মানবসম্পদ উন্নয়নের গুরুত্ব

139

॥ মুহাম্মদ মনজুর হোসেন খান ॥

(পূর্ব প্রকাশের পর)
আল্লাহ তাআলা এবং তাঁর রাসূল (সা.) নানাভাবে মানুষকে কাজ করায় উৎসাহ দিয়েছেন। ভিক্ষাবৃত্তির প্রতি অনীহা তৈরির জন্য রাসূল (সা.) বলেছেন, নিচের হাতের চেয়ে উপরের হাত উত্তম। ‘‘ ইমাম বুখারী, আস-সহীহ, অধ্যায় : আয-যাকাত, অনুচ্ছেদ : লা সদাকতা ইল্লা আন যহরি গিনা, প্রাগুক্ত, হাদীস নং- ১৩৬১। আল্লাহ তা’আলার হুকুম আর আল্লাহর রাসূলের এ নির্দেশনা মেনে ব্যক্তি যদি স্বনির্ভর হওয়ার চেষ্টা করে, তাহলে অনিবার্যরূপে তাঁর ব্যক্তিত্ব, যোগ্যতা, দক্ষতা ও সক্ষমতা বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হবে। এভাবে উন্নয়ন ঘটবে মানবের। অদক্ষ-অক্ষম বোঝার পরিবর্তে ব্যক্তি উন্নত সম্পদে পরিণত হবে।
কর্তব্য পালন : ইসলাম সাধারণভাবে সকল মানুষকে কর্তব্যপরায়ণ হিসেবে ঘোষণা করেছে। সকলের জন্য অর্পিত কর্তব্য পালন আবশ্যিক করেছে এবং এ ক্ষেত্রে যে কোন অবহেলাকে আল্লাহ তাআলার নিকট জবাবদিহিতার বিষয় বলে সতর্ক করেছে। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, সাবধান! তোমরা প্রত্যেকেই দায়িত্বশীল এবং তোমাদের প্রত্যেকেই তার দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে। অতএব, ইমাম বা নেতা, যিনি জনগণের ওপর দায়িত্ববান-তিনি তার অধীনদের বিষয়ে জিজ্ঞাসিত হবেন। আর ব্যক্তি, যে তার পরিবারের সদস্যদের দায়িত্বশীল- সে তার পরিবারের সদস্যদের বিষয়ে জিজ্ঞাসিত হবে। নারী দায়িত্বশীল তার স্বামীর পরিবারের সদস্যদের ও সন্তান-সন্ততির। সে তাদের সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে। আর দাস ব্যক্তি তার মনিবের সম্পদের দায়িত্বশীল এবং সে এই সম্পদের দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে। কাজেই সতর্ক হও! তোমরা প্রত্যেকেই দায়িত্বশীল এবং তোমাদের প্রত্যেকেই নিজ নিজ দায়িত্ব সম্পর্কে (পরকালে আল্লাহর নিকট) জিজ্ঞাসিত হবে। ‘‘ইমাম বুখারী, আস-সহীহ, অধ্যায় : আল-আহকাম, অনুচ্ছেদ : কাওলুল্লাহি তাআলা আতীউল্লাহ ওয়া আতীউর রসূলা ওয়া উলিল আমরি মিনকুম, প্রাগুক্ত, হাদীস নং- ৬৭১৭’’। ইসলাম একান্তভাবে মানুষকে এ শিক্ষা দিয়েছে, কেউ কারো বোঝা বহন করবে না।
আল্লাহ তাআলা অত্যন্ত স্পষ্ট ভাষায় সবাইকে জানিয়ে দিয়েছেন, যারা সরল-সঠিক পথে পরিচালিত হবে নিশ্চয় তারা তাদের নিজেদের কল্যাণের জন্যই সঠিক পথে পরিচালিত হবে। আর যারা ভ্রান্ত পথে পরিচালিত হবে তারা ভ্রান্ত পথে পরিচালিত হবে তাদের নিজেদের ধ্বংসের জন্যই। কেউ কারো কাজের দায় বহন করবে না। আর আমি রাসূল পাঠিয়ে সতর্ক করা ছাড়া কাউকে শাস্তি দেই না। ‘ আল-কুরআন, ১৭ : ১৫’। ইসলামের এ নীতি একান্তভাবে দায়িত্ব সচেতন করে এবং দায়িত্ব পালনে উদ্বুদ্ধ করে। এ নীতি মানুষকে এমনভাবে ভাবতে শেখায় যে, কেউ অন্য কারো কবরে যাবে না। কেউ অন্য কারো কাজের জবাবদিহিতা করবে না। সাধারণভাবে কেউ অন্য কারো কাজের সুফল বা দায় ভোগ করবে না। বরং প্রত্যেককে নিজ নিজ কাজের সুফল বা কুফল ভোগ করতে হবে। এ শিক্ষার ফলে মানুষ নিজেকে দায়িত্বশীল, কর্তব্যপরায়ণ হিসেবে গড়ে তোলে। এটি তার ব্যক্তি সত্তার উন্নতি বিধান করে।
যোগ্যতা অর্জন ও দক্ষতা বৃদ্ধি : ইসলাম মানুষে মানুষে মানবিক কোন ব্যবধান বা বৈষম্য স্বীকার করেনি। মানবিক মর্যাদায় সাধারণভাবে সকলকে সমান মর্যাদা ও গুরুত্ব প্রদান করেছে। মানুষের উৎস ও বিস্তার সম্পর্কে বর্ণনা দিয়ে আল্লাহ তাআলা এ বিষয়টি নির্দেশ করেছেন। আল্লাহ তাআলা বলেছেন, হে মানুষ! তোমরা তোমাদের প্রতিপালককে ভয় কর, যিনি তোমাদেরকে এক ব্যক্তি হতে সৃষ্টি করেছেন, যিনি সৃষ্টি করেছেন সে ব্যক্তি থেকে তার জোড়া, আর তাদের দুজন থেকে ছড়িয়ে দিয়েছেন অসংখ্য পুরুষ ও নারী। তোমরা আল্লাহকে ভয় কর, যাঁর নামে তোমরা একে অন্যের নিকট কিছু চাও। আর তোমরা আত্মীয়দের (হক আদায় ও সম্পর্ক অটুট রাখার) ব্যাপারে সতর্ক হও। নিশ্চয় আল্লাহ তোমাদের উপর সতর্ক দৃষ্টি রাখেন। ‘ আল-কুরআন, ০৪ : ১’
আল্লাহ তাআলা আরও বলেছেন, হে মানুষ! আমি তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছি এক পুরুষ ও এক নারী হতে, পরে তোমাদেরকে বিভক্ত করেছি বিভিন্ন জাতি ও গোত্রে, যাতে তোমরা একে অপরের সাথে পরিচিত হতে পার। ‘ আল-কুরআন, ৪৯ : ১৩’। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, হে মানবজাতি! সাবধান! নিশ্চয় তোমাদের রব একজন, তোমাদের পিতাও একজন। সতর্ক হও! কোন আরবের উপর অনারবের শ্রেষ্ঠত্ব নেই, কোন অনারবের উপর আরবের শ্রেষ্ঠত্ব নেই। কোন কালোর উপর সাদার কিংবা সাদার উপর কালোর তাকওয়া ব্যতীত কোন মর্যাদা নেই। ‘ ইমাম আহমাদ, আল-মুসনাদ, প্রাগুক্ত, হাদীস নং- ২৩৪৮৯; হাদীসটির সনদ সহীহ মুহাম্মাদ নাসিরুদ্দীন আল-আলবানী, সিলসিলাতুল আহাদিছিছ সহীহাহ, রিয়াদ: মাকতাবাতুল মা’আরিফ, হাদীস নং- ২৭০০’।
সাধারণভাবে সকল মানুষকে এভাবে সমান ঘোষণার পর কুরআন ও হাদীসে মানুষের উপর মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব ও কর্তৃত্বের জন্য বিশেষ যোগ্যতা অর্জনের তাগিদ দেয়া হয়েছে। আল্লাহ তাআলা বলেছেন, তোমাদের মধ্যে আল্লাহর নিকট সে ব্যক্তিই সবচেয়ে বেশি মর্যাদাসম্পন্ন, যে তোমাদের মধ্যে সবেচেয়ে বেশি তাকওয়াবান। নিশ্চয় আল্লাহ সবকিছু জানেন, সবকিছুর খবর রাখেন। ‘ আল-কুরআন, ৪৯ : ১৩’
পরকালীন সফলতা-ব্যর্থতার মাপকাঠি : নিঃসন্দেহে মানবসম্পদ উন্নয়নে ইসলামের সবচেয়ে বড় প্রেরণা এর পরকাল বিষয়ক মূল্যবোধ ও নীতিমালা। দুনিয়াতে একজন লোক যদি আর্থিক বা শারীরিক কিংবা সামাজিক দিক থেকে গ্রহণীয় হয় অথবা কেউ যদি সকল দিক থেকে অগ্রহণযোগ্য হয় তাহলে দুনিয়ার বিচারে লোকটির জীবন সফল হয়েছে বা ব্যর্থ হয়েছে বলা যায়। কিন্তু আখিরাতে ব্যক্তির সফলতা নির্ভর করে একান্তভাবে ব্যক্তির সঠিক বিশ্বাস, সৎকর্ম, সৎচিন্তা ও সৎ জীবনযাপনের উপর। এর অর্থ হল ব্যক্তি যদি সমাজের সঙ্গে তাল মেলানোর জন্য বা সমাজে সম্মানিত হওয়ার জন্য এমন কোন কাজ করে ইসলামের দৃষ্টিতে যা সম্মানজনক নয় তাহলে আখিরাতে তার জন্য কিছুই থাকবে না। আবার বাহ্যত অসম্মানজনক বা নিপীড়নমূলক প্রমাণ হলেও আখিরাতে হয়তো কাজটি অত্যন্ত সম্মানের হতে পারে। এ দৃষ্টিভঙ্গির কারণে দুনিয়ায় লাভ-লোকসানের বিবেচনা ছাড়া একজন মানুষ আখিরাতে সফল হওয়ার জন্য ভেতরে-বাহিরে সৎ জীবন-যাপন করার চেষ্টা করে। কাউকে দেখানোর কারো মনো:তুষ্টির আকাক্সক্ষা সে একেবারেই পোষণ করে না। সে দুনিয়াকে ততটুকুই গুরুত্ব প্রদান করে যতটুকু গুরুত্ব প্রদানের নির্দেশ আল্লাহ তাআলা দিয়েছেন। যেমন তিনি বলেছেন : তোমরা কি আখিরাতের তুলনায় দুনিয়ার জীবনে পরিতুষ্ট হয়ে গেলে? অথচ আখিরাতের তুলনায় দুনিয়ার জীবনের উপকরণ অত্যন্ত কম। ‘ আল-কুরআন, ০৯ : ৩৮’। অন্যত্র তিনি বলেন, আখিরাত তো নিশ্চয় শ্রেষ্ঠতম পর্যায় এবং মর্যাদায় মহত্তম। ‘আল-কুরআন, ১৭ : ২১’। দুনিয়া ও আখিরাতের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষার্থে আল্লাহ তাআলা বলেন, আল্লাহ তোমাকে যা দিয়েছেন তা দিয়ে আখিরাতের আবাস অনুসন্ধান কর, তবে তোমার দুনিয়ার অংশ ভুলে যেয়ো না। ‘ আল-কুরআন, ২৮ : ৭৭’
আখিরাতের বিশ্বাস মানুষকে কেবল সৎকাজ করতেই উদ্বুদ্ধ করে না; বরং কাজটি একান্তভাবে আল্লাহ তাআলার জন্য করতে উদ্বুদ্ধ করে। কারণ আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টির উদ্দেশ্য ছাড়া অন্য উদ্দেশ্যে সৎকাজ করা হলে তা পুরস্কারযোগ্য হয় না। তাও শাস্তিযোগ্য আমলে পরিণত হয়। এ প্রসঙ্গে রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন : কিয়ামাতের দিন মানুষের মধ্যে প্রথম যার বিচার হবে সে হবে একজন শহীদ। তাকে আল্লাহর দরবারে নিয়ে আসা হবে। আল্লাহ তাকে তাঁর নিআমতসমূহের কথা স্মরণ করিয়ে দেবেন। সেও তা স্মরণ করবে। আল্লাহ তাকে জিজ্ঞাসা করবেন, তুমি দুনিয়াতে এর বিনিময়ে কী কাজ করেছো? সে উত্তর দেবে- আমি তোমার পথে যুদ্ধ করেছি; এমনকি শেষ পর্যন্ত শহীদ হয়েছি। আল্লাহ বলবেন, তুমি মিথ্যা বলছো। বরং তুমি এ জন্যে যুদ্ধ করেছো যেনো তোমাকে বীরপুরুষ বলা হয়। আর তা তোমাকে বলা হয়েছে। এরপর তার ব্যাপারে ফেরেশতাগণকে আদেশ করা হবে। তারা তাকে উপুড় করে টেনে টেনে জাহান্নামে নিক্ষেপ করবে।
দ্বিতীয়ত যার বিচার হবে সে হবে একজন আলিম। সে নিজে শিক্ষা লাভ করেছে, অপরকে তা শিখিয়েছে এবং কুরআন পড়েছে। তাকে আল্লাহর দরবারে নিয়ে আসা হবে। আল্লাহ তাকে তাঁর নিআমতসমূহের কথা স্মরণ করিয়ে দেবেন। সেও তা স্মরণ করবে। আল্লাহ তাকে জিজ্ঞাসা করবেন, তুমি দুনিয়াতে এর বিনিময় কী কাজ করেছো? সে উত্তর দেবে, দুনিয়াতে আমি শিক্ষা লাভ করেছি, অন্যকে শিখিয়েছি এবং তোমার সন্তুষ্টি লাভের জন্য কুরআন মাজীদ তেলাওয়াত করছি। আল্লাহ বলবেন- তুমি মিথ্যা বলছো। বরং তুমি এ জন্যে জ্ঞান অর্জন করেছিলে যেনো তোমাকে জ্ঞানী বলা হয়। কুরআন মাজীদ এ জন্যে তেলাওয়াত করেছি যেনো তোমাকে কারী বলা হয়। আর তোমাকে তা বলা হয়েছে। এরপর তার ব্যাপারে ফেরেশতাগণকে আদেশ করা হবে। তারা তাকে উপুড় করে টেনে টেনে জাহান্নামে নিক্ষেপ করবে।
তৃতীয়ত যার বিচার হবে সে হবে একজন সম্পদশালী ব্যক্তি। আল্লাহ তাকে সচ্ছল করেছেন এবং বিপুল সম্পদ দিয়েছেন। তাকে আল্লাহর দরবারে নিয়ে আসা হবে। আল্লাহ তাকে তাঁর নিআমতসমূহের কথা স্মরণ করিয়ে দেবেন। সেও তা স্মরণ করবে। আল্লাহ তাকে জিজ্ঞাসা করবেন, তুমি দুনিয়াতে এর বিনিময়ে কী কাজ করেছো? সে উত্তর দেবে, যে পথে খরচ করলে তুমি খুশি হও, সে জাতীয় সব পথেই তোমার সন্তুষ্টির জন্য আমি খরচ করেছি। আল্লাহ বলবেনÑ তুমি মিথ্যা বলছো। বরং তুমিতো এগুলো এ জন্যে করেছো যেনো তোমাকে দানবীর বলা হয়। আর তোমাকে তা বলা হয়েছে। এরপর তার ব্যাপারে ফেরেশতাকে আদেশ করা হবে। তারা তাকে উপুড় করে টেনে জাহান্নামে নিক্ষেপ করবে। ‘‘ ইমাম মুসলিম, আস-সহীহ, তাহকীক : মুহাম্মাদ ফুয়াদ আব্দুল বাকী, অধ্যায় : আল-ইমারাহ, অনুচ্ছেদ : মান কাতালা লির-রিয়াই ওয়াস সুমআতি ইসতাহাক্কান নার, বৈরূত : দারুল ইহইয়াইত তুরাছিল আরাবিয়্যি, খ. ৩, হাদীস নং- ১৯০৫’’। আল্লাহ তাআলা অত্যন্ত সংক্ষেপে কিন্তু স্পষ্টভাষায় ঘোষণা করেছেন, কাজেই ধ্বংস সেই সকল সালাত আদায়কারীর জন্য, যারা তাদের সালাত সম্বন্ধে উদাসীন, যারা লোক দেখানোর জন্য সালাত আদায় করে। ‘আল-কুরআন, ১০৭:৪-৬’। বস্তুত আখিরাতে সফলতা লাভই মুমিনের মূল লক্ষ্য। এ কারণে ইসলামে বিশ্বাসী একজন লোক দুনিয়ার সকল কাজই আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য করেন। যে কারণে তার মধ্যে লোক দেখানোর বিষয়টি একেবারেই থাকে না। ফলে মানসিক দিক থেকে তিনি পরম উৎকর্ষ লাভ করতে সক্ষম হন। কোন ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর প্রতি বিদ্বেষ বা প্রেম তাকে কোনক্রমেই মন্দ কাজে নিয়োজিত করতে পারে না।
নৈতিক উন্নয়ন : নৈতিক উন্নয়ন ছাড়া যে কোন উন্নয়নই ব্যর্থতায় পর্যবসিত হতে বাধ্য। তাই রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, আমি প্রেরিত হয়েছি সুমহান নৈতিক গুণাবলীর পূর্ণতা সাধনের জন্য। ‘‘ ইমাম আহমাদ, আল-মুসনাদ, প্রাগুক্ত, হাদীস নং- ৮৯৫২। মুহাম্মাদ নাসিরুদ্দীন আল-আলবানী, সিলসিলাতুল আহাদীসিছ সহীহাহ, প্রাগুক্ত, হাদীস নং-৪৫’’। আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) কে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, কোন কাজ অধিকাংশ লোককে জান্নাতে প্রবেশ করাবে? তিনি উত্তরে বলেছেন, কিয়ামাতের দিন যে জিনিসটি মুমিনের পাল্লায় সবচেয়ে ভারি হবে তা হল ‘তাকওয়া ও উত্তম চরিত্র। ‘‘ ইমাম তিরমিযী, আস-সুনান, অধ্যায় : আল-বির ওয়াস সিলা, অনুচ্ছেদ : হুসনুল খুলুক, প্রাগুক্ত, হাদীস নং-২০০৪। হাদীসটির সনদ হাসান ; মুহাম্মাদ নাসিরুদ্দীন আল-আলবানী, সহীহ ওয়া যঈফ সুনানুত তিরমিযী, হাদীস নং-২০০৪’’। রাসূলুল্লাহ স. আরও বলেছেন, কিয়ামতের দিন যে জিনিসটি মুমিনের পাল্লায় সবচেয়ে ভারি হবে তা হল উত্তম চরিত্র। ‘‘ ইমাম আবু দাউদ, আস-সুনান, অধ্যায় : আল-আদাব, অনুচ্ছেদ : ফী হুসনিল খুলুক, বৈরূত : দারুল কিতাবিল আরাবিয়্যি, তা.বি., খ. ৪, পৃ. ৪০০; হাদীস নং- ৪৮০১। হাদীসটির সনদ সহীহ মুহাম্মাদ নাসিরুদ্দীন আল-আলবানী, সহীহ ওয়া যঈফ আবি দাউদ, হাদীস নং- ৪৭৯৯’’।
নাওয়াস ইবনে সামআন আল-আনসারী বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (সা.) কে বির সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলে তিনি উত্তরে বলেছেন, ‘সুন্দর ব্যবহারই পুণ্য। ‘‘ইমাম মুসলিম, আস-সহীহ, অধ্যায় : আল-বির ওয়াস সিলাতি ওয়াল আদাব, অনুচ্ছেদ : তাফসীরুল বিররি ওয়াল ইছমি, প্রাগুক্ত, খ. ৪, হাদীস নং- ২৫৫৩’’। তিনি সত্যিকার ও পূর্ণ মুমিন হিসেবে সে ব্যক্তিকেই অভিহিত করেছেন যার চরিত্র সুন্দর। তিনি বলেছেন, চরিত্রের বিচারে যে উত্তম মুমিনদের মধ্যে সেই পূর্ণ ঈমানের অধিকারী। ‘‘ইমাম আবু দাউদ, আস-সুনান, অধ্যায় : আস-সুন্নাহ, অনুচ্ছেদ : আদ-দলীলু আলা যিয়াদাতিল ঈমানি ওয়া নুকসানিহী, প্রাগুক্ত, খ. ৪, পৃ. ৩৫৪; হাদীস নং- ৪৬৮৪। হাদীসটির সনদ হাসানসহীহ মুহাম্মাদ নাসিরুদ্দীন আল-আলবানী, সহীহ ওয়া যঈফ সুনানি আবি দাউদ, হাদীস নং-৪৬৮২’’।
আব্দুল্লাহ ইবনু উমার (রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, একবার আমি রাসূলুল্লাহ (সা.) এর সাথে ছিলাম। এমন সময় জনৈক আনসারী ব্যক্তি এসে রাসূলুল্লাহ (সা.) কে সালাম করলেন, তারপর জিজ্ঞেস করলেন, ইয়া রাসূলুল্লাহ মুমিনদের মধ্যে সর্বোত্তম কে? তিনি জবাব দিলেন, তাদের মধ্যে সর্বোত্তম ব্যক্তি হলো সেই ব্যক্তি যার চরিত্র সর্বোত্তম। ‘‘ইমাম ইবনু মাযাহ, আস-সুনান, অধ্যায় : আয-যুহদ, অনুচ্ছেদ : যিকরুল মাওতি ওয়াল ইসতিদাদ, প্রাগুক্ত, হাদীস নং- ৪২৫৯। হাদীসটির সনদ সহীহ মুহাম্মাদ নাসিরুদ্দীন আল-আলবানী, সিলসিলাতুল আহাদীছিছ সহীহাহ, প্রাগুক্ত, হাদীস নং ১৩৮৪’’। কুরআন মাজীদে আল্লাহ তাআলা মুমিনের অসংখ্য নৈতিক গুণের কথা উল্লেখ করেছেন। যেমন তিনি বলেছেন : নিশ্চয় মুমিনগণ সফল, যারা তাদের সালাতে ভীত ও বিনয়ী, যারা নিজেদেরকে অর্থহীন কাজ থেকে বিরত রাখে, যারা যাকাত প্রদানের ক্ষেত্রে কর্মতৎপর হয় এবং যারা নিজেদের যৌনাঙ্গ হিফাযত করে। ‘‘আল-কুরআন, ২৩: ১-৫’। বস্তুত ইসলাম যে বিষয়গুলোকে চরিত্রের সুন্দর দিক এবং অবশ্য অর্জনীয় গুণ হিসেবে ঘোষণা করে সেগুলোকে আত্মার গুণ হিসেবে আত্মস্থ করা, নৈতিক বৈশিষ্ট্যের পরিণত করা এবং জীবনাদর্শ হিসেবে গ্রহণ করা গেলে স্বভাবতই মানুষ সম্পদে পরিণত হবে। যে সম্পদ দুনিয়ায় ব্যক্তির নিজের এবং অপরাপর সকলের কল্যাণ ও মুক্তি নিশ্চিত করবে। প্রসঙ্গত নৈতিক উন্নয়নে ইসলামের কিছু নির্দেশনা উল্লেখ করা যায়। যেমন,
১. কুরআন অধ্যয়ন : কুরআন হচ্ছে মুমিনের গাইড লাইন, জীবন বিধান। এর মধ্যে আল্লাহ তাআলা মানুষের করণীয়-বর্জনীয় সম্পর্কে বিস্তারিত নির্দেশনা দিয়েছেন। সুন্দর চরিত্র গড়ে তোলার জন্য সবার আগে তাই কুরআন অধ্যয়ন করা প্রয়োজন। কুরআন অধ্যয়ন বলতে শুধু দেখে তেলাওয়াত বুঝায় না। বরং কুরআন অধ্যয়ন হলো এর মমার্থ, তাৎপর্য, তাৎপর্য ও গুরুত্ব অনুধাবন করে পড়া। শুধু দেখে দেখে কুরআন তিলাওয়াত করলে চরিত্রের উপর তার সর্বব্যাপক প্রভাব পড়বে না। তাই সুন্দর চরিত্র গড়ে তুলতে হলে বুঝে কুরআন তেলাওয়াত করতে হবে। বুঝে কুরআন তেলাওয়াত না করে শুধু দেখে তেলাওয়াত করলে সওয়াব পাওয়া যাবে, কিন্তু তাতে কুরআন নাযিলের উদ্দেশ্য সাধিত হবে না। কুরআন নাযিলের উদ্দেশ্য হল, কুরআনকে চরিত্রে পরিণত করা। যেমন আল্লাহর রাসূল (সা.)-এর ইন্তিকালের পর সাহাবীগণ যখন তাঁর চরিত্র সম্পর্কে জানতে চাইলেন, আয়িশা (রা.) বিনা দ্বিধায় বলে দিলেন। অর্থাৎ তোমরা যে কুরআন পড় সে কুরআনই তাঁর চরিত্র। ‘‘ইমাম বুখারী, আল-আদাবুল মুফরাদ, তাহকীক : মুহাম্মাদ ফুয়াদ আব্দুল বাকী, অধ্যায়: হুসনুল খুলুক, অনুচ্ছেদ: মান দাআল্লাহ আন ইউসিনা খুলুকাহু, বৈরূত: দারুল বাশাইর আল-ইসলামিয়্যাহ, তৃতীয় সংস্করণ, ১৪০৯ হি./১৯৮৯ খ্রি., পৃ. ১১৬, হাদীস নং- ৩০৮। মুহাম্মাদ ফুয়াদ আব্দুল বাকী হাদীসটির সনদ যঈফ বললেও মুহাম্মাদ নাসিরুদ্দীন আল-আলবানী হাদীসটির সনদকে সহীহ লি-গাইরিবহ বলেছেন; সহীহ আল-আদাবুল মুফরাদ লিল ইমাম আল-বুখারী, আল-জুবাইল, সৌদি আরব: দারুস সিদ্দীক, ১৪২১ হি., হাদীস নং- ২৩৪/৩০৮’’। একজন ব্যক্তি যদি দাবি আদায় করে আল-কুরআন তিলাওয়াত করেন, তাহলে কুরআনই তাকে পথ দেখিয়ে দেবে। আর কুরআন মাজীদের শিক্ষা ব্যক্তির আত্মিক-আচরণিক ও বৈষয়িক উন্নতিতে সন্দেহাতীতভাবে ইতিবাচক প্রভাব রাখতে সক্ষম হবে।
২. হাদীস অধ্যয়ন : আল-কুরআনের ব্যাখা হলো হাদীস। কুরআন মাজীদে আল্লাহ তাআলা যে কোনো হুকুমের মূলনীতি বর্ণনা করেছেন। হাদীসে রাসূলুল্লাহ (সা.) সে মূলনীতি বাস্তবায়নের পথনির্দেশ করেছেন। রাসূলুল্লাহ সা. নিজে থেকে কোনো কথা বা তত্ত্ব হাদীসের মাধ্যমে পেশ করেননি। আল্লাহ তাআলা বলেছেন। আর তিনি (মুহাম্মাদ সা.) নিজে প্রবৃত্তি থেকে কোনো কথা বলেন না। তাঁর নিকট প্রেরিত ওহী ছাড়া এগুলো আর কিছু নয়। ‘আল-কুরআন, ৫৩ : ৩-৪’’।
অন্যত্র সকল মানুষকে আল্লাহ তাআলা আদেশ দিয়েছেন। রাসূল তোমাদেরকে যা দেন (অর্থাৎ যা করতে নির্দেশ দেন) তা গ্রহণ করো আর যা থেকে তিনি বিরত থাকতে বলেন, তা থেকে বিরত থাকো। ‘‘আল-কুরআন, ৫৯ : ৭’’। তাই কুরআন মাজীদের বিধি ও অনুশাসন সঠিকভাবে মেনে চলার জন্য হাদীস অধ্যয়ন করতে হবে। হাদীস অধ্যয়নও ব্যক্তির সামগ্রিক উন্নয়নে ভূমিকা রাখতে সক্ষম হবে।
৩. সত্য বলা : সত্য কথা বলা সুন্দর চরিত্রের শ্রেষ্ঠতম প্রকাশ। সত্যবাদী হওয়া ছাড়া মুমিন হওয়া যায় না। ইসলাম সত্য, বাকী সবকিছু মিথ্যা। এখন কেউ যদি সত্যকে ধারণ করে সে ধারণ করবে ইসলামকে। আর কেউ যদি মিথ্যা বলার অভ্যাস করে, সে অবশ্যই ইসলাম বর্জনকারী হবে। সত্য মানুষকে সততার পথে পরিচালিত করে, আর মিথ্যা পাপের পথে পরিচালিত করে। এ প্রসঙ্গে রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন- নিশ্চয়ই সত্য মানুষকে সততার পথ দেখায়, আর সততা জান্নাতের পথ দেখায় এমনকি কোন ব্যক্তি সত্য বলতে বলতে আল্লাহর নিকট সিদ্দীক বা পরম সত্যবাদী হিসাবে লিখিত হয়, আর মিথ্যা মানুষকে পাপাচারের পথ দেখায়, আর পাপাচার জাহান্নামের পথ দেখায়, এমনকি কোন ব্যক্তি মিথ্যা বলতে বলতে আল্লাহর নিকট কাযযাব বা চরম মিথ্যাবাদী হিসাবে লিখিত হয়। ‘‘ইমাম বুখারী, আস-সহীহ, অধ্যায় : আল-আদাব, অনুচ্ছেদ: কাওলুল্লাহি তাআলা ইয়া আইয়ূহাল্লায়িনা আমানুত্তাকুল্লাহি ওয়া কুনু মাআস সহিকীন, ওয়ামা ইউনা আনিল কিযব, প্রাগুক্ত, হাদীস নং- ৫৭৪৩’’। সত্যবাদীগণ আল্লাহ তাআলার পরম সন্তোষ ও সাফল্য লাভ করে থাকেন। যেমন, আল্লাহ বলেন, এটা তো সেদিন, যেদিন সত্যবাদীরা তাদের সত্যবাদিতার জন্য উপকৃত হবে, তাদের জন্য রয়েছে এমন জান্নাত যার নিচ দিয়ে ঝর্ণাসমূহ বয়ে যায়, সেখানে তারা চিরদিন থাকবে। আল্লাহ তাআলা তাদের প্রতি সন্তুষ্ট, তারাও আল্লাহর প্রতি সন্তুষ্ট। এটাই তো মহাসাফল্য। ‘আল-কুরআন, ০৫ : ১১৯’। সত্য বলার অভ্যাস মানুষের ব্যক্তিত্বকে এমন উন্নত করবে যে, সে সকলের বিশ্বাসভাজন হবে।
৪. সবর : সবর বা ধৈর্য ধারণ করা সুন্দর চরিত্রের একটি অনিবার্য দিক। ধৈর্যধারণ ছাড়া সুন্দর চরিত্র সার্থক ও অর্থবহ হয় না। সুন্দর চরিত্রের অধিকারী হতে হলে তাই ধৈর্যের অনুশীলন করতে হবে। কুরআন মাজীদে এসেছে, আল্লাহ তা’আলা ভালোবাসেন ধৈর্যশীলদের। ‘আল-কুরআন, ০৩ : ১৪৬’। অন্য আয়াতে তিনি বলেন, নিশ্চয়ই আল্লাহ আছেন ধৈর্যশীলদের সাথে। ‘আল-কুরআন, ০২ : ১৫৩’।
রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, সবর বা ধৈর্যের বিনিময় হলো জান্নাত। ‘‘ইমাম বায়হাকী, শুআবুল ঈমান, অনুচ্ছেদ : ফাযায়িল শাহরি রমাযান, প্রাগুক্ত, হাদীস নং- ৩৬০৮। হাদীসটির সনদ মুনকার মুহাম্মাদ নাসিরুদ্দীন আল-আলবানী, সিলসিলাতুল আহাদীছিয যঈফা ওয়াল মাওযূআহ… প্রাগুক্ত, হাদীস নং- ৮৭১’’। তিনি আরো বলেছেন, সবর বা ধৈর্য ঈমানের অর্ধাংশ। ‘‘ ইমাম বায়হাকী, শুআবুল ঈমান, অনুচ্ছেদ : ফিস সবরি আলাল মাসায়িব.. প্রাগুক্ত, হাদীস নং-৯৭১৬। হাদীসটির সনদ মুনকার মুহাম্মাদ নাসিরুদ্দীন আল-আলবানী, সিলসিলাতুল আহাদীছিয যঈফা… প্রাগুক্ত, হাদীস নং- ৪৯৯’’। ধৈর্যশীল মানুষ নিঃসন্দেহে অনন্য গুণের অধিকারী। মানবকে সম্পদে পরিণত করার অন্যতম মৌলিক এ গুণটি অর্ঝন করা ইসলাম মুমিনের জন্য আবশ্যিক করেছে।
৫. কৃতজ্ঞতা : আল্লাহ তাআলা মানুষকে অসংখ্য নিআমাত দিয়েছেন। আল্লাহ তাআলার এ নিআমতসমূহের বিনিময়ে তাঁর আদেশ পালন করা হলো কৃতজ্ঞতা জানানো। আল্লাহ তাআলার আদেশ মেনে চললে মানুষ কোনো খারাপ কাজ করতে পারবে না। ফলে তার চরিত্র সুন্দর হবে। আল্লাহ তাঁর নিআমত আরো অধিক হারে শোকরকারীকে দান করবেন। যেমন তিনি বলেছেন, যদি তোমরা শোকর করো, তাহলে অবশ্যই আমি তোমাদের নিআমত বাড়িয়ে দেববো। ‘ আল-কুরআন, ১৪ : ৭’। যারা আল্লাহ তাআলার নিআমতের শোকর করে তাদের পক্ষেই অন্যান্যদের উপকার স্বীকার করা এবং কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা সম্ভব। কৃতজ্ঞ মানুষকে আল্লাহ তাআলা যেমন ভালোবাসেন তেমনি মানুষও কৃতজ্ঞ মানুষের জন্য আরও কিছু করার আগ্রহ পোষণ করে থাকেন। ইসলামের শিক্ষা মানুষকে কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন অভ্যস্ত করে তোলে। এতে ব্যক্তি সর্বজনপ্রিয় ও শ্রদ্ধেয় হয়ে ওঠে।
৬. আমানত সুরক্ষা : মানুষের নৈতিক উন্নয়ন অন্যতম শ্রেষ্ঠ প্রকাশ আমানতদারিতা। আমানতদারিতা এক মহান নৈতিক গুণ। এ গুণ মানুষের কাছে মানুষকে বিশ্বাসভাজন ও ভালোবাসার পাত্র করে তোলে। মানুষ অবলীলায় তার কথা শোনে। তার কাছে তাদের সম্পদ এমনকি সম্মান পর্যন্ত আমানত রাখতে দ্বিধাবোধ করে না। ঈমান ও আমানতদারিতা অবিচ্ছেদ্য বিষয়। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, যার আমানতদারিতা নেই তার ঈমান নেই। ‘‘ইমাম বায়হাকী, শুআবুল ঈমান, অনুচ্ছেদ : ফিল ঈফা-ই বিল উকূদ, প্রাগুক্ত, হাদীস নং-৪৩৫৪; হাদীসটির সনদ সহীহ মুহাম্মাদ নাসিরুদ্দীন আল-আলবানী, সহীহ আত-তারগীব ওয়াত তারহীব, প্রাগুক্ত, হাদীস নং- ৩০০৪’’। আল্লাহ তাআলা আমানত সুরক্ষাকে ফরয করেছেন। কুরআন মাজীদে এসেছে, নিশ্চয় আল্লাহ তোমাদেরকে আদেশ দিচ্ছেন আমানতসমূহ তার হকদারের কাছে ফিরিয়ে দিতে। ‘আল-কুরআন, ০৪ : ৫৮’। মানবসম্পদ উন্নয়নে গৃহীত বিপুল কর্মসূচি, বিস্তারিত কর্মশালা দিয়ে ব্যক্তির ভেতর আমানতদারিতা তৈরির নিরন্তর চেষ্টা পরিচালনা করতে দেখা যায়। অথচ ঈমান ও ইসলামের শিক্ষা ব্যক্তিকে আখিরাতে জবাবদিহিতার চেতনায় স্বভাবতই আমানতদার করে তোলে।
৭. ওয়াদা পালন : ওয়াদা এক ধরনের আমানত। কাউকে কথা দিলে তা রাখতে হয়। ওয়াদা করলে তা পালন করতে হয়। আল্লাহ তাআলা ওয়াদালঙ্ঘনকারীকে ভালোবাসেন না। তিনি ওয়াদা পালনের আদেশ দিয়ে বলেন, মুমিনগণ! তোমরা চুক্তিসমূহ পূর্ণ করো। ‘আল-কুরআন, ০৫ : ০১’। রাসূলুল্লাহ (সা.) নিজে ওয়াদা রক্ষা করেছেন। তাঁর সাহাবীগণ এ ব্যাপারে তাঁকে পুরোপুুরি অনুসরণ করেছেন। ওয়াদা পালন প্রতিশ্র“তি রক্ষা মানবিক উন্নয়নের অন্যতম দৃষ্টান্ত। ঈমান আনার সাথে সাথে ব্যক্তি প্রতিশ্র“তি পালনেও প্রত্যয় গ্রহণ করে।
৮. হিংসা-বিদ্বেষ থেকে বেঁচে থাকা : সুন্দর চরিত্রের অধিকারী হওয়ার প্রধান উপায় হলো হিংসা-বিদ্বেষ পরিহার করা। হিংসা, অহঙ্কার, ঘৃণা, নিজেকে বড় এবং অন্যকে নীচ মনে করার হীনমানসিকতা সুন্দর চরিত্রের সম্পূর্ণ বিরোধী বিষয়। রাসূলুল্লাহ (সা.) হিংসা-অহঙ্কারকে পুণ্য ধ্বংসের কারণ হিসেবে বর্ণনা করেছেন। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, তোমরা হিংসা-বিদ্বেষ থেকে বেঁচে থাকো। কেননা আগুন যেমন কাঠ ভস্মীভূত করে, হিংসা-বিদ্বেষও তেমনি সৎ আমল নষ্ট করে। ‘‘ইমাম আবু দাউদ, আস-সুনান, অধ্যায়: আল-আদাব, অনুচ্ছেদ : আল-হাসাদ, প্রাগুক্ত, হাদীস নং-৪৯০৫। হাদীসটির সনদ যঈফ; মুহাম্মাদ নাসিরুদ্দীন আল-আলবানী, সিলসিলাতুল আহাদীছিয যঈফা….. প্রাগুক্ত, হাদীস নং-১৯০২’’। হিংসা-বিদ্বেষ মানবিক গুণ বিরোধী। এটি মানুষকে দাম্ভিক করে। এমন ব্যক্তি কোন কাজে সফল হতে পারে না। মানবসম্পদ উন্নয়নের ক্ষেত্রে বিশেষভাবে তাই হিংসা-বিদ্বেষ থেকে ব্যক্তিকে মুক্ত করার কথা বলা হয়ে থাকে। ঈমান এমন একটি অনন্য প্রশিক্ষণ, যা মানুষকে হিংসা-বিদ্বেষ থেকে দূরে রেখে সকলের নিকট প্রিয় এবং শ্রদ্ধেয় করে তোলে।
৯. ধূমপান ও মাদকাসক্তি থেকে দূরে থাকা : মানবসম্পদ ধ্বংসের ক্ষেত্রে ধূমপান ও মাদকাসক্তির কুপ্রভাব অত্যন্ত কার্যকর। ইসলাম তাই ধূমপান ও মাদকাসক্তি ত্যাগের নির্দেশনা দিয়েছে। ধূমপানে অর্থ-সম্পদের অপচয় হয়, ব্যক্তির নিজের ও অন্যের ক্ষতি হয়। আল্লাহ তাআলা এসবই হারাম ঘোষণা করে বলেছেন: আর কোনোক্রমেই অপচয় করবে না। ‘ আল-কুরআন, ১৭ : ২৬’। নিজেদের হাতে নিজেদেরকে ধ্বংসের মধ্যে নিক্ষেপ করো না। ‘ আল-কুরআন, ০২ : ১৯৫’।
অন্যদিকে আল্লাহ তাআলা মাদক সেবনকে সরাসরি হারাম ঘোষণা করেছেন। তিনি বলেছেন, হে মুমিনগণ! মদ, জুয়া, মূর্তিপূজার বেদী এবং ভাগ্য নির্ধারক তীর অবশ্যই শয়তানের অপবিত্র ও ঘৃণ্য কাজের অন্তর্ভুক্ত। কাজেই তোমরা তা বর্জন করো, তাহলে তোমরা কল্যাণ লাভ করবে। ‘ আল-কুরআন, ০৫ : ৯০’। বিভিন্ন সংস্থা এবং দেশ এমনকি আন্তর্জাতিক নানা সংঘ ধূমপান ও মাদকাসক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেও তেমন কোন সুফল অর্জন করতে পারেনি। ফলে এর ক্ষতি থেকে মানবজাতিকে সঠিকভাবে রক্ষা করা তাদের পক্ষে সম্ভব হয়নি। অথচ ইসলামের ঘোষণা ও শিক্ষা এক্ষেত্রে মুমিনকে ধূমপান ও মাদকাসক্তি থেকে প্রকৃতার্থেই দূরে রাখতে সক্ষম।
১০. কথা ও কাজে মিল রাখা : কথায়-কাজে মিল রাখা সুন্দর চরিত্র অর্জনের অন্যতম মাধ্যম। আল্লাহ তাআলা কথা-কাজের অমিলকে হারাম ঘোষণা করেছেন। তিনি বলেছেন, হে মুমিনগণ! তোমরা এমন কথা কেন বলো, যা তোমরা করো না? আল্লাহর নিকট এটা অত্যন্ত অপ্রিয় যে, তোমরা যা বলো তা করো না। ‘ আল-কুরআন, ০৬ : ২-৩’। মানবসম্পদের প্রকৃত উন্নয়ন সাধনের জন্য কথা ও কাজের মিল থাকা আবশ্যক। কারণ কথা ও কাজের বৈপরীত্ব থাকলে মানুষকে প্রকৃত মানুষ বলা চলে না। এমন মানুষকে কেউ ভালোবাসে না। বিশ্বাসও করে না। কথা ও কাজের মিল প্রতিষ্ঠাকে ঈমানে অনিবার্য শর্ত করে দিয়ে ইসলামে মানবসম্পদ উন্নয়নের ঈমানী ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে।
উপসংহার : বস্তুত মানুষের প্রকৃত উন্নয়ন, মানবিক ও নৈতিক গুণে বিভূষিত হওয়া, মানুষকে আত্মিক ও বাহ্যিক দিক থেকে সত্যিকার গুণ ও আচরণে সমৃদ্ধ সম্পদে পরিণত করার ক্ষেত্রে আধুনিক বিশ্বে প্রচলিত সকল চেষ্টাই ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছে। সে কারণে তথাকথিত সভ্য সমাজে, অফিসে, দেশে, পরিবারে মানুষের কাছে মানুষের নিরাপত্তা প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে। মানুষই মানুষের সম্পদ, সম্মান ও জীবনের হুমকিতে পরিণত হচ্ছে। মানুষের আচরণ স্বার্থপরতা, হীনতা ও পাশবিকতায় ভরে ওঠেছে। এ অবস্থা নির্মূল করে মানুষকে সত্যিকারার্থে সম্পদে পরিণত করার জন্য ইসলামী আদর্শ ও শিক্ষার অনুশীলন অনিবার্যÑআলোচ্য নিবন্ধে উপস্থাপিত তথ্য, প্রমাণ ও বিশ্লেষণ এ বিষয়টির অবিসংবাদিত প্রমাণ। এ কারণে মানবসম্পদের চিরস্থায়ী উন্নয়ন নিশ্চিত করার জন্য সর্বক্ষেত্রে ইসলামের অনুশীলন অনিবার্য।
লেখক : শিক্ষাবিদ, কলামিষ্ট ও সাহিত্যিক। (সমাপ্ত)