চলতি বছরের আট মাসে ৩৬৪ শিক্ষার্থীর আত্মহত্যা, ১৯৪ জনই স্কুল শিক্ষার্থী ॥ অধিকাংশ আত্মহত্যা প্রেমঘটিত

13

কাজিরবাজার ডেস্ক :
চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে আগষ্ট মাস পর্যন্ত আট মাসে দেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ৩৬৪ জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ১৯৪ জন স্কুলশিক্ষার্থী, যাদের ৩২.৯৯ শতাংশ ছেলে এবং ৬৭.০১ শতাংশ মেয়ে। প্রতি মাসে গড়ে ৪৫ জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছে।
আজ শুক্রবার আঁচল ফাউন্ডেশন অনলাইনে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানায়। ‘বেড়েই চলেছে শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যার হার: আমাদের উদ্বিগ্ন হওয়া কতটা জরুরি’ শিরোনামে সমীক্ষা তুলে ধরা হয় সংবাদ সম্মেলনে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লিনিক্যাল সাইকোলজি বিভাগের অধ্যাপক ড. কামাল উদ্দিন আহমেদ চৌধুরী, নারায়ণগঞ্জ জেলার এডিসি (শিক্ষা ও আইসিটি ডিভিশন) আজিজুল হক মামুন এবং আঁচল ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি তানসেন রোজ সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন। আঁচল ফাউন্ডেশনের পক্ষে আত্মহত্যার তথ্য তুলে ধরেন ফারজানা আক্তার লাবনী।
সংবাদ সম্মেলনে উপস্থাপিত প্রতিবেদনে বলা হয়, গত আট মাসে আত্মহননকারী শিক্ষার্থীদের মধ্যে ৫০ জন ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী, যাদের মধ্যে পুরুষ শিক্ষার্থী ৬০ শতাংশ এবং নারী শিক্ষার্থী ৪০ শতাংশ। কলেজ পড়ুয়াদের মধ্যে ৭৬ জন আত্মহত্যা করে। এর মধ্যে ৪৬.০৫ শতাংশ পুরুষ এবং ৫৩.৯৫ শতাংশ নারী শিক্ষার্থী।
সবচেয়ে বেশি ১৯৪ শতাংশ স্কুলগামী শিক্ষার্থী গত আট মাসে আত্মহত্যার দিকে ধাবিত হয়েছে। তাদের মধ্যে ৩২.৯৯ শতাংশ পুরুষ এবং ৬৭.০১ শতাংশ নারী শিক্ষার্থী। আর মাদ্রাসার শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছে ৪৪ জন। এদের মধ্যে ৩৯.২৯ শতাংশ পুরুষ এবং ৬০.০০ নারী শিক্ষার্থী।
আত্মহত্যাকারীদের অবস্থান বিবেচনায় সবার শীর্ষে রয়েছে রাজধানী ঢাকা। আর সিলেট বিভাগে তুলনামূলক কম শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছে, ৪ শতাংশ। তার মধ্যে বিদ্যালয়গামী প্রাইমারি থেকে মাধ্যমিকের ছাত্রছাত্রী আত্মহত্যায় এগিয়ে রয়েছে। তবে আত্মহত্যা বেশি করেছেন নারী শিক্ষার্থীরা। আর বয়সের হিসাবে ১৩ থেকে ২০ বছর বয়সীদের আত্মহত্যার হার সর্বাধিক, ৭৮.৬ শতাংশ।
প্রেমঘটিত কারণে বেশি আত্মহত্যা
আত্মহত্যার কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে অভিমান, প্রেমঘটিত কারণ, সেশনজট, পরীক্ষায় অকৃতকার্য হওয়া, পড়াশোনার চাপ, পরিবার থেকে কিছু চেয়ে না পাওয়া, পারিবারিক কলহ, ধর্ষণ ও যৌন হয়রানি, চুরি বা মিথ্যা অপবাদ, মানসিক সমস্যা, বিয়েতে প্রত্যাখ্যাত, স্বামী পছন্দ না হওয়া, বাসা থেকে মোটরবাইক কিনে না দেয়া ইত্যাদি। আরও রয়েছে মানসিক ভারসাম্যহীনতা, বিষণ্ণতা, বন্ধুর মৃত্যু, আর্থিক সমস্যা।
বলা হচ্ছে, প্রেমঘটিত কারণে আত্মহত্যা করেছে ২৫ দশমিক ২৭ শতাংশ, অভিমান করে ২৪ দশমিক ৭৩ শতাংশ। পরিবারের সঙ্গে চাওয়া-পাওয়ার অমিল হওয়ায় ৭ দশমিক ৪২ শতাংশ এবং পারিবারিক কলহের কারণে ৬ দশমিক ৫৯ শতাংশ আত্মহত্যা করেছে।
আঁচল ফাউন্ডেশনের সমীক্ষায় আরও দাবি করা হয়, ধর্ষণ বা যৌন হয়রানির কারণে আত্মহত্যার পথ বেছে নেয় ৪ দশমিক ৬৭ শতাংশ। মানসিক সমস্যার কারণে ৬ দশমিক ৫৯ শতাংশ। পড়াশোনার চাপে শূন্য দশমিক ৮২ শতাংশ, সেশনজটের কারণে হতাশায় শূন্য দশমিক ৮২ শতাংশ এবং পরীক্ষায় অকৃতকার্য হওয়ায় ১ দশমিক ৯২ শতাংশ আত্মহত্যা করেছে। মিথ্যা চুরির অপবাদে ১ দশমিক ৬৫ শতাংশ, আর্থিক সমস্যায় ১ দশমিক ৯২ শতাংশ, বন্ধুর মৃত্যুতে শূন্য দশমিক ৫৫ শতাংশ, বিয়ের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করায় এবং স্বামী পছন্দ না হওয়ায় ১ দশমিক ১০ শতাংশ। তবে ১৫ দশমিক ৯৩ শতাংশের আত্মহননের কারণ জানা যায়নি।
আত্মহত্যার ভিন্ন কিছু দিকের মধ্যে রয়েছে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, সাইবার ক্রাইম, আপত্তিকর ছবি ও ভিডিও মোবাইলে ধারণের মাধ্যমে ব্ল্যাকমেইলের শিকার।
সংগঠনটির পক্ষ থেকে শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যা প্রতিরোধ ও মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষায় ১০টি প্রস্তাব তুলে ধরা হয়-
আত্মহত্যা মোকাবিলায় বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে একটি টাস্কফোর্স গঠন।
পাঠ্যপুস্তকে মানসিক শিক্ষাকে এবং মনের যত্নের কৌশলগুলো শিক্ষার্থীদের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করা।
স্কুল-কলেজের অভিভাবক সমাবেশের আলোচিত সূচিতে শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্য ও আত্মহত্যা সম্পর্কিত এজেন্ডা রাখতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা প্রদান।
মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষা ও আত্মহত্যা প্রতিরোধে সব ধরনের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মনোরোগ বিশেষজ্ঞ নিয়োগ করা।
প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের প্রাথমিক মানসিক স্বাস্থ্য প্রশিক্ষণ প্রদান।
সহশিক্ষা কার্যক্রমে অংশগ্রহণ বৃদ্ধি ও বাস্তবায়ন নিশ্চিত করা।
মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করা প্রতিষ্ঠানগুলো দ্বারা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভ্রাম্যমাণ ক্যাম্পেইন পরিচালনা করা।
হতাশা, আপত্তিকর ছবি, আত্মহত্যার লাইভ স্ট্রিমিং, জীবননাশের পোস্ট ইত্যাদি চিহ্নিত করতে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিশেষ টুলস ব্যবহার করা।
আত্মহত্যার ঘটনায় পরিবার ও পরিচিতজনদের দায় অনুসন্ধানে আইনি বাধ্যবাধকতা থাকা।
মানসিক স্বাস্থ্যসেবা দ্রুত ও সহজলভ্য করতে একটি টোল-ফ্রি জাতীয় হটলাইন নম্বর চালু করা।