দু’চারটা গাড়ি পুড়িয়ে সরকার ফেলে দেয়া যাবে না

19

সিলেটে জনতার জনসমুদ্রে শেখ হাসিনা

স্টাফ রিপোর্টার

বোমাবাজি ও আগুন সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার আহŸান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, বিএনপি বলে নির্বাচন প্রতিহত করবে। এতো সাহস তারা পায় কোথায়। লন্ডনে বসে একটা কুলাঙ্গার নির্দেশ দেয়, আর এখানে জ্বালাও পুড়াও করে মানুষ হত্যা করে। আমি শুধু এইটুকু বলতে চাই, দু চারটা গাড়ি পুড়িয়ে সরকার ফেলে দেয়া যাবে না। নির্বাচন ঠেকানো যাবে না। বরং আগুন নিয়ে খেলতে গেলে আগুনেই হাত পুড়ে যাবে। বুধবার বিকেলে সিলেট নগরীরর আলিয়া মাদ্রাসা মাঠে জেলা ও মহানগর আওয়ামী লীগ আয়োজিত বিশাল জনসভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন। এই জনসভার মাধ্যমেই আনুষ্ঠানিকভাবে নির্বাচনী প্রচারণা শুরু করলেন তিনি।
এসময় প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমার হারানোর কিছু নেই, আমি সব হারিয়েছি। কেবল এক বোন ছাড়া আমার আর কেউ নেই। এই জনগণই আমার সব। তাই আমাকে ভয় দেখিয়ে লাভ নেই।
আগামী নির্বাচনে নৌকায় ভোট চেয়ে তিনি বলেন, এই নৌকা নুহু নবীর নৌকা। এই নৌকা মানব জাতিকে রক্ষা করেছে। নৌকায় ভোট দিয়ে বাংলাদেশের মানুষ স্বাধীনতা পেয়েছে, উন্নয়ন পেয়েছে। আবার আপনারা নৌকায় ভোট দিয়ে জয়যুক্ত করুন। বাংলাদেশকে কেউ দাবায়ে রাখতে পারবে না।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ২০০১ সালে আমেরিকা প্রস্তাব দিয়েছিলো দেশের গ্যাস বিক্রি করতে হবে। আমি রাজী হইনি। এ কারনে আমাদের ক্ষমতায় আসতে দেয়া হলো না। গ্যাস বিক্রির মুচলেখা দিয়ে ক্ষমতায় এলো বিএনপি। এরপর শুরু হলো দুঃশাসন।
তিনি বলেন, আমরা যখন উন্নয়ন করছি, বিএনপি তখন আগুন দিয়ে মানুষ পুড়াচ্ছে। দেশের সম্পদ ধ্বংস করছে। ২০১৩ সালেও তারা এমনটি করেছিলো। ২০১৩ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত ৩ হাজারের মতো মানুষ পুড়িয়েছে তারা। ২০১৮ সালে ভোটে এসে তারা নমিনেশন বানিজ্য শুরু করলো। তারা নিজেদের কারণেই ডুবেছে।
গত ১৫ বছরে উন্নয়নের চিত্র তুলে ধরে তিনি বলেন, বিএনপির আমলে দারিদ্রের হার ছিলো ৪১ ভাগ। এখন আমরা ১৮ ভাগে নামিয়ে এনেছি। মাথাপিছু আয় অনেক বেড়ে গেছে। এ দেশের কোন মানুষ যেন ভূমিহীন ও গৃহহীন না থাকে এ জন্য ৮ লক্ষ ৪১ হাজার ঘর নির্মান করে দিয়েছি। ৮ লক্ষ মানুষকে আমরা বয়স্ক ও বিধবা ভাতা দেই। শিক্ষা বৃত্তি ও উপবৃত্তি পাচ্ছে প্রায় ৩ কোটি শিক্ষার্থী। সাক্ষরতার হার ৪৫ ভাগ থেকে ৭৫ ভাগে উন্নীত করেছি। ১ কোটি থেকে খাদ্য উৎপাদন ৯ কোটিতে উন্নীত করেছি। তবে সবাই খেয়াল রাখবেন, কোন জমি যেন পতিত না থাকে। নিজের খাদ্য নিজেই উৎপাদন করেন।
তিনি বলেন, আজকের বাংলাদেশ ডিজিটাল বাংলাদেশ। আজকে সবার হাতেই মোবাইল ফোন। ৯৬ সালে ক্ষমতায় এসে আমরা মোবাইল ফোন দিয়েছি। এখন গ্রামেগঞ্জেও ইন্টারনেট আছে।
সিলেট মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি এবং সাধারন সম্পাদক জাকির আহমদ ও জেলা কমিটির সাধারন সম্পাদক নাসির উদ্দিন খানের সঞ্চালনায় জনসভায় আওয়ামী লীগ সভানেত্রী বলেন, আমরা ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার কথা বলেছিলাম, তা করেছি। এখন আমরা স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ে তুলবো। আবার নির্বাচিত হলে আধুনিক প্রযুক্তিজ্ঞান সম্পন্ন বাংলাদেশ গড়ে তুলবো।
তিনি বলেন, ৮১ সালে দেশে ফিরে সিলেটে জনসভার মাধ্যমেই রাজনীতি শুরু করি। এরপর থেকে সবসময়ই সিলেটে আসি। এবারও সিলেট থেকে নির্বাচনী প্রচার শুরু করলাম।
এর আগে আনুষ্ঠানিকভাবে নির্বাচনী প্রচার শুরু করতে সকাল সাড়ে ১১ টায় সিলেট ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে এসে পৌঁছান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এসময় তাকে অভ্যর্থনা জানান কেন্দ্রীয় ও স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দ।
এরপর প্রটোকলবিহীন গাড়িতে করে হয়রত শাহজালাল (রহ.) এর মাজার ও হয়রত শাহ পরান (রহ.) এর মাজার জিয়ারত করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এসময় তার ছোট বোন শেখ রেহানাসহ দলের নেতৃবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন।
প্রতিবারের মতো এবারও সিলেট থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে নির্বাচনী প্রচারণা শুরু করেছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে দেশের মানুষের কল্যাণ হয়, উন্নয়ন হয়। এ মুহ‚র্তে সিলেটে কোনো ঘরহীন বা ভ‚মিহীন মানুষ নেই। আমরা এভাবে জনগণের মৌলিক চাহিদা পূরণ করছি। ইনশাআল্লাহ পর্যায়ক্রমে অন্যান্য চাহিদাও পূরণ করা হবে। আমরা উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা অর্জন করেছি। তা ধরে রাখতে হবে। বিএনপি বাণিজ্য করে নির্বাচন ধ্বংস করেছে মন্তব্য করে তিনি বলেন, একজন লন্ডনে বসে মনোনয়ন পত্র বিক্রি করেছে, আরেকজন গুলশানে বসে মনোনয়ন বিক্রি করেছে, এ ছাড়া পল্টন থেকেও আরেকবার বিক্রি করেছে। এভাবে তারা নির্বাচনকে বাণিজ্যে পরিণত করে নির্বাচনকে ধ্বংস করেছে।
শেখ হাসিনা বলেন আগুন দিয়ে মানুষ পুড়িয়ে মারা, জনগণের সম্পত্তি নষ্ট করা, এগুলো সন্ত্রাসী কাজ, জঙ্গিবাদী কাজ। আর এগুলো করে যাচ্ছে বিএনপি-জামায়াত।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ভোট জনগণের সাংবিধানিক অধিকার। যারা জনগণকে ভোট দিতে বাধা দেবে, মানুষ তাদের উৎখাত করবে। মানুষ ভোটের পক্ষে, তারা হরতাল চায় না। বিএনপির হরতালে মানুষ সাড়াও দিচ্ছে না।
আসন্ন নির্বাচনে আবারও জয়ের আশা জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, ৭ জানুয়ারির ভোটে জয়ী হয়ে আওয়ামী লীগ আবারও ক্ষমতায় এলে জনগণের সব চাওয়া পূরণ হবে, কেউ গৃহহীন থাকবে না, কারো দুঃখ থাকবে না।
মানুষ নির্বাচন চায় জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, ‘এ দেশের মানুষ নির্বাচন চায়, ভোট দিতে চায়। আমরা ভোটের জন্য সম্পূর্ণ উন্মুক্ত করে দিয়েছি, আমাদের দলকেও। বলেছি, ঠিক আছে, সবাই দাঁড়াবে, সবাই কাজ করবে। জনগণ যাদের বেছে নেবে, তারা আসবে। কিন্তু সেখানে আমরা কি দেখলাম, রেলে আগুন দিল। একটা মা সন্তানকে নিয়ে সে আগুনে পুড়ে মারা গেল। মা সন্তানকে কিন্তু বুকের মধ্যে চেপে রেখে দিয়েছে। মানে, এর চেয়ে কষ্টের দৃশ্য আর কিছু হতে পারে না।’
সিলেটের উন্নয়নের কথা উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা থেকে শুরু করে সিলটবাসী আমার সঙ্গে আছেন। আমি বারবার সিলেটে এসেছি। আগামী ৭ জানুয়ারির নির্বাচনে সিলেটবাসীকে পাশে থাকার আহŸান জানান তিনি।
শেখ হাসিনা বলেন, সুরমা নদীসহ সব নদী খনন কাজ শুরু করা হয়েছে। নতুন রেলস্টেশন করে দিয়েছি। সিলেট-ঢাকা ও সিলেট-বাদাঘাট এবং সিলেট-তামাবিল মহাসড়ক ছয় ও চার লেন হচ্ছে। ওসমানী বিমানবন্দরের উন্নয়ন কাজ হচ্ছে। আধুনিক সিলেট গড়ার কাজ চলছে। সিলেটে মেট্রোরেল চালুর পরিকল্পনা রয়েছে। একশ শয্যার বার্ন ইউনিট ও প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিট চালুর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। সিলেটের মানুষ সবসময় আমাদের পাশে রয়েছে। আমিও পাশে আছি। স্মার্ট বাংলাদেশ, স্মার্ট অর্থনীতির জন্য আমরা লড়াই করছি। বিকেল ৪টা ২০ মিনিটে বক্তৃতা শুরু করে ৪টা ৫৫ মিনিটে শেষ করেন প্রধানমন্ত্রী। ৩৫ মিনিটের বক্তৃতায় তিনি আরো বলেন, আমরা দেশকে উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা দিয়েছি। তারা কি দিয়েছে। বারবার সংবিধান লঙ্ঘন ও জাতির পিতাকে হত্যা করে ক্ষমতায় এসেছে। কোনো কাজ করেনি। শুধু ভোগের জন্য তারা ক্ষমতায় এসেছে।
বেলা দুইটায় জনসভা শুরু হওয়ার কথা থাকলেও দুপুরের আগেই কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে যায় জনসভাস্থল। বিভাগের বিভিন্ন স্থান থেকে দলে দলে মিছিল নিয়ে আসতে থাকেন নেতাকর্মীরা। সকাল থেকেই নগরের সব পথ এসে মিশে মাদ্রাসা মাঠে। নির্ধারিত সময়ের আগেই শুরু হয় সমাবেশ। আর প্রধানমন্ত্রী জনসভাস্থলে আসেন ৩ টা ১০ মিনিটে।
প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের মাঝে যেমন ছিল নেতাকর্মীদের উচ্ছ¡াস তেমনি তার বক্তব্য শোনার জন্য ছিল নীরবতা। মাঠে স্থান সংকুলান না হওয়ায় আশপাশের এলাকায় অবস্থান করেন হাজার হাজার নেতাকর্মী।
মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি মাসুক উদ্দিন আহমদের সভাপতিত্বে এবং জেলা সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট নাসির উদ্দিন খান ও মহানগর সাধারণ সম্পাদক জাকির হোসেনের পরিচালনায় সমাবেশে বক্তব্য দেন, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের, পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. একে আব্দুল মোমেন, প্রেসিডিয়াম সদস্য সৈয়দা জেবুন্নেছো হক, সিটি মেয়র আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী, সাবেক শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ এমপি, শিক্ষামন্ত্রী ডা. দিপু মনি, সাংগঠনিক সম্পাদক শফিউল আলম চৌধুরী নাদেল, ইনাম আহমদ চৌধুরী, পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নান, প্রবাসী কল্যাণ, বৈদেশিক ও কর্মসংস্থান মন্ত্রী ইমরান আহমদ, বন, পরিবেশ ও জলবায়ুবিষয়ক মন্ত্রী শাহাব উদ্দিন, সিলেট জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি শফিকুর রহমান চৌধুরী, আবু জাহির এমপি, হাবিবুর রহমান এমপি, মুহিবুর রহমান মানিক এমপি প্রমুখ। এছাড়াও উপস্থিত ছিলেন- প্রেসিডিয়াম সদস্য অ্যাডভোকেট জাহাঙ্গীর কবির নানক, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবুল আলম হানিফ, আব্দুর রাজ্জাক, শেখ হেলাল প্রমুখ।