নিজের ইচ্ছামত মানুষ যে অন্য কাউকে আল্লাহ্ হিসেবে বেছে না নিয়ে থাকতে পারে না সেটাও কুরআনে বিবৃত হয়েছে। বলা হয়েছে, “হে নবী! যে ব্যক্তি নিজের নফসের খাহেশাতকে নিজের খোদা বানিয়ে নিয়েছে তুমি কি তার সম্পর্কে ভেবে দেখেছ?” “সূরা ২৫, আয়াত ৪৩”।
উপরের আলোচনা হতে একথা বলা যেতে পারে যে, আবহমান কাল থেকে মানুষের আল্লাহ্ সম্পর্কিত ধারণা বদ্ধমূল। যদিও পরিবেশগত বিভিন্ন কারণে বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন ধরনের মানুষের কাছে এ ধারণার রূপ বিভিন্ন। এবার দর্শনে এ বিষয়ে দৃষ্টি দেয়া প্রয়োজন।
প্রথমেই উল্লেখ করা হয়েছে মানব প্রকৃতির মধ্যে আল্লাহ্ র ধারণা কোন না কোনভাবেই বিরাজমান থাকে। এখন এই মানুষই বুদ্ধি-বিবেচনা ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিশ্লেষণকল্পে বিভিন্ন শ্রেণীতে বিভক্ত হয়ে পড়েছে। দার্শনিক ও বিজ্ঞানী শ্রেণী তাদের মধ্যে অন্যমত। দর্শনের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, নিসর্গবাদ (চধমধহরংস) দিয়েই দর্শনের সূচনা হয়েছে। “ড. আব্দুল হাই তালুকদার, গ্রীক দর্শনের ইতিহাস (থেলিস থেকে প্লাটিনাস), কাজলা, রাজশাহী, ১৯৯১”। যেটাকে পাশ্চত্য দর্শনের ইতিহাসে প্রাচীন যুগ নামে আখ্যায়িত করা হয় । কিন্তু এই ধারা সমসাময়িক কয়েকজনের মধ্যে থাকলেও অল্প কিছুদিনের মধ্যে দেখা যায় দাশনিকরা প্রত্যয়বাদের দিকে ঝুঁকে পড়েছেন। তাইতো দর্শনের ইতিহাসে জগতের মূল সত্তা হিসেবে থেলিসকে পানি (ডধঃবৎ), এ্যনাক্সিমেন্ডারকে সীমাহীন (ইড়ঁহফষবংং), এ্যানাক্সিমিনিসকে বায়ু (অরৎ), হেরাক্লিটাসকে হেরাক্লিটাসকে অগ্নি (ঋরৎব) বলতে যেমন শোনা যায় ঠিক তেমনি সক্রেটিস, প্লেটো ও এরিষ্টটলের মত মহান চিন্তানায়কদের প্রত্যয়বাদের পক্ষে জোর সমর্থন দিতে দেখা যায়। “প্রাগুক্ত, পৃ. ৯;  ড.ঞ. ঝঃধপব, অ ঈৎরঃরপধষ ঐরংঃড়ৎু ড়ভ এৎববশ চযরষড়ংড়ঢ়যু (খড়হফড়হ: গধপসরষষধহ ধহফ ঈড়. খঃফ. ১৯৬০).” এরপর  খৃষ্ট ধর্মের সংস্পর্শে এসে এই প্রত্যয়বাদ আরো গুরুত্ব লাভ করে। ফলে মধ্যযুগীয় পাশ্চত্য দর্শনে আল্লাহ্র একত্মকে যুক্তির উপর প্রতিষ্ঠিত করার এক বিরবচ্ছিন্ন প্রয়াস লক্ষ্য করা যায়- যাঁদের দলে সেন্ট-অগাষ্টিন, প্লাটিনাসসহ আরো অনেক জাত্যাভিমান দার্শনিকের পরিচয় মেলে। “নূরুল ইসলাম মানিক, ইসলামী দর্শনের রূপরেখা (ঢাকা ঃ ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, ১৯৮২), “ভূমিকা”। এরপর পঞ্চদশ শতক-রেনেসাঁর পর হতে যাকে পাশ্চাত্য দর্শনের ইতিহাসে আধুনিক যুগ নামে।
অভিহিত করা হয়, সেখানে বুদ্ধি ও অভিজ্ঞতার সমান প্রভাব দৃষ্ট হয়। ফলে আল্লাহ্র ধারণাও দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়ে। বুদ্ধিবাদীদের মধ্যে ডেকার্ট (যিনি আধুনিক পাশ্চাত্য দর্শনের জনক নামে খ্যাত), লাইবনিজ এবং অভিজ্ঞতাবাদীদের মধ্যে জন লক, জর্জ বাকলী প্রমুখকে যেমন আল্লাহ্-বিশ্বাসের পক্ষে জোর সমর্থন দিতে দেখা যায় ঠিক তারই পাশাপাশি ডেভিড হিউমের মত চরম অভিজ্ঞতাবদী দার্শনিকেরও পরিচয় মেলে যিনি পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের বাইরে এক কদমও পা ফেলতে রাজী হননি। যার ফলশ্র“তিতে তিনি শুধু আল্লাহ্র অস্তিত্বকে অস্বীকার করেন নি সাথে সাথে কার্যকারণ তত্ত্বের চিন্তামূলেও কুঠারাঘাত হানেন। “শ্রী প্রমোদবন্ধু সেনগুপ্ত, পাশ্চাত্য দর্শনের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস (আধুনিক) (ব্যানার্জী পাবলিশার্স, কলিকাতা, ষষ্ঠ সংস্করণ, ১৯৬৩-৯৪), অধ্যায়-নবমঃ ইবৎঃৎধহফ জঁংংবষষ, ঐরংঃড়ৎু ড়ভ ডবংঃবৎহ চযরষড়ংড়ঢ়যু (খড়হফড়হ : এবড়ৎমব অষষবহ ধহফ টহরিহ খঃফ. ১৯৭১), ইড়ড়শ ঞযৎবব, চধৎঃ-১, ঈযধঢ়ঃবৎ-ঢঠওও”  অবশ্য আধুনিক দর্শনের সূচনায় ইন্দ্রিয়লব্ধ জ্ঞান ও বুদ্ধিজাত জ্ঞানকে বেশী প্রাধান্য দেওয়ায় স্বজ্ঞালব্ধ (ওহঃঁরঃরড়হ) জ্ঞান প্রায় লুপ্ত হওয়ার পথে ছিল। যার নিবু নিবু প্রকাশ স্পিনোজা ও শেলিং এর মধ্যে লক্ষ্য করা যায়। শ্রী প্রমোদবন্ধু সেনগুপ্ত, পাশ্চাত্য দর্শন (ব্যানার্জী পাবলিশার্স, কলিকাতা চতুদর্শ সংস্করণ, ১৯৮৫) পৃ. ১০৩; ইবৎঃৎধহফ জঁংংবষষ, ঐরংঃড়ৎু ড়ভ ডবংঃবৎহ চযরষড়ংড়ঢ়যু, ইড়ড়শ ঞযৎবব, চধৎঃ-২, ঈযধঢ়ঃবৎঢঢঠওওও. যার কারণে উপরোক্ত স্বজ্ঞাবাদী দার্শনিকরা এক অতিজাগতিক সত্তায় বিশ্বাস করতেন। কিন্তুু ইংল্যান্ড তথা ইউরোপ ও আমেরিকায় প্রথমে ‘বাস্তবাদ’ (জবধষরংস) এবং তারপর বিশ্লেষণী (অহধষুঃরপ) দর্শন প্রধান্য বিস্তার করার পর থেকে স্বজ্ঞা আবার তার অজ্ঞাতবাসে চলে যেতে বাধ্য হয়। এ বিশ্লেষণী ধারা কেবলমাত্র বস্তুুজগতকে অস্তিত্ব স্বনির্ভর বলে প্রমাণ করেই থামেনি। ম্যূর, রাসেলের পরে ক্রমেই তা ভাষার বিশ্লেষণের দিকে ঝুঁকে পড়ে। সঙ্গে সঙ্গে এ মতবাদ সংবেদন (ঝবহংধঃরড়হ) ব্যতীত জ্ঞানের অপর কোন মাধ্যমই স্বীকার করতে প্রস্তুুত নয়। “নূরুল ইসলাম মানিক, ইসলামী দর্শনের রূপরেখা, পৃ. ৫”। সমকালীন পাশ্চত্য দর্শন যৌক্তিক দৃষ্টবাদ (খড়মরপধষ ঢ়ড়ংরঃরারংস), প্রয়োগবাদ (চৎধমসধঃরংস), অস্তিত্ববাদ (ঊীরংঃবহঃরধষরংস) সহ আরো দার্শনিকধারা উদ্ভব হয়েছে। এই মতবাদগুলো সম্পর্কে বিস্তারিত জানার জন্য দেখুন, রমাপ্রসাদ দাস ও শিবপদ চক্রবর্তী, পাশ্চাত্য দর্শনের রূপরেখা (পশ্চিম বঙ্গ রাজ্য পুস্তক পর্যৎ কলিকাতা, ৩য় সংস্করণ,  ১৯৯২), অধ্যায়-ষষ্ঠ ও একাদশ; ঋৎবফবৎরপশ ঈড়ঢ়ষবংঃরড়হ, ঝ.ঔ. ঈড়হঃবসঢ়ড়ৎধৎু চযরষড়ংড়ঢ়যু (ঝঃঁফরবফ ড়ভ খড়মরপধষ চড়ংরঃরারংস ধহফ ঊীরংঃবহঃরধষরংস), (ঞযব ঈযধঢ়বষ জরাবৎ চৎবংং/ খড়হফড়হ ঞযরৎফ ওসঢ়ৎবংংরড়হ, ১৯৬০); অনিল কুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, বিংশ শতাব্দীর পাশ্চাত্য দর্শন (পশ্চিম বঙ্গ রাজ্য পুস্তক পর্ষদ; কলিকাতা ১৯৪৮), অধ্যায়-ষষ্ঠ, অস্টম ও একাদশ; আমিনুল ইসলাম, সমকালীন পাশ্চাত্য দর্শন (নিউ এজ পাবলিকেশন্স; ঢাকা, তৃতীয় সংস্করণ-১৯৯৯), অধ্যায়-প্রথম, ষোড়শ। ইসলাম, সমকালীন পাশ্চাত্য দর্শন (নিউ এজ পাবলিকেশন্স; ঢাকা, তৃতীয় সংস্করণ-১৯৯৯), অধ্যায়-প্রথম, ষোড়শ। এদের মধ্যে যৌক্তিক দৃষ্টবাদের প্রধান প্রধান প্রবক্তরা দর্শন থেকে আল্লাহ্র ধারণা বলে প্রত্যাখ্যান করার প্রয়াস পান যে, অধিবিদ্যক বাক্যসমূহ (গবঃধঢ়যুংরপধষ চৎড়ঢ়ড়ংরঃরড়হং) যেহেতু বাস্তবে যাচাইযোগ্য নয় তাই দর্শনে এগুলো স্বীকার করার প্রয়োজন নেই। “অধিবিদ্যক বাক্য যেমন, আল্লাহ্র অস্তিত্ব আছে, এই জীবন (দুনিয়ার জীবন) অস্থায়ী পরকালীন জীবন স্থায়ী ইত্যাদি। ‘টেবিলের উপর একটি নীল রঙের বই আছে’- বাক্যটিকে যেভাবে বাস্তবে যাচাই করে এর সত্যাসত্য নির্ণয় করা যায় ঠিক সেভাবে আলালাহ্র অস্তিত্ব আছে’- ধরণের অধিবিদ্যক বাক্যসমূহ বাস্তবে বা চাক্ষুষভাবে যাচাই করে এর সত্যাসত্য নির্ণয় করা যায় ঠিক সেভাবে ‘আল্লাহ্র অস্তিত্ব আছে’ ধরনের অধিবিদ্যক বাক্যসমূহ বাস্তবে বা চাক্ষুষভাবে যাচাই করে এর সত্যাসত্য নির্ণয় করা যায়না বিধায় যৌক্তিক দৃষ্টবাদীরা এধরনের বাক্য এবং বাক্যে বর্ণিত বিষয় (ঋধপঃ) গুলোর অস্তিত্বে বিশ্বাসী নয়। এ বিষয়ে আরো জানার জন্য দেখুন, রমাপ্রসাদ দাস ও শিবপদ চক্রবর্তী, পাশ্চাত্য দর্শনের রূপরেখা, পৃ.১৭৪”।  প্রয়োগবাদী  চিন্তাধারা অনুযায়ী, “যে সমস্ত বিশ্বাস-ধারনা আমাদের জীবনের সহায়ক হবে তাদেরই আমরা ‘সত্য’ ; বলে স্বীকার করব”। “ডরষষরধস ঔধসবং, চৎধমসধঃরংস (ঘবি ণড়ৎশ, ১৯০৭), ৫৪-৫৫; আমিনুল ইসলাম, সমকালীন পাশ্চাত্য দর্শন, পৃ. ১৭০”। সেই হিসেবে তাদের ভাবটা যেন এমনি যে, ব্যবসায়িক মনোবৃত্তি নিয়েই একজন ব্যক্তিকে আল্লাহ্র ধারণা মনে পোষণ অথবা বর্জন করতে হবে। প্রয়োগবাদী চিন্তাধারার গুরু জেম্স এর বক্তব্য যেন সেদিকেই ইঙ্গিত দিচ্ছে— “আমাদের যথার্থ মনোভাব এই হওয়া উচিৎ যে, ঈশ্বর (এড়ফ) সম্পর্কীয় কোন বিশ্বাস বা সম্ভাবনা ব্যবহারিক জীবনে কার্যকর হবে তাকেই সত্য বলে মেনে নেব।” “অনিল কুমুর বন্দ্যোপাধ্যায়, বিংশ শতাব্দীর পাশ্চত্য দর্শন (পশ্চিম বঙ্গ রাজ্য পুস্তক পর্ষদ, ১৯৮৪) পৃ.৮৯”।
আর আস্তিক অস্তিত্ববাদী দার্শনিক-যিনি অস্তিত্ববাদের গুরু সোরেন কিয়ের্কগার্ডসহ গেব্রিয়েল মার্শেল এবং কার্ল ইয়েসপার্স আল্লাহ্র অস্তিত্বকে স্বীকার করলেও অপর অংশের প্রভাবশালী নাস্তিক অস্তিত্ববাদী দার্শনিক বিশেষ করে অস্তিত্ববাদের প্রচার সচিব বলে খ্যাত, জ্যাঁ-পল-সার্ত্র আল্লাহকে এই বলে প্রত্যাখ্যান করেছেন যে, আল্লাহর অস্তিত্বে বিশ্বাস করলে ব্যক্তি তার স্বাধীন চিন্তার আলোকে কিছুই করতে পারবে। “ঋৎবফবৎরপশ ঈড়ঢ়ষবংঃড়হ, ঝ.ঔ. ঈড়হঃবসঢ়ড়ৎধৎু চযরষড়ংড়ঢ়যু, চ. ১৮৯”।
অপরদিকে বুদ্ধিবাদী বলে পরিচিত মুসলিম দার্শনিকবৃন্দ গ্রীক দর্শন কিছুটা প্রভাবান্বিত হলেও নিজেদের স্বকীয়তা এবং কুরআন ও হাদীসের প্রতি নিজেদের প্রত্যয়কে সুদৃঢ় রেখে তাঁরা দর্শনে আল্লাহ্র অস্তিত্বকে সমুন্নত রাখার প্রয়াসে অনেক যুক্রি এবং প্রমাণের আশ্রয় নেন। “নূরুল ইসলাম মানিক, ইসলামী দর্শনের রূপরেখা, “ভূমিকা”। এদের মধ্যে আল-কিন্দী, ইবনে সীনা, আল-ফারাবী, ইবনে রুশদ প্রমুখ উল্লেখযোগ্য। তবে মধ্যযুগের প্রখ্যাত মুসলিম দার্শিনিক আল-গাযালী এবং আধুনিক যুগের আল্লামা ইকবার আল্লাহর অস্তিত্বকে স্বীকার করেছেন সম্পূর্ণ কুরআনের বক্তব্যের আলোকে।
সুতরাং একথা বলা যেতে পারে যে, দর্শনে আস্তিক্যবাদী এবং নাস্তিক্যবাদী দুই ধারার দার্শনিক থাকলেও প্রভাবশালী আস্তিক্যবাদে বিশ্বাসী দার্শনিকদের সংখ্যা কম নয়। আরো মজার ব্যাপার হলো, দার্শনিক সম্প্রদায়ের মধ্যে এমন অনেক দার্শনিকের পরিচয় মেলে যাঁরা জীবনের প্রথম পর্যায়ে নাস্তিক্যবাদী চিন্তাধারার পরিপোষকতা করলেও পরবর্তীকালে তাঁদেরকে আস্তিক্যবাদী চিন্ত-চেতনার সাথে কিছুটা আপোষরফা করে চলতে দেখা যায়। “আমিনুল ইসলাম, জগৎ জীবন দর্শন, পৃ. ২৬৭-২৬৮” এখন এখন বিজ্ঞানীদের মধ্যে আল্লাহ্র অস্তিত্ব বিষয়ে ধারণা কী-এ বিষয়ে আলোকপাত করা হচ্ছে।
দর্শনের ন্যায় বিজ্ঞানেও আল্লাহ্ সম্পর্কিত ধারণার পক্ষ-বিপক্ষ আছে। বিশেষ করে বিজ্ঞানীদের মধ্যে যাঁরা মনে করেন, “প্রকৃত জ্ঞান মাত্রই অভিজ্ঞতার সাথে এমনভাবে সম্পর্কিত থাকে যে, তার সত্যতা যাচাই করা কিংবা প্রত্যক্ষ অথবা পরোক্ষ প্রমাণ লাভ করা সম্ভব।” এঁরা নাস্তিক্যবাদে বিশ্বাসী। এঁরা আরো মনে করেন, “ঘটনারাজি যদি প্রাকৃতিক কারণে ঘটে তাহলে তো তা অতিপ্রাকৃতিক কারণে ঘটে না”। “ড. ওয়াহীদুদ্দীন খান, আধুনিক চিন্তাধারা বনাম ধর্ম, পৃ. ৫”
অন্য আর একদল বিজ্ঞানী মনে করেন, বাহ্যিক ঘটনার কিছু বর্ণনা দিলেই তো একটা ঘটনার মূল কারণ আবিষ্কৃত হয়ে যায় না। উদাহরণ স্বরূপ তাঁরা বলতে চান যে, “খাদ্য হজম হওয়া এবং তা দেহের অংশে রূপান্তরিত হওয়ার বিষ্ময়কর ক্রিয়াকন্ডকে প্রথমে আল্লাহ্র দিকে সম্পর্কিত করা হত। কিন্তুু এখন আধুনিক পর্যবেক্ষণের সাহয্যে ঐ রাসায়নিক ক্রিয়াকর্মের ফলশ্র“তি মানুষেরই দৃষ্টিগোচর হয়, তাই বলে কি আল্লাহ্র অস্তিত্বের বিষয়টি নেতিবাচক হয়ে দাঁড়াল? কোন সেই চূড়ান্ত শক্তি, যে রাসায়নিক উপাদনসমূহকে বাধ্য করল অনুরূপ উপকারী ক্রিয়াকান্ড ঘটাতে? খাদ্য মানুষের দেহে প্রবেশ করার পর একটি বিস্তয়কর স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থার অধীন যেভাবে বিভিন্ন স্তর অতিক্রম করে তা নিরীক্ষণ করার পর এ কথাটি একেবারে আলোচনা বহির্ভূত হয়ে দাঁড়ায় যে, এ বিস্ময়কর ব্যবস্থা শুধুমাত্র ঘটনা পরস্পরায় অস্তিত্ব লাভ করেছে। প্রকৃত অবস্থা এই যে, এই নিরীক্ষণ ও পর্যবেক্ষণের পর এটাঁ আরো জরুরী হয়ে দাঁড়ায় যে, আমরা স্বীকার করবো, আল্লাহ্ তাঁর মহান নীতি অনুসারে এই কর্মকান্ড ঘটিয়ে থাকেন এবং এর অধীনেই তিনি জীবনকে বিকশিত করেন। প্রাগুক্ত, পৃ. ১৩”
এখানে পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে যে, বিজ্ঞানীদের প্রথম দলটি নাস্তিক্যবাদে বিশ্ববাসী হলেও দ্বিতীয় দলটি আস্তিক্যবাদে বিশ্বাসী। আস্তিক্যবাদে বিশ্বাসী এই বিজ্ঞানীরা আল্লাহকে নিছক একটি শক্তি অথবা প্রথম বা আদি নিমিত্ত (ঋরৎংঃ ঈধঁংব) অথবা বিশ্বজাহানের আত্মা মনে করে না। বরং এঁরা আল্লাহকে সর্বজ্ঞ, শ্রেষ্ঠ জ্ঞানী এবং ইচ্ছাশক্তির অধিকারী বলেই মনে করেন। এঁরা এও মনে করেন যে,আল্লাহ একবার সৃষ্টি করেই বসে নেই, বরং প্রতি মুহূর্তে সৃষ্টি করে চলেছেন। “জন ক্লোভার মোনজমা ঃ সম্পাদনা, অনুবাদক-সৈয়দ রেদওয়ানুর রহমান, চল্লিশ জন সেরা বিজ্ঞানীর দৃষ্টিতে আল্লাহ্র অস্তিত্ব (মদীনা পাবলিকেশন্স, ঢাকা : ত্রয়োদশ সংস্করণ-২০০০) পৃ. ৫”
এ প্রসঙ্গে আরো একটি বিষয় উল্লেখ করা প্রয়োজন বলে মনে হয়, আর তা হলো, নাস্তিক্যবাদে বিশ্বাসীদের মধ্যে অনেক বিজ্ঞানী প্রথম দিকে প্রকৃতির বাহ্যদিকের প্রতি দৃষ্টিক্ষেপ করে এক আল্লাহকে অস্বীকার করলেও পরে তাঁরা এক আল্লাহতে বিশ্বাস করেন। “প্রাগুক্ত, পৃ. ১৮”
এ কথা  বললে অত্যুক্তি হবে না যে, মধ্যযুগে সমগ্র খ্রীষ্টান জগতে বিজ্ঞানমনস্ক ব্যক্তিদের উপর পুরোহিততন্ত্র এমনভাবে প্রভাব বিস্তার করেছিল যার প্রতিক্রিয়াস্বরূপ একদল বিজ্ঞানী নাস্তিক্যবাদ গ্রহণ করতে বাধ্য হয়েছিলেন। এ কথার সমর্থনে ড. মরিস বুকাইলির মন্তব্য প্রণিধানযোগ্য। তাঁর মতে, “মধ্যযুগটা ছিল খ্রীষ্টান জগতের জন্য অচলায়তনের কাল; আর একই আবর্তে ঘুরপাক খাওয়ার যুগ। বলে রাখা ভাল যে, ইয়াহুদী ও খ্রীষ্টানদের ধর্মীয় কিতাবেও বৈজ্ঞানিক গবেষণার প্রতি কোন অনীহা ছিল না’ কিন্তুুু সেকালে ঐ দুই ধর্মের সেবক হিসেবে যাঁরা নিজেদের পরিচয় দিতেন, তাঁরা বৈজ্ঞানিক গবেষণার পথে সৃষ্টি করে রেখেছিলেন নানা প্রতিবন্ধকতার। এরপর এল রেনেসাঁর যুগ। সেই রেনেসাঁর যুগে বিজ্ঞানীরা স্বভাবতই ধর্মীয় কর্মকর্তাদের উপরে প্রতিশোধ নেওয়ার সুযোগ পেয়ে গেলেন”। “ড. মরিস বুকাইলি, বাইবেল কুরআন ও বিজ্ঞান, রূপান্তর ঃ আখতার-উল-আলম (রংপুর পাবলিকেশন্স লিমিটেড, ঢাকা : তৃতীয় সংস্করণ-১৯৮৯), পৃ. ১৮২”।
সুতরাং বোঝা যাচ্ছে, প্রখ্যাত সব বিজ্ঞানীদের মধ্যে অধিকাংশই আল্লাহ্র অস্তিত্বে বিশ্বাসী। দর্শন ও বিজ্ঞানে আল্লাহ্র ধারণা আলোচনার পর এখন বিভিন্ন ধর্মে আল্লাহ্র ধারণা বিষয়ে কি বক্তব্য রয়েছে তা দেখা প্রয়োজন।
প্রথমেই উল্লেখ করা হয়ে যে, মানুষ মাত্রই কমবেশী ধর্ম ভাবাপন্ন। এ দৃশ্যমান জগতের অন্তরালে যে এক পরম সত্তা আল্লাহ্র অস্তিত্ব রয়েছে, সেই আদিম যুগ থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত সব মানব সমাজে তা কমবেশী জাগ্রত। যদিও বিভিন্ন সময়ে, বিভিন্ন ধর্মে, আল্লাহ্কে এক এক নামে ডাকা হয়েছে। তবে বক্ষ্যমান প্রবন্ধটিতে আল্লাহ্ বলতে লা-শরীক বা অংশীদার বিহীন এক, অদ্বিতীয়, শাশ্বত আল্লাহকে বোঝানো হবে। এবং এ প্রসঙ্গে বিভিন্ন ধর্মে আল্লাহ্র যে ধারণা পেশ করা হয়েছে তার সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দিয়ে প্রমাণ করার চেষ্টা করা হবে যে, আদিতে সব ধর্মই ছিল মূলত তৌহিদবাদী।
ইসলাম ধর্মে আল্লাহ্র ধারণা : ইসলাম ধর্মকে জগতের শ্রেষ্ঠ ধর্ম হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এই ধর্মের প্রবর্তক স্বয়ং আল্লাহ্। আল্লাহ্ পাক যুগে যুগে নবী-রাসূলদের মাধ্যমে সেই সময়ের এবং স্থানের প্রেক্ষিতে ইসলামের বিধান রূপ হিদায়াতকে ক্রমান্বয়ে নাযিল করে তা সম্পূর্ণ করেছেন সর্বশেষ গ্রন্থ আল-কুরআন অবতীর্ণের মাধ্যমে। “সূরা- আয়াত ৩৮; সূরা-৫, আয়াত ৩”।
সুতরাং এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যেতে পারে যে, কুরআনে আল্লাহ্র একত্বের যে বর্ণনা দেওয়া পেশ করা হয়েছে সেটাই ইসলামী ধারণা। তবে পবিত্র কুরআনে আল্লাহ্র একত্বের যে বর্ণনা দেওয়া     হয়েছে তা নির্দিষ্ট এক জায়গায় নয়। এই বর্ণনা এসেছে বিভিন্ন সূরার বিভিন্ন আয়াতে ভিন্ন ভিন্ন পরিস্থিতির প্রেক্ষিতে। এর মধ্যে সূরা ইখলাসে বর্ণিত আল্লাহ্ সম্পর্কিত যে ধারণা তথা পরিচয় পেশ করা হয়েছে তা সংক্ষিপ্ত হলেও পূর্ণাঙ্গ বলো যেতে পারে। উক্ত সূরায় আল্লাহ্র ধারণা তথা পরিচয় দিতে যেয়ে বলা হচ্ছে যে, “বল, আল্লাহ্ এক, অদ্বিতীয়। আল্লাহ্ অন্য নিরপেক্ষ। তিনি কাউকে জন্ম দেননি, তিনি নিজেও জাত নন। তাঁর সমকক্ষ কেউ নেই, তিনি তুলনাহীন”। “সূরা-১১২”
উক্ত আয়াতে আল্লাহ্র একত্ববাদের ধারণাই পরিষ্কারভাবে ফুটে উঠেছে। তাছাড়া আল্লাহ্ সম্পর্কিত ধারণার সংক্ষিপ্ত হলেও একটি পরিষ্কার পরিচয় পাওয়া যায় ‘কালেমা তাওহীদ’ বা ইসলামের সাক্ষ্য ঘোষণায় (ষ্টেটমেন্ট অব টেষ্টিমনি) ‘আল্লাহ্ ব্যতীত কোন প্রভু নেই, মুহাম্মদ (সা:) আল্লাহ্র রাসূল’ এই উক্তি বা কালেমার মধ্যে সুষ্পষ্ট করে বলা হয়েছে যে, আল্লাহ্ ছাড়া সমগ্র বিশ্বে আর কোন মাবুদ বা প্রভু নেই; তিনি ব্যতীত এমন কোন সত্তা নেই যাকে প্রভুর সমকক্ষ বলে বিবেচনা করা যেতে পারে। আবদুল জলিল মিয়া “তাওহীদের তাৎপর্য” দর্শন ও প্রগতি, প্রথম সংখ্যা, ডিসেম্বর-১৯৮৪, ঢাকা: পৃ. ১২৯”। পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে, আল্লাহ্র একত্বের ধারণা কুরআনের বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন প্রসঙ্গে এসেছে। এদের মধ্যে সবগুলো উল্লেখ করা সম্ভব নয় বিধায় এ সম্পর্কে আর একটি মাত্র তাৎপর্যপূর্ণ উদ্ধৃতির উল্লেখ করা হলো ঃ “আল্লাহ্, তিনি ছাড়া আর কোন প্রভু নেই। তিনি চিরজীবন্ত, স্বলালিত ও পরিচালিত এবং চিরন্তন। আকাশ ও জমিনের সমস্ত জিনিসি কেবল তাঁরই। সমগ্র আকাশ-পৃথিবীব্যাপী তাঁর শ্রেষ্ঠত্ব এবং এসব তত্ত্বাবধান ও সংরক্ষণ করতে তিনি ক্লান্তিবোধ করেন না। কেননা তিনি হচ্ছেন সর্বোচ্চ ও সর্বশ্রেষ্ঠ।” সূরা ২, আয়াত-২২৫”।
উপরের আলোচনা হতে দেখা যাচ্ছে যে, ইসলামে আল্লাহ্র যে ধারণা পেশ করা হয়েছে তা সম্পূর্ণ একত্ববাদের (গড়হড়ঃযবরংস) ধারণার উপর প্রতিষ্ঠিত। ধর্মে আল্লাহ্র ধারণা বিষয়ে আলোচনা করতে গিয়ে এখন খ্রীষ্টান ধর্মে আল্লাহ্ সম্পর্কে যে ধারণা পাওয়া যায় তা আলোচনা করা হচ্ছে। বলা বাহুল্য, বিশ্বের গোটা মানব সমাজের মধ্যে খ্রীষ্টান ধর্মে বিশ্বাসী লোকের সংখ্যা কম নয়। হযরত ঈসা (আ) কর্তৃক প্রচারিত আল্লহ্র একত্ববাদের ধর্ম “সূরা-৩ আয়াত-৫০-৫২”।
পরবর্তীকালে খ্রীষ্ট ধর্ম নামে পরিচতি লাভ করে। “নূর নবী, আল্লাহ্তত্ত্ব (গ্রীন বুক হাউস লিমিটেড, ঢাকা : ১৯৮১). পৃ. ৭”।
পবিত্র কুরআন থেকে জানা যায় যে, হযরত ঈসা (আ:) ছিরেন আল্লাহ্র একজন সম্মানিত রাসূল এবং তাঁকে পাঠানো হয়েছিল পূর্ববর্তী অন্যান্য নবীদের কিতাবের সত্যতার নিদর্শন রূপে। “সূরা-৩, আয়াত ৫০”।
“এবং আমরা প্রত্যেক জাতির মধ্যে একজন পয়গাম্বর পাঠিয়েছি, যিনি এই বলে আহ্বান জানিয়েছেন, এক আল্লাহ্র বন্দেগী কর এবং খোদাদ্রোহীদের আনুগত্য থেকে দূর থাক। ” সূরা-১৬, আয়াত ৩৬”।
ইতিহাস থেকে জানা যায় যে, ঈসা (আ:)- এর প্রথামিক যুগের অনুসারীরা ঈসা (আ:)-এর শিক্ষার পুরোটাই অনুসরণ করে চলতো। তাঁরা ঈসা (আ:)-কে শুধু একজন নবী বলেই মানতো; তাঁরা এক আল্লাহতে বিশ্বাসী ছিল এবং মুসা (আ:)-এর শরীয়তের অনুসারী ছিল। আকীদাহ-বিশ্বাস, হুকুম-আহকাম ও ইবাদত বন্দেগীর ব্যাপারে তারা অন্যান্য (ইসরাইলী) ইয়াহুদীদের থেকে কিছুতেই পৃথক মনে করতো না। প্রসঙ্গে ড. মরিস বুকাইলী তাঁর ‘বাইবেল কুরআন ও বিজ্ঞান’ নামক গ্রন্থে কার্ডিনাল ডানিয়েলুর গবেষণার যে একটি উদ্ধৃতি দিয়েছেন সেটি হলো ঃ যীশুখীষ্টের অন্তর্ধানের পর তাঁর—
‘প্রেরিতদের একটি ক্ষুদ্র দল’ এমন একটি সম্প্রদায় গঠন করলেন-যারা ইয়াহুদী মন্দিরের উপাসনার পদ্ধতির প্রতি ছিলেন একান্ত অনুগত ও বিশ্বস্ত।” কিন্তুু পরবর্তীকালে তারা হযরত ঈসা (আ:) কর্তৃক প্রচারিত তৌহিদের মর্মবাণীকে বিকৃত করে এক আল্লাহ্র পরিবর্তে আল্লাহকে ত্রি-ধা বিভক্ত করে। “সূরা-৪, আয়াত ১৭১”।
বর্তমান খ্রীষ্ট সমাজ যে তাদের মূলধর্মকে বিকৃত করে তৌহিদের মর্মবাণী থেকে নিজেদেরকে শিরকবাদে পর্যবাষিত করেছে তা আধুনিক নান গবেষক প্রমাণ কতে সমর্থ হয়েছেন। বিশেষ করে ড. মরিস বুকাইলী খৃষ্ট ধর্মের উপর যে ব্যাপক অনুসন্ধান কাজ চালিয়েছেন তাতে তিনি প্রমাণ করার চেষ্টা করেছেন যে, বর্তমান খ্রীষ্টানরা যে চারটি সুসমাচারকে যিশুর সময় রচনা করা হয়েছে বলে দাবী করেন তা সত্য নয়। সেগুলোর রচয়িতাগণের মধ্যে একজনও যিশুর সাহাবী ছিলেন না। বরং বর্তমান খ্রীষ্টান সমাজে প্রচলিত যে চারটি সু-সমাচার রয়েছে সেগুলো সম্পূর্ণ মানুষের মনগড়া কথায় তথা শিরকবাদে ভরপুর। উক্ত গ্রন্থসমূহের রচয়িতাগণের যিনি পৃষ্ঠপোষক, তিনি ছিলেন (পৌল বা সেন্টপল) খোদ যিশুখ্রীষ্টের পরিবারের সদস্যদের নিকট বিশ্বাসঘাতক এবং যার সাথে যিশুর কোনদিনই সাক্ষাৎ ঘটেনি। “ড. মরিস বুকাইলি, বাইবেল কুরআন ও বিজ্ঞান, পৃ. ৮৮”।
তবে যীশুর (হযরত ঈসা (আ:) প্রাচরিত ধর্ম যে এক তৌহিদবাদের উপর প্রতিষ্ঠিত ছিল তা পবিত্র কুরআন অধ্যয়নের মাধ্যমে যেমন জানা যায় তেননি অধুনা ‘বার্ণাবাসে’র “ইঞ্জিল সম্পর্কে জানার জন্য দেখুন, সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদুদী, সীরাতে সরওয়ারে আলম (দ্বিতীয় খন্ড), অনুবাদ-আব্বাস আলী খান (সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদুদী রিসার্চ একাডেমী, ঢাকা-১৯৮৮), পৃ.১৭৯-১৮৫”। ইঞ্জিল আবিষ্কার হওয়ার পর তা আরও সু-প্রতিষ্ঠিত হয়। উক্ত গ্রন্থে হযরত ঈসা (আ:)- এর আসল স্বরূপ, তাঁর প্রকৃত শিক্ষা তথা তাওহীদের শিক্ষা, শিরক খন্ডন ইত্যাদি বিষয়ে আর চার ইঞ্জিল অপেক্ষা অনেক বেশী স্পষ্ট করে তুলে ধরা হয়েছে। উক্ত গ্রন্থের  যৎকিঞ্চিত উদ্ধৃতি নিুে তুলে ধরা হলো।
“কিন্তু আল্লাহ্ যখন আমকে দুনিয়া থেকে নিয়ে যাবেন তখন শয়তান আবার এমন বিদ্রোহ করবে যে, দুরাচার লোকেরা আমাকে খোদা ও খোদার ছেলে বলে মানবে। সে কারণে আমার কথা ও শিক্ষাগুলোকে এতদূর বিকৃত করে দেওয়া হবে যে, ত্রিশ জন মুমিন অবশিষ্ট থাকাও কঠিন হয়ে পড়বে… (অধ্যায়-১৬) “ইধৎহধনধং, ঞযব এড়ংঢ়বষ ড়ভ ইধৎহধনধং, অুনবাদক, খড়হংফধষব এবং খধঁৎৎধধম (ক্লারেগুন প্রেস, অক্সফোর্ড, লন্ডন-১৯৭০), অধ্যায়-১৬”।
“[শিষ্যদেরকে হযরত ঈসা (আ:) বললেন,] আমি নিশ্চিতভাবে তোমাদের বলছি যে, মুসার কিতাব থেকে সত্যকে যদি মুছে ফেলা না হতো তাহলে আল্লাহ্ আমাদের পিতা দাউদকে আর একখানা কিতাব দিতেন না। আর যদি দাউদের কিতাবকে বৃকত করা না হতো তাহলে আল্লাহ্ আমাকে ইঞ্জিল দিতেন না। কেননা আমাদের খোদা পরিবর্তনশীল নন। তাই সবাইকে তিনি একই কথা বলেছেন। সুতরাং যখন আল্লাহ্র রাসূল আসবেন তখন খোদা বিমুখ লোকের দ্বারা কলুষিত আমার কিতাবকে তিনি কলুষমুক্ত করবেন।” (অধ্যায়-১২৪১) “প্রাগুক্ত, অধ্যায় ১২৪”।
উপরের আলোচনা হতে এটাই প্রতীয়মান হচ্ছে যে, খ্রীষ্টান ধর্ম ছিল মূলত একত্ববাদের উপর প্রতিষ্ঠিত। যা পরবর্তীকালে অনেকটা শিরকবাদের দিকে ঝুঁড়ে পড়ে। কুরআনের পরই বার্ণাবাসের ইঞ্জিল সেদিকেই ইঙ্গিত দিচ্ছে।
ইয়াহুদী ধর্মে আল্লাহ্র ধারণা ঃ বর্তমান বিশ্বে একত্ববাদী বলে পরিচিত আর একটি ধর্ম হলো ইয়াহুদী ধর্ম। যদিও ইয়াহুদী ধর্মের —
প্রবর্তক হিসেবে হযরত মুসা (আ:)-কে গণ্য করা হয়ে থাকে, কিন্তু ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, আল্লাহ্র প্রেরিত নবীদের মধ্যে কেউই ইয়াহুদী ছিলেন না। নামের ভিত্তিতে এ ধর্মের উৎপত্তি বহু পরবর্তী যুগের । মনে করা হয়ে থাকে যে, ইয়াকুক (আ:)-এর চুতুর্থ পুত্র ইয়াহুদার প্রতি এ ধর্ম আরোপ করা হয়। “সাইয়েদ আবুল আ’ল মওদুদী, সীরাতে সরওয়ারে আলম (দ্বিতীয় খন্ড), পৃ. ১২৩”।                                                           (চলবে)