মৌ’বাজারে মহাসড়ক অবরোধ করে সহস্রাধিক চা শ্রমিকদের বিক্ষোভ মিছিল

27
মৌলভীবাজার শহরে আঞ্চলিক মহাসড়ক অবরোধ করে চা শ্রমিকদের বিক্ষোভ।

মৌলভীবাজার থেকে সংবাদদাতা :
চা শ্রমিকদের মজুরি দৈনিক ৩০০ টাকা বৃদ্ধির দাবিতে সতরো দিনের মতো মৌলভীবাজার জেলার অধিকাংশ বাগানে চলছে ধর্মঘট করেছেন চা শ্রমিকের একাংশ।
বৃহস্পতিবার দুপুরে মৌলভীবাজারের শহরের বেরিরচর এলাকায় ঢাকা সিলেট আঞ্চলিক মহাসড়কে অবরোধ করেন চা শ্রমিকরা। এ ছাড়া জেলার জুড়ী উপজেলার রাজনগর কলেজ পয়েন্টের আঞ্চলিক মহাসড়কেও অবরোধ করেন চা শ্রমিকরা। এর আগে গত বুধবার বেশ কয়েকটি চা বাগানে শ্রমিকরা পাতা উত্তোলন করলেও গতকাল বৃহস্পতিবার কাজে যোগ দেননি শ্রমিকরা।
মৌলভীবাজারের দেওরাছড়া চা বাগান, মাইজডিহি চা বাগান, মৌলভী চা বাগান, হামিদিয়া চা বাগান ও প্রেমনগর চা বাগানের শ্রমিকরা প্রায় ১৫ কিলোমিটার সড়কে পায়ে হেঁটে এই বিক্ষোভে অংশ নেন। অবরোধ অংশ নেন সহস্রাধিক চা শ্রমিক। এতে কয়েক হাজার ছোট-বড় যানবাহন আটকে পড়ে তীব্র যানজটের সৃষ্টি হয়। ঘণ্টাব্যাপী অবরোধে প্রচন্ড গরমে যাত্রীদের চরম দুর্ভোগ পোহাতে হতে হয়।
দেওরাছড়া চা বাগানের পঞ্চায়েত কমিটির সভাপতি সুবোধ কুর্মী বলেন, চা ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় নেতা ও প্রশাসনের লোকেরা প্রধানমন্ত্রীর কথা বলে আমাদেরকে ধোকা দেওয়া হচ্ছে। আমরা চাই প্রধানমন্ত্রী নিজে আমাদের বলবেন, আমাদের মজুরি বাড়বে। প্রধানমন্ত্রী না বলা পর্যন্ত আমরা আন্দোলন থেকে ফিরবো না।
এদিকে গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরে শ্রীমঙ্গলস্থ শ্রম দপ্তরের কার্যালয়ে পঞ্চায়েত কমিটির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকদের নিয়ে সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে।
সভাপতি উপস্থিত ছিলেন মৌলভীবাজারের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক শাহিনা আক্তার, শ্রম দপ্তরের উপ-পরিচালক নাহিদুল ইসলাম, শ্রীমঙ্গল উপজেলা নির্বাহী অফিসার আলী রাজিব মাহমুদ মিঠুন এবং ভাড়াউড়া পঞ্চায়েত কমিটি সভাপতি নূর মিয়া ও ফুসকুঁড়ি চা বাগানের পঞ্চায়েত কমিটির সভাপতি বাবুল মিয়াসহ বিভিন্ন চা বাগানের পঞ্চায়েত কমিটির নেতৃবৃন্দরা।
ফুসকুঁড়ি চা বাগানের পঞ্চায়েত কমিটির সভাপতি বাবুল মিয়া বলেন, সভায় ইউএনও সাহেব বলেছেন আমরা কাজে যোগ দিতে । আমরা বলেছি, আমাদের নিধারিত মজুরি না পাওয়া পর্যন্ত কাজে যাবো না। এখন যদি আমরা বাগানে কাজে যাই তাহলে সাধারণ শ্রমিকরা ধরে পিটাবে। আমার একটা মাত্র ভাষ্য জননেত্রী শেখ হাসিনা একবার যদি বলে দেয় ১২০টকায় কাজে যেতে,কাল থেকে আমরা কাজে যাবো।
শ্রীমঙ্গলস্থ শ্রম দপ্তরের উপ-পরিচালক নাহিদুল ইসলাম বলেন, আমরা বিভিন্ন উদ্যোগ নিচ্ছি যাহাতে পঞ্চায়েত কমিটি নেতৃবৃন্দের বৈঠক করেছি,তাদেরকে বুঝিয়ে বলেছি দ্রুত শ্রমিকদের মজুরি নিয়ে প্রধানমন্ত্রী নির্দেশনা দিবেন। তবে শ্রমিক নেতারা তা মানছেন না। তিনি আরও বলেন,খুবই শিগগিরই প্রধানমন্ত্রী সমস্যা সমাধান করবেন।
মৌলভীবাজার অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক শাহীনা আক্তার বলেন,‘শ্রমিকদের মজুরির নিয়ে কাজ করছি, মূলত তাদেরকে বুঝানোর জন্যই পঞ্চায়েত নেতাদের নিয়ে বৈঠকে বসেছিলাম। তারা যেন কোনভাবে বিভ্রান্ত না হন। যথাসম্ভব দ্রুত কাজে যোগ দেয়ার জন্য তাদেরকে বলেছি।’
এদিকে চা শ্রমিকদের ৩০০ টাকা মজুরির দাবিতে চলমান আন্দোলনকে বেগমান করতে এবং বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় নেতাদের প্রত্যাখ্যান করে চা শ্রমিকের অধিকার আদায়ে “চা শ্রমিক অধিকার পরিষদ” নামে নতুন সংগঠন আত্মপ্রকাশ করেছে।
গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরে মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গল উপজেলার ফিনলে টি কোম্পানির কালিঘাট চা বাগানে দুর্গা মন্দিরে আলোচনা সভা করেছে এই সংগঠনটি। নতুন সংগঠনে পঞ্চায়েত নেতা ও তরুণ যুবকদের অগ্রাধিকার দিয়ে পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠন করা হবে।
আলোচনা সভায় কালিঘাট চা বাগানের পঞ্চায়েত সভাপতি অভান তাঁতীর নেতৃত্বে জেরিন চা বাগান, গান্ধীছড়া চা বাগান, হুগলি ছড়া চা বাগান, আমরাইল ছড়া চা বাগান, ভুরভুরিয়া চা বাগান, ভাড়াউড়া চা বাগান, জাগছড়া চা বাগান, খাই ছড়া চা বাগান, লস্করপুর চা বাগান, রাজঘাট চা বাগান, খেজুরি চা বাগান, লাখাই চা বাগান, বিভিন্ন চা বাগানের একাংশের সহস্রাধিক শ্রমিকেরা অংশ নেন।
আলোচনা সভায় বলেন, দাবি আদায়ের আন্দোলনকে ধামাচাপা দেওয়ার জন্য জনপ্রতিনিধি, বাগানের মালিক ও সরকারি কর্মকর্তারা উঠে পড়ে লেগেছে। বাগানের সাধারণ শ্রমিকেরা কেন্দ্রীয় কমিটির নেতাদের কথা প্রত্যাখ্যান করেছেন। কেন্দ্রীয় নেতারা তাঁদের আন্দোলন বন্ধ করতে বলছে। আমরা আমাদের আন্দোলন সংগ্রাম চালিয়ে যাবো। আর আমাদের আন্দোলন সঠিকভাবে পরিচালনা স্বার্থে ‘চা শ্রমিক অধিকার পরিষদ’ নামে একটি কমিটি গঠন করতে চাচ্ছি। বাগান পঞ্চায়েত, চা শ্রমিক তরুণদের সমন্বয়ে কর্মসূচি ঘোষণা দেওয়া হবে।
চা শ্রমিক ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক বিজয় হাজরা বলেন, নতুন এই সংগঠনের বিষয়ে আমরা অবগত নয়।
এ দিকে শ্রীমঙ্গল উপজেলার সবকটি চা বাগানে কাজ বন্ধ রয়েছে। খেজুরি ছড়া চা বাগানে শিক্ষার্থীরা শ্রমিকদের মজুরি ৩০০ টাকা করার দাবিতে দুই ঘণ্টা ক্লাস বর্জন করে মানববন্ধন ও প্রতিবাদ সভা করেছে।
খেজুরিছড়া চা-বাগান পঞ্চায়েত কমিটির সভাপতি মহেশ্বর দাস বলেন,‘আমরা পঞ্চায়েত কমিটিও কোন কেন্দ্রীয় কমিটির নেতাদের মানছি না। এখন শ্রমিক ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় কমিটি, জনপ্রতিনিধি বা সরকারি কর্মকর্তারা সবাই এক হয়ে আমাদের ন্যায্য দাবির আন্দোলনকে বানচাল করার চেষ্টা করছে। প্রধানমন্ত্রী নিজ মুখে সিদ্ধান্ত দিলেই আমরা কাজে যাবো। এখন ঘোষণার অপেক্ষায় আছি।’
প্রসঙ্গত, গত ৯ আগষ্ট থেকে চার দিন দুই ঘণ্টা করে কর্মবিরতি ও পরে ১৩ আগষ্ট থেকে সারা দেশে অনির্দিষ্টকালের জন্য ধর্মঘট পালন করছেন চ শ্রমিকেরা। প্রশাসনের সঙ্গে আলোচনা করে চা শ্রমিক ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় কমিটি ধর্মঘট প্রত্যাহার করলেও সেটা মানছেন না সাধারণ চা শ্রমিকেরা। বাগানে বাগানে ঘুরে শ্রমিকদের কাজে যোগ দেওয়ার অনুরোধ জানাচ্ছেন জনপ্রতিনিধি ও প্রশাসনের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা। তারপরও কাজে যোগ দেননি শ্রমিকরা। এই সংকট সমধানের সরকার, শ্রমিক ও মালিকপক্ষের সাথে শ্রীমঙ্গল ও ঢাকায় চার দফা বৈঠক হয়েছিল। সেই বৈঠক গুলোতে কোন সুরাহা হয়নি।