আন্তর্জাতিক নারী দিবস ও বাংলাদেশে নারী

166

1_126863জেসমিন জেসি

আজ ৮ই মার্চ। আন্তর্জাতিক নারী দিবস। প্রতিবছর সারা বিশ্বব্যাপী নারীরা একটি প্রধান উপলক্ষ হিসেবে এই দিবস উদযাপন করে থাকেন। বিশ্বের একেক প্রান্তে নারী দিবস একেক প্রকার হয়।কোথাও নারীর প্রতি সাধারণ সম্মান ও শ্রদ্ধা উদযাপনের মুখ্য বিষয় হয়, আবার কোথাও নারীর আর্থিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রতিষ্ঠাটি বেশি গুরত্ব পায়।তবে এই দিবসটি উদযাপনের পিছনে রয়েছে নারী শ্রমিকের অধিকার আদায়ের সংগ্রামের ইতিহাস। ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের ৮ মার্চ মজুরি বৈষম্য, কর্মঘন্টা ১২ঘন্টা থেকে কমিয়ে ৮ ঘন্টা নির্দিষ্ট করা, কর্মক্ষেত্রে সুস্থ ও স্বাস্থ্যকর পরিবেশ নিশ্চিত করার দাবিতে মার্কিন যুক্তরাষ্টের নিউইয়র্কের রাস্তায় নেমেছিল সুতা কারখানার নারী শ্রমিকেরা। সে মিছিলে চলছিল সরকারের লাঠিয়াল বাহিনীর দমন-পীড়ন এবং এই আন্দোলনে নামার অপরাধে গ্রেফতার হন বহু নারী। কারাগারে নির্যাতিত হন অনেকেই। তিন বছর পর ১৮৬০ খ্রিস্টাব্দে একই দিনে গঠন করা হয় ‘নারী শ্রমিক ইউনিয়ন ‘। ১৯০৮ খ্রিস্টাব্দে পোষাক ও বস্ত্রশিল্পের কারখানায় প্রায় দেড় হাজার নারী শ্রমিক একই দাবিতে আন্দোলন করেন। অবশেষে আদায় করে নেন দৈনিক ৮ ঘন্টা কাজ করার অধিকার। ১৯০৮ খ্রিস্টাব্দে নিউইয়র্কের স্যোশাল ডেমোক্রেট নারী সংগঠনের আয়োজিত নারী সমাবেশে নারী সমাজতান্ত্রিক নেত্রী ক্লারা জেটকিনের নেতৃত্বের সর্বপ্রথম আন্তর্জাতিক নারী সম্মেলন হয়। ক্লারা ছিলেন জার্মান রাজনীতিবিদ, জার্মান কমিউনিষ্ট পার্টির স্থপতিদের একজন। এরপর ১৯১০ খ্রিস্টাব্দে ডেনমার্কের কোপেনহেগেনে অনুষ্ঠিত হয় দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক নারী সম্মেলন। ১৭টি দেশ থেকে ১০০ জন নারী প্রতিনিধি এতে যোগ দিয়েছিলেন।এ সম্মেলনে ক্লারা জেটকিন প্রতি বৎসর ৮ মার্চকে আন্তর্জাতিক নারী দিবস হিসেবে পালন করার প্রস্তাব দেন এবং সিদ্ধান্ত হয় ১৯১১ খ্রিস্টাব্দ হতে নারীদের সম-অধিকার দিবস হিসেবে এ দিনটি পালিত হবে। ১৯১৪ খ্রিস্টাব্দ থেকে কয়েকটি দেশে ৮ মার্চ নারী দিবস হিসেবে পালিত হতে থাকে। বাংলাদেশেও ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দে স্বাধীনতা লাভের পূর্ব থেকেই এই দিবসটি পালিত হতে থাকে। অত:পর ১৯৭৫ খ্রিস্টাব্দে ৮ মার্চ কে “আন্তর্জাতিক নারী দিবস”  স্বীকৃতি প্রদান করা হয়। দিবসটি পালনের জন্য বিভিন্ন রাষ্ট্রকে আহবান জানায় “জাতিসংঘ “। এরপর থেকে পৃথিবী জুড়েই নারীর সম-অধিকার আদায়ের প্রত্যয় পুনর্ব্যক্ত করার অঙ্গীকার নিয়ে দিনটি পালিত হচ্ছে।
বিশ্বের অনেক দেশেই আন্তর্জাতিক নারী দিবস উপলক্ষে আনুষ্ঠানিক ভাবে সরকারি ছুটির দিন হিসেবে পালিত হয়। কোনো কোনো দেশে শুধুমাত্র নারীরাই সরকারি ছুটি ভোগ করে। এ দেশগুলো হচ্ছে, চীন, মেসিডোনিয়া, মাদাগাস্কার ও নেপাল।
বাংলাদেশ ইতোপূর্ব বিভিন্ন উন্নয়ন পরিকল্পনায় নারী উন্নয়নে বিভিন্ন কর্মসূচি ও কার্যক্রম গ্রহণ করা হলেও তা ছিল বিচ্ছিন্ন ও সমন্বয়হীন। কিন্তু ১৯৯৫ সালে বেইজিং সম্মেলনে নারী উন্নয়ন পরিকল্পনায় নারী উন্নয়নের লক্ষ্যে যে ক্ষেত্রগুলো চিহ্নিত করা হয়েছিল তার আলোকে প্রথম বারের মতো একটি নারী উন্নয়ন নীতি ও কর্ম পরিকল্পনায় প্রণয়ন করা হয়। যার প্রধান লক্ষ্য নির্যাতিত ও অবহেলিত এদেশের বৃহত্তম নারী সমাজের ভাগ্য উন্নয়ন করা। এর ফলে নারী সমাজ আশার আলো দেখে, কেননা এই নীতিমালা প্রণয়নের মধ্য দিয়ে নারীর প্রতি হাজার বছরের শোষণ ও বৈষম্য বিলোপ হবে, নারী সম-অধিকার লাভ করবে এটিই ছিল সবার আশা। বাংলাদেশে প্রণীত নারী নীতিটি ১৯৯৭ খ্রিস্টাব্দের জাতীয় সর্বোচ্চ নীতি নির্ধারণী সংস্থা (ঘঈডউ) কর্তৃক অনুমোদিত হয় এবং ১৯৯৭ খ্রিস্টাব্দেই ৮ মার্চ বিশ্ব নারী দিবসে এ নীতিটি ঘোষিত হয়। এই পথ দিয়ে এগিয়ে যেতে যেতে তৈরি হয়েছে নারী সমাজ। এখন নারীরা কেবল তাদের অধিকারগুলোই পাচ্ছে না, পাচ্ছে তাদের উন্নয়ন -উত্তরণেরও পথ। যেভাবে বাংলাদেশে সময়ের সাথে বদলেছে নারীদের জীবন জীবিকা আর পথ চলা। নারীরা একজন পুরুষের তুলনায় এগিয়ে রয়েছে সকলক্ষেত্রে। সর্বক্ষেত্রে নারীরা এখন নিজেদের অবস্থান করে নিয়েছে। গার্মেন্টস শিল্পে ইতিমধ্যে নারী বিপ্লব ঘটেছে। রাষ্ট্র ক্ষমতায়ও পিছিয়ে নেই নারীরা। কবি কাজী নজরুল ইসলামের কথা যথার্থই প্রমাণিত হয়েছে আজ। “পৃথিবীর যা কিছু সুন্দর চিরকল্যাণকর অর্ধেক তার গড়িয়াছে নারী অর্ধেক তার নর…।
এখন নারী মানে পুরুষের ভোগের সামগ্রী আর করুণার পাত্র নয়, নারী মানে চার দেয়ালে বন্দী জীবন নয়, নারী মানে নরপিশাচদের হাতে রক্তাক্ত নয়। নারী এখন যোদ্ধা, নারী এখন সাহসী, নারী এখন প্রতিবাদী, অধিকার আদায়ে প্রত্যাশী, নারী এখন সৈনিক, বৈমানিক, মানুষ গড়ার কারিগর, নারী এখন ফুটবল বা ক্রিকেট খেলার মাঠে, নারী এখন এভারেস্ট বিজয়ী।নারী এখন রাজনৈতিক নেত্রী, প্রধানমন্ত্রী, বিরোধী দলের নেত্রী, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী, পররাষ্ট্র মন্ত্রী, নারী এখন সংসদ স্পীকার। কোথায় নেই নারী?  নভোচারী নারী, চাঁদে হেঁটেছে নারী, রাজনীতি নিয়ন্ত্রণে নারী,  দেশের অর্ধেক ভোটার নারী।
নারী নয় অবলা, নয় ফেলনা, নারী ছাড়া উন্নয়ন কখনো হবে না। জীবনের জন্য ভালোবাসা, ভালোবাসার জন্য নারী। নারীদের কষ্ট নয়, সুখের রংধনু উপহার হোক নারী উন্নয়ন নীতির লক্ষ্য উদ্দেশ্য সমূহ।
নারী মা, নারী সেবাব্রতী, নারী প্রেরণা, নারী ভালোবাসা, নারী অপরাজিতা, নারী জয়িতা। অধিকার আদায়ে নারী নিজেদের জানান দেয়…………………………………
আমি নারী আমি পারি।
শুধু সৃষ্টিই নয়, জানি ধ্বংস।
আমি যে মহাশক্তির অংশ।
আমি পারি প্রেমে বাঁধতে।
পারি ভবিষ্যতকে মুঠোয় ধরতে।
হতে পারি ক্ষুদ্র, কিন্তু উচ্চ আমার আশা।
আমি স্বাধীন।
আমি মুক্ত, তাই আকাশে ভাসা।