বিশ্ববাজারে সয়াবিনের দাম কমেছে ৩২ শতাংশ, দেশে কমবে কবে

8

কাজিরবাজার ডেস্ক :
আন্তর্জাতিক বাজারে সয়াবিন ও পাম তেলের দাম কমলেও দেশের বাজারে তা কমানো হচ্ছে না। বিশ্ববাজারে দেড় থেকে দুই মাসের ব্যবধানে সয়াবিনের দাম কমেছে ৩২ শতাংশ। আর পাম তেলের দাম কমেছে ৪৮ শতাংশ। বিশ্ববাজারের প্রভাবে পাইকারি বাজারে খোলা ভোজ্যতেলের দাম কমেছে। খুচরা পর্যায়ে খোলা তেলের দাম কমলেও বোতলজাত তেলের দাম এখনো সেভাবে কমেনি। সরকার যে হিসাবে দাম নিয়ন্ত্রণ করে, সেই হিসাবে বিশ্ববাজারের প্রভাব পড়তে আরও অপেক্ষা করতে হবে বলে জানিয়েছেন পরিশোধনকারীরা।
সয়াবিনের চেয়ে বেশি কমেছে পাম তেলের দাম। মালয়েশিয়ার কমোডিটি এক্সচেঞ্জ বুশরা মালয়েশিয়া ডেরিভেটিভসে গত ৫ মে অপরিশোধিত পাম তেল বেচাকেনা হয় ৭ হাজার ৩৮২ মালয়েশিয়ান রিঙ্গিত বা লিটারপ্রতি প্রায় ১৩৯ টাকায়। বুধবার এ দর নেমে আসে ৩ হাজার ৮৫০ রিঙ্গিত বা লিটারপ্রতি ৭১ টাকায়। অর্থাৎ দুই মাসে পাম তেলের দর কমেছে প্রায় ৪৮ শতাংশ।
বাংলাদেশ মূলত ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনা থেকে অপরিশোধিত সয়াবিন তেল আমদানি করে। আর ইন্দোনেশিয়া থেকে আমদানি করে হালকা পরিশোধিত আকারে আরবিডি পাম তেল। এ দুই ধরনের তেলের দামও একইভাবে পড়েছে।
শনিবার বাজারসহ আরো বেশকিছু বাজারে ঘুরে দেখা গেছে ভোজ্যতেল আগের বাড়তি দামেই বিক্রি হচ্ছে।
ক্রেতাদের অভিযোগ, যখন তেলের দাম বাড়ানো হয়েছে তখন বলা হয়েছে বিশ্ববাজারে তেলের দাম বেড়েছে। কিন্তু যখন বিশ্ববাজারে তেলের দাম কমেছে এখন কেন দেশের ব্যবসায়ীরা দাম কমাচ্ছে না?
সোহেল হোসেন নামে একজন বেসরকারি চাকরিজীবী অভিযোগ করে বলেন, ‘যখন তেলের দাম হঠাৎ করে লিটারে ৩০ থেকে ৪০ টাকা বাড়ানো হল তখন বিশ্ববাজারের দোহাই দেওয়া হয়েছিল। তাহলে এখন কোথায় গেল সেই বিশ্ববাজারের দোহাই? এখন আমরা কি তাহলে বলতে পারি না যে তারা এ সব নিজেদের লাভের জন্য করেছে? তারা অহেতুক বিশ্ববাজারের সঙ্গে দেশের বাজারের দোহাই দেয়। যদি সত্যিই তা হতো তাহলে যখন তেলের দাম কমেছে এখন কমাচ্ছে না কেন?
তেলের কোম্পানিকে দোষারোপ করে পাইকারি তেল ব্যবসায়ী জামাল উদ্দিন বলেন, ‘আসলে এই দামের পেছনে সম্পূর্ণ দায়ী তেল কোম্পানিগুলো। তারাই দেশে সংকট তৈরি করেছে। তারা বাজারে পর্যাপ্ত পরিমাণে তেল সরবরাহ না করায় আমরা গ্রাহকের চাহিদা অনুযায়ী তেল বিক্রি করতে পারিনা। আরে এতে আমাদের ব্যবসার ওপরেও একটা নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। কোম্পানিগুলো যদি তেল স্টক না করে বাজারে ছাড়ত তাহলে আর এমন সংকট তৈরি হত না।’
পাম তেলের বড় অংশই খোলা বেচাকেনা হয়। তবে সয়াবিন তেলের বড় অংশ বেচাকেনা হয় বোতলজাত হিসেবে। বোতলজাত তেলের দাম গত ২৬ জুন এক দফায় লিটারপ্রতি ৬ টাকা কমানো হয়েছে। দাম কমানোর পর বিশ্ববাজারে আরও পতন হয়েছে। তবে এখনো কমানো হয়নি।
বোতলজাত তেলের দাম সরকার নিয়ন্ত্রণ করে। সে ক্ষেত্রে তিন ধরনের দর পর্যালোচনা করে সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। এই তিনটি হলো এক মাসে গড়ে কত দরে ঋণপত্র খোলা হয়েছে, এক সপ্তাহে কত দরে বন্দর দিয়ে তেল আমদানি হয়েছে এবং এক সপ্তাহে কত দরে ট্যাংক টার্মিনাল থেকে তেল বাজারজাতের জন্য খালাস হয়েছে।
বিশ্ববাজারে ভোজ্যতেলের দাম কমলেও এখনো এ তিন ধরনের দর খুব একটা কমেনি। যেমন বিশ্ববাজারে এখন অপরিশোধিত সয়াবিন তেলের দর চট্টগ্রাম বন্দর পর্যন্ত টনপ্রতি এক হাজার ৩৯০ থেকে এক হাজার ৪৫০ ডলার। এবার দেখা যাক দেশে কোন দরে ঋণপত্র খোলা ও আমদানি হয়েছে।
জুনের শেষ সপ্তাহে প্রতি টন অপরিশোধিত সয়াবিনের ঋণপত্র খোলা হয়েছে গড়ে ১ হাজার ৮১৭ ডলারে। বন্দর দিয়ে সর্বশেষ আমদানি হওয়া সয়াবিন তেলের টনপ্রতি মূল্য ১ হাজার ৮৫১ ডলার। জুলাই মাসে ট্যাংক টার্মিনাল থেকে খালাস হওয়া সয়াবিনের টনপ্রতি গড় মূল্য ছিল ১ হাজার ৭৯১ ডলার। অর্থাৎ দাম কমলেও এখনো দেশে সেই তেল পৌঁছায়নি। তবে ধীরে ধীরে এক থেকে দুই মাসের মধ্যে হ্রাসকৃত মূল্যের তেল দেশে পৌঁছাবে বলে ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন।
এদিকে আর্ন্তজাতিক বাজারে ভোজ্যতেলের দাম কমার কারণে দেশে দ্রুত দাম সমন্বয়ের দাবি জানিয়েছে কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)। শনিবার এক বিবৃতিতে এ দাবি জানিয়েছে তারা।
বিবৃতিতে ক্যাব কেন্দ্রীয় কমিটির ভাইস প্রেসিডেন্ট এস এম নাজের হোসাইন বলেন, ‘দেশে ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশন দাম বাড়াতে যতটুকু আগ্রহী, বিশ্ববাজারে দাম কমলে দেশে কমাতে তেমন আগ্রহী না হবার কারণে ভোজ্যতেলের বাজারে এখনকার নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি। আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বৃদ্ধির সাথে সাথে দেশিয় বাজারে ভোজ্যতেলের দাম বাড়িয়ে দেন আমদানিকারকরা। কিন্তু আন্তর্জাতিক বাজারে দাম কমলে দীর্ঘদিনেও দেশিয় বাজারে পণ্যটির দাম সমন্বয় হয় না। আবার আর্ন্তজাতিক বাজারে দাম বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে দেশিয় বাজারে দাম বাড়ে, কিন্তু দাম কমলে ব্যবসায়ীরা উল্টোসুর দেন। বেশি দামে কেনা বা বুকিং রেট বেশিসহ নানা অজুহাত দেখান। আর্ন্তজাতিক বাজারে ক্রমাগতভাবে দাম কমার পরও দেশে ভোজ্যতেলের দাম সমন্বয়ের বিষয়ে বাণিজ্যমন্ত্রী একাধিক বার আশ্বাস দিলেও সে আশ্বাসের বাস্তবায়ন হয়নি।’
নাজের হোসাইন বলেন, ‘যখন বিশ্ববাজারে ভোজ্যতেলের দাম বাড়তি ছিল, তখন পণ্যটি আমদানিতে সরকারের পক্ষ থেকে ভ্যাট ছাড়, এলসি কমিশন ও এলসি মার্জিন প্রত্যাহারসহ বিভিন্ন উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। আর ওই সুবিধা নিয়ে আমদানিকারকরা তেল দেশের বাজারে আনলে দাম কমার কথা ছিল। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তার বিপরীত ঘটেছে এবং ভোক্তারা তার কোনো সুফল পায়নি। বিশ্ববাজারে তেলের দাম কমেছে, দেশে তার বিপরীতে বাড়ানো হচ্ছে। আবার ভোজ্যতেল ব্যবসায়ীদের উল্টো সুর হলো- ভোজ্যতেলের এফওবি দাম কমলেও বৈশ্বিক জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি, দেশে বিদ্যুতের দাম বেড়ে যাওয়া এবং ডলারের উচ্চমূল্যসহ নানা ভৌতিক কারণে দাম আগের অবস্থানে ফিরছে না। এটি ব্যবসায় সুশাসন, ব্যবসায়িক নীতি নৈতিকতাকেও প্রশ্নের মুখে ফেলে দিচ্ছে।’
বিবৃতিতে ক্যাব সহ-সভাপতি বলেন, ‘দাম বৃদ্ধির পর্যালোচনা করে দেখা যায়-গত বছরের অক্টোবর থেকে চলতি বছরের জুন পর্যন্ত ভোজ্যতেলের দাম পাঁচবার উঠানামা করেছে। এর মধ্যে তিন দফায় দাম বাড়ানো হয়েছে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বৃদ্ধিসহ বিভিন্ন কারসাজিতে অক্টোবরের শেষ দিক থেকে বেসামাল হয় ভোজ্যতেলের বাজার। ফলে অক্টোবরে খোলা সয়াবিন প্রতি লিটার ১৩৬ টাকা এবং বোতলজাত সয়াবিন ১৬০ টাকা বেঁধে দেওয়া হয়। কিন্তু ফেব্রুয়ারিতে প্রতি লিটার ২১০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হয়। পরে সরকারের পক্ষ থেকে ৭ ফেব্রুয়ারি লিটারে ৮ টাকা বাড়িয়ে নতুন মূল্য নির্ধারণ করা হয়। সে সময় প্রতি লিটার বোতলজাত সয়াবিন ১৬৮ নির্ধারণ করা হয়। পাশাপাশি খোলা সয়াবিন ১৪৩ টাকা নির্ধারণ করা হয়।’
ক্যাবের পক্ষ থেকে জানানো হয়, গত রমজানের ঈদের পর গত ৫ মে দেশে ভোজ্যতেলের দাম সরকার পুর্নর্নিধারণ করে। ওই সময়ে সয়াবিনের দাম লিটারপ্রতি রেকর্ড পরিমাণ বাড়িয়ে ৩৮ টাকা বাড়ানো হয়। এরপর গত ৯ জুন কোনো কারণ ছাড়াই মিল পর্যায়ে ভোজ্যতেলের নতুন দাম নির্ধারণ করা হয়। এর মধ্যে এক লিটার খোলা সয়াবিন তেলের দাম মিলগেটে ১৮০ টাকা, পরিবেশক পর্যায়ে ১৮২ টাকা ও সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য ১৮৫ টাকা নির্ধারণ করা হয়।
এছাড়া এক লিটারের বোতলজাত সয়াবিন তেলের দাম মিলগেটে ১৯৫ টাকা, পরিবেশক পর্যায়ে ১৯৯ ও সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য ২০৫ টাকা নির্ধারণ করা হয়। এক লিটারের খোলা পাম অয়েলের (সুপার) দাম মিলগেটে ১৫৩ টাকা, পরিবেশক পর্যায়ে ১৫৫ ও সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য ১৫৮ টাকা করা হয়। এক্ষেত্রে সয়াবিনের দাম বাড়ানো হয়েছে লিটারপ্রতি ৫ থেকে ৭ টাকা। আর্ন্তজাতিক বাজারে তিন মাসের ব্যবধানে বিশ্ববাজারে প্রতি টন সয়াবিন তেলের দাম ২০০ থেকে ৪৯০ ডলার কমলেও দেশে তার বিপরীতে ব্যবসায়ীরা বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে বৈঠক করে এক মাসে দু’দফায় প্রতি লিটার সয়াবিনে দাম বাড়িয়েছেন ৫১ টাকা।
তথ্য বিশ্নেষণ করে দেখা যায়, ২০১৯ সালে অপরিশোধিত সয়াবিন তেলের গড় মূল্য ছিল টনপ্রতি ৭৬৫ ডলার। ২০২০ সালে দাম ছিল ৮৩৮ ডলার এবং ২০২১ সালে সয়াবিনের টনপ্রতি দাম ছিল ১৩৮৫ ডলার। কিন্তু চলতি বছরের মার্চে এক পর্যায়ে তা বেড়ে যায়। মার্চে বিশ্ববাজারে প্রতি টন সয়াবিন তেলের দাম হয় ১৯৫৬ ডলার। সর্বশেষ ১৩ জুলাই পাম অয়েলের টনপ্রতি দাম কমতে কমতে ৯৪১ ডলার এবং সয়াবিনের দাম নেমে আসে এক হাজার ৩৫৩ ডলারে।