ডলার চলে যায় বিদেশে, নষ্ট হয় আমদানি পণ্য ॥ পণ্য ছাড় প্রক্রিয়ায় আরও কঠোর বিধানের দাবি

5

কাজিরবাজার ডেস্ক :
যুগ যুগ ধরে বিভিন্ন পণ্যের আমদানি নির্ভরতা নিয়ে দেশ এগিয়ে চলেছে। আমদানি নির্ভরতা কমাতে সরকারী তৎপরতাও কমতি নেই। কিন্তু এ নির্ভরতা কখন যে কমবে তার কোন ইয়ত্তা নেই। দেশে বিভিন্ন পণ্যের আমদানির বিপরীতে নিয়মিত বিপুল অঙ্কের বৈদেশিক মুদ্রা ডলার আকারে বিদেশে চলে যায়। বিপরীতে বেশ কিছু পণ্য আসে যা বিভিন্ন কারণে ছাড় না হয়ে পড়ে থাকে বন্দরে। আবার এ থেকে চলে যায় অকশনে (নিলাম)। সেখানেও বিহিত ব্যবস্থা না হলে শুধু পচনশীল নয়, লৌহজাত পণ্যও নষ্ট হয়ে যায়। আর এসব পণ্যের বিপরীতে প্রেরিত ডলার অহেতুক রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে চলে যায়।
দেশের আমদানি রফতানির ৯২ ভাগ পরিবাহিত হয় চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে। এ বন্দরে বর্তমানে বছরে প্রায় ৩২ লাখ টিইইউএস কন্টেনার হ্যান্ডলিং হচ্ছে। বন্দরের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, এসব আমদানির পণ্যবোঝাই কন্টেনারের একটি অংশ প্রথমে ফ্রি টাইম এবং পরবর্তীতে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে ডেলিভারি না হলে তা কাস্টমসের নিয়ন্ত্রণে অকশন শেডে প্রেরণ করা হয়। কাস্টম কর্তৃপক্ষ পরবর্তীতে সেখান থেকে বিভিন্ন পণ্য অকশনে বিক্রি করার তৎপরতা চালায়। কিন্তু এসব পণ্যের বিপরীতে যে পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা বিদেশে চলে গেছে তা আর তুলে আনা সম্ভব হয় না। কারণ, ওইসব পণ্য নষ্ট হয়ে বিক্রি হয় বহু কমমূল্যে।
বন্দর সূত্র জানায়, বর্তমানে বিভিন্ন ইয়ার্ডে অকশনে বিক্রি করার মতো পণ্যভর্তি প্রায় ৫ হাজার কন্টেনার অলস পড়ে রয়েছে। যেগুলো নির্ধারিত সময়ে ডেলিভারি নেয়নি সংশ্লিষ্ট আমদানিকারকরা। এসব কন্টেনারের মধ্যে প্রায় ৮৫ হাজার মেট্রিক টন আমদানি পণ্য রয়েছে। এর পাশাপাশি খোলা পণ্য রয়েছে প্রায় ১১ হাজার টন। বন্দরের নিয়ম অনুযায়ী, প্রথমে চারদিন ফ্রি টাইম দেয়া হয় পণ্য ডেলিভারিতে। এরপরে কয়েক দফায় পেনাল্টি আরোপের মাধ্যমে ৩০ দিনের মধ্যে পণ্য ছাড়িয়ে নেয়ার বিধান রয়েছে। এরপরও কোন আমদানিকারক পণ্য ছাড়িয়ে না নিলে তা কাস্টমসের নিয়ন্ত্রণে অকশন শেডে পাঠিয়ে দেয়া হয়। অকশন শেড থেকে নিলামে বিক্রীত পণ্যের ২০ শতাংশ অর্থ বন্দর কর্তৃপক্ষকে দেয়ার নিয়ম থাকলেও কাস্টমস কর্তৃপক্ষ সাধারণত তা পরিশোধ করে না বলে অভিযোগ রয়েছে। প্রতিমাসেই রুটিন করে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ চট্টগ্রাম কাস্টম হাউস কর্তৃপক্ষকে চিঠি দিয়ে জানিয়ে দেয় কোন কোন পণ্যবোঝাই কন্টেনার নিলামে যাবে।
সূত্র জানায়, বন্দরে প্রতিনিয়ত বিদেশ থেকে যে আমদানির পণ্য আসছে তার বিপরীতে ব্যাংকের মাধ্যমে চলে যায় বৈদেশিক মুদ্রা, যা সাধারণত মার্কিন ডলারে হয়ে থাকে। এ মার্কিন ডলার বিদেশ থেকে কষ্টার্জিত বৈদেশিক মুদ্রা। সাধারণত গার্মেন্টস পণ্যের রফতানির বিপরীতে এবং বিশে^র বিভিন্ন দেশে কর্মরত বাংলাদেশীদের পাঠানো রেমিটেন্সের মাধ্যমে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সমৃদ্ধ হয়ে থাকে। এ রিজার্ভের বড় অংশটিই আবার চলে যায় বিদেশ থেকে পণ্য আমদানির বিপরীতে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, বর্তমানে চট্টগ্রাম বন্দরের শেডে এবং ইয়ার্ডগুলোতে যেসব কন্টেনার বোঝাই পণ্য ডেলিভারির অপেক্ষায় রয়েছে এবং অকশন শেডে নিলামের অপেক্ষায় বিদ্যমান এসবের প্রক্রিয়া দ্রুততম সময়ে সম্পন্ন করার সময় এসেছে। কেননা, বর্তমানে বিশ^ব্যাপী ডলারের মানের উর্ধগতির বিষয়টি বাংলাদেশেও আঘাত হেনেছে। বাংলাদেশ ব্যাংক ইতোমধ্যে ডলারের বিপরীতে টাকার মূল্যমান কয়েক দফায় নির্ধারণ করেছে। কিন্তু ডলারের কার্ব মার্কেটে এ মূল্য ব্যাংকের নির্ধারিত দরের চেয়ে বরাবরই বেশি থাকে। এখনও থাকছে। কার্ব মার্কেটের ডলার বেচাকেনায় জড়িত বিদেশ ফেরত যাত্রী এবং বিদেশগামীরাই। এক্ষেত্রে এটি একটি শেয়ার মার্কেটের মতো কাজ করছে। বিশেষ করে ঢাকা ও চট্টগ্রামে।
সূত্র জানায়, বর্তমানে সরকার বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভকে শক্ত অবস্থানে রাখতে বেশ কিছু পণ্যের আমদানিতে শুল্ক বৃদ্ধি করেছে। এছাড়া আমদানির প্রক্রিয়া অর্থাৎ ব্যাংকের এলসি সম্পন্ন করার ক্ষেত্রে মার্জিনের পরিমাণ ইতিপূর্বেকার চাইতে বহুলাংশে বৃদ্ধি করেছে। এর অর্থ হিসেবে বলা হচ্ছে, যত্রতত্র ইচ্ছামতো পণ্য আমদানি বন্ধ করা এবং এতে ইতোমধ্যে কিছুটা হলেও সফলতা এসেছে বলে ব্যবসায়ীদের বিভিন্ন সূত্রে মত ব্যক্ত করা হয়েছে।
সূত্র জানায়, চট্টগ্রাম বন্দরের ইয়ার্ড এবং শেডগুলোতে হাজার হাজার কোটি টাকার পণ্য রয়েছে। যেসব পণ্যের বিপরীতে বিপুল পরিমাণ ডলার বিদেশে চলে গেছে। এসব পণ্য দ্রুততম সময়ে ছাড় করে বাজারে ছাড়া হলে পণ্যের মূল্যের উর্ধগতি যেমন হ্রাস পেতে বাধ্য, তেমনি আমদানি পণ্য নষ্ট হওয়ার ক্ষেত্রে ইতিবাচক সুফল নিশ্চিতভাবে বয়ে আসবে।
বন্দর সূত্র জানায়, বন্দর ব্যবসায়ীদের আমদানি-রফতানি পণ্যের গোডাউন নয়। আমদানি-রফতানি প্রক্রিয়ায় চট্টগ্রাম বন্দরের ইয়ার্ড বা শেডগুলো একটি ট্রানজিট পয়েন্ট হিসেবে বিবেচনা করার বিধান রয়েছে। কিন্তু এদেশের আমদানিকারকদের বড় একটি অংশ বন্দরে পণ্য রেখেই তা বিক্রি করার তৎপরতা চালায়। এতে বিভিন্ন ধরনের রেন্ট প্রদান করে যে পণ্য বাজারে আসে তা ভোক্তাদের ওপরই চাপিয়ে দেয়ার রেওয়াজ বিদ্যমান। এতে করে বাজারে পণ্যের মূল্য বেড়ে যায়।
এ প্রক্রিয়ার উন্নতি সাধন করা গেলে একদিকে বৈদেশিক মুদ্রার অপচয় যেমন রোধ হবে, তেমনি পণ্য নষ্ট হয়ে যাওয়ার বিষয়টিও অনেকাংশে রোধ হবে। বর্তমানে চট্টগ্রাম বন্দরের অকশন শেডে বেশ কিছু বিলাসবহুল গাড়ি নিলামে উঠেছে। এসব গাড়ি আমদানির বিপরীতে যে পরিমাণ ডলার বিদেশে চলে গেছে সে পরিমাণ অর্থ উঠানো যেমন যাবে না, তেমনি শুরুতে খালাসকালে সরকার যে রাজস্ব অর্জন করত তাও হাতছাড়া হয়ে যায়। এ প্রক্রিয়াটি কঠিন হলেও তা রোধ করা একেবারে অসম্ভব নয় বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলোর অভিমত। বর্তমানে বিশ^জুড়ে বিভিন্ন পণ্যের মূল্য নানা কারণে বৃদ্ধি পেয়েছে। এ অবস্থায় দেশে আমদানি পণ্য এনে তা খালাস করে বাজারে ছাড়ার বিষয়টি নিশ্চিত করার তৎপরতা নেয়া হলে দেশের লাভ। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ অক্ষুণœ রাখার ক্ষেত্রেও ইতিবাচক প্রভাব বয়ে আনবে বলে সংশ্লিষ্টদের ধারণা।