বিভিন্ন ধর্ম ও সমাজে কন্যাশিশু

11

॥ মুহাম্মদ মনজুর হোসেন খান ॥

(পূর্ব প্রকাশের পর)
বৌদ্ধধর্মে : বিশ্বের প্রাচীনতম ধর্মসমূহের মধ্যে বৌদ্ধধর্ম অন্যতম। বৌদ্ধধর্মের প্রবর্তক গৌতম বুদ্ধ নারী জাতির জন্য কিছুই করে যাননি এবং কোন কিছু করার প্রয়োজনও বোধ করেন নি। জানা যায়, রাজমহিষী মল্লিকাদেবী কন্যাসন্তান প্রসব করলে রাজা বিমর্ষ হন। বুদ্ধ তাকে সান্তনা দিয়ে বললেন, “কন্যাসন্তানের জন্ম হেতু কারো দুঃখ করা উচিত নয়। সুশীলা ও ধর্মপ্রাণ কন্যা হরে সে পুত্র অপেক্ষা শ্রেয় হয়।” ‘‘বড়ুয়া, ড. সনন্দা, বৌদ্ধ ধর্মের আলোকে নারীর অবস্থান, ঢাকা: বাংলাদেশ বুদ্ধিষ্ট ফেডারেশন, স্মরণিকা, ১৯৯৬, পৃ. ২২।’’ হিন্দু ধর্মের ন্যায় বৌদ্ধ ধর্মে নারী ততটা অবহেলিত নয়। মহামঙ্গল সূত্রে গৌতম মাতার সেবা ও স্ত্রীর ভরণ-পোষণকে উত্তম মঙ্গল বলে আখ্যায়িত করেন। ‘‘দৌলাতানা, মমতাজ, ধর্ম, যুক্তি ও বিজ্ঞান, ঢাকা: জ্ঞানকোষ, ১৯৯৭, পৃ. ১০৮।’’
উপযুক্ত বিবরণ থেকে এটা সুস্পষ্ট যে, ইয়াহুদী, খ্রিস্টান ও হিন্দু ধর্মের কোন একটিতেও কন্যা বা নারীর কোন মর্যাদা ছিল না। নারী যে একটি প্রাণী, পুরুষের মত তারও প্রাণ আছে তা উপরে বর্ণিত কোন ধর্মই স্বীকার করতো না। নারীকে গৃহের অন্যান্য আসবাবপত্রের মত মনে করা হতো। নারী ছিল শিক্ষা-দীক্ষাসহ সর্বপ্রকার স্বাধিকার হতে চির বঞ্চিত।
আরব সামাজে : মহানবী (সা.) এর নবুওয়াত পূর্বযুগে আরবে কন্যাসন্তানের পারিবারিক ও সামাজিক অবস্থান খারাপ ছিল। জাহেলী যুগে কন্যারা ছিল ঘৃণিত, মর্যাদা বর্হিভূত এবং অধিকার ও মূল্যহীন। তারা মানবরূপে গণ্য ছিল না। কন্যা সন্তান জন্মগ্রহণ করলে সে চরম অভিশাপ বলে গণ্য হতো। কন্যা সন্তানকে জীবন্ত কবর দেয় হতো। ভোগ্য পণ্যের চেয়ে অবমূল্যায়িত ছিল নারী। এককথায় কন্যারা সে সামজে ছিল শোষিতা, অধিকার বঞ্চিতা এবং শিক্ষা-দীক্ষা বা জ্ঞান অর্জনের কোন সুযোগই তারা পেত না। এ প্রসঙ্গে Encyclopaedia of Britanica  এ বলা হয়েছে- “সে সমাজে নারীদের স্থান এত অধঃপতিত ছিল যে, তাদের সন্তানরা তাদেরকে দাসে পরিণত করত। নারীরা নিজ গৃহেই ছিল নির্বাসিত। স্ত্রীদের শিক্ষার অধিকার ছিল না। তাদের স্বামী কর্তৃক তারা একটা বাচাল বৈ কিছুই মনে করা হত না।”  ‘‘Encyclopaedia of Britanica-G ejv n‡q‡Q, Women’ status had degenerated to that of child bearing slaves. Wives were secluded in their home, had no education and few rights and were considered by their husbands no better than hatter.’’- The Encyclopaedia Britanica, ibid, Voll. 19, p. 909.’’ অথচ কন্যা সন্তান প্রবসে নারীর কোন হাত নেই। সে যুগে আবু হামযা নামে এক সম্ভ্রান্ত সর্দার কন্যা সন্তান জন্মের পর অপমানে আত্মগোপন করে বেড়ালে তার স্ত্রী মনের দুঃখে এ কাব্য আবৃত্তি করেছিল- “আবু হামযার কি হল! সে আমাদের নিকট না এসে প্রতিবেশীর বাড়িতে রাত্রি কাটায়। আমি পুত্র সন্তান প্রসব না করার দরুনই সে আমার উপর অসন্তুষ্ট হয়েছে। আল্লাহর কসম! পুত্র সন্তান জন্মাদান আমার ক্ষমতাধীন নয়। আমরা শষ্যক্ষেত্র তুল্য। স্বামীগণ আমাদের মাঝে যে বীজ বপন করে, তাতে সে শস্যের চারাই জন্মে।” ‘‘নদভী, সাইয়্যেদ সুলায়মান, সীরাতুন্নবী, আযমগড়: মাতবা আআরিফ, ১৯৫১, খ. ৪, পৃ. ২৯৭।’’
ইসলামে : ইসলাম নারীকে সর্বোচ্চ মর্যাদা দান করেছে। তা সত্ত্বেও অনেক মুসলিম দেশ ও সামাজে নারীরা নির্যাতিত হচ্ছে। পাচ্ছে না তাদের ন্যায্য অধিকার ও মর্যাদা। যদি নারী পুরুষ অপেক্ষা অধিক মুত্তাকী হয় তবে সে আল্লাহর নিকট অধিক সম্মানিত। পুরুষ হলেই নারী থেকে কেউ অধিক সম্মানিত হয় না। বর্তমান বিশ্বের কোন পুরুষ খাদিজা, আয়িশা ও ফাতিমা রা. এর সমান মর্যাদাবান হবে না। ইসলাম সম্পর্কে অজ্ঞতার কারণেই নারীদের অযোগ্য ও হীন মনে করা হয়। এ ধরনের দৃষ্টিভঙ্গি ও নারী নির্যাতনে অন্যতম কারণ।
বিভিন্ন ধর্ম ও সভ্যতায় কন্যাসন্তানের মর্যাদা ও অবস্থান সম্পর্কে উপরের বর্ণনা হতে একটি স্বচ্ছ ধারণা পাওয়া গেল। বিভিন্ন ধর্ম ও সভ্যতায় নারীকে জীব-জন্তু এবং ব্যবহারিক সামগ্রীর মত মনে করা হতো। দুর্ভাগ্যের প্রতীক, অপকর্মের উৎস, শয়তানের দোসর, নরকের দ্বার, যৌন চাহিদা চরিতার্থ করার বাহন হিসেবেই পরিচিত ছিল নারী। মানব সভ্যতার ইতিহাসে নারীর মর্যাদার জন্য যিনি প্রথম সোচ্চার হয়ে ওঠেন, নারীকে সংসার, সমাজের অবিচ্ছেদ্য অংশ বলে যিনি প্রথম স্বীকৃতি দান করেন, সত্যিকারার্থে নারী জাগরণ ও নারী মুক্তির যিনি প্রবক্তা, তিনি হচ্ছেন একজন পুরুষ- সর্বযুগের, সর্বকালের শ্রেষ্ঠ মানব মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম। মানবতার মুক্তির দূত বিশ্বনবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের উপর কুরআন নাযিলের মাধ্যমে নারীর প্রকৃত মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত হয়। কুরআন নারীকে মা, স্ত্রী, বোন ও কন্যা হিসেবে বিভিন্নভাবে মর্যাদার আসনে আসীন করেছে। ইসলামে নারী ও পুরুষের মাঝে বৈষম্য ছাড়া অন্য কোন বৈষম্যের স্থান নেই। এমনকি আল-কুরআনেও ক্ষেত্রবিশেষ পুত্রের চেয়ে কন্যাকে মহান করে তুলে ধরা হয়েছে।
বস্তুত বিশ্বজাহান সৃষ্টির মূলে আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের এক সুচিন্তিত মহাপরিকল্পনা রয়েছে। এই পরিকল্পনা অনুসারেই তিনি সব কিছু জোড়ায়-জোড়ায় সৃষ্টি করেছেন। প্রথম মানুষ আদম (আ.) কে সৃষ্টি করার পর পরই আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তার পরিকল্পনাকে কার্যকর করার জন্য তার জুড়ি মা হাওয়াকে সৃষ্টি করেন। আল-কুরআনের বাণীসমূহ প্রণিধানযোগ্য। আল-কুরআনে বলা হয়েছে- “তিনিই তো সেই মহান সত্তা যিনি সৃষ্টি করলেন তোমাদেরকে একটি মাত্র ব্যক্তি এবং বানালেন তার থেকে তার জুড়িকে।” ‘‘আল-কুরআন ৪ : ১’’
সৃষ্টি প্রসারের উদ্দেশ্যে নর-নারীর পারস্পরিক সম্মিলন এবং এতে যে প্রশান্তি ও প্রজন্ম বৃদ্ধি প্রক্রিয়া এটিই আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের অভীপ্সিত। আল্লাহ তাআলা বলেন, “প্রত্যেক বস্তু আমি জোড়ায় জোড়ায় সৃষ্টি করেছি, যেন তোমরা উপদেশ গ্রহণ করতে পারো।” ‘‘আল-কুরআন, ৫১ : ৪৯’’ তিনি আরও বলেন, “পবিত্র মহান তিনি, যিনি জোড়া জোড়া করে সৃষ্টি করেছেন উদ্ভিদ, মানুষ এবং তারা যাদেরকে জানে না তাদের প্রত্যেককে।” ‘‘আল-কুরআন, ৩৬ : ৩৬’’
মহান আল্লাহ সমগ্র সৃষ্টির মধ্যে মানুষকে সবচেয়ে বেশি সুন্দর আক্রতি দান করেছেন। তিনি বলেন, “আর মান-মর্যাদার দিক দিয়েও আল্লাহ মানুষকে সৃষ্টিলোকের অনেকের উপর শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছেন।” ‘‘আল-কুরআন, ৯৫ : ৪’’
তিনি বলেন, “নিশ্চয় আমি বনী আদমকে মর্যাদা দান করেছি এবং আমি তাদেরকে স্থলভাগে ও জলভাগে চলাচলের বাহন দান করেছি। আর আমি তাদেরকে দিয়েছি নানাবিধ উত্তম জীবনোপকরণ এবং আমি তাদেরকে শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছি।” ‘‘আল-কুরআন, ১৭ : ৭০’’
পুত্র ও কন্যা যদিও দু’টি ভিন্ন সত্তা তবুও কিছু কিছু ক্ষেত্র ছাড়া উভয়ের মধ্যে যথেষ্ট মিল এবং সমতা রয়েছে। এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই। আল্লাহ তাআলা কন্যাকে পুরুষের জন্য নিয়ামত হিসিবে মর্যাদাবান করেছেন। এ প্রসঙ্গে কুরআনে আল্লাহ তাআলা বলেন, “মানুষের কাছে মনোরম করা হয়েছে আকর্ষনীয় কাম্য বস্তুসমূহের মহব্বত যেমন নারীর, সন্তান-সন্ততির, স্তুপীকৃত স্বর্ণ-রৌপ্যের, চিহ্নিত অশ্বরাজির, গবাদি-পশুরাজির এবং ক্ষেত-খামারের। এসবই হল পার্থিব জীবনের ভোগ্যবস্তু। আর আল্লাহর কাছেই রয়েছে উত্তম আশ্রয়স্থল।” ‘‘আল-কুরআন, ৩ : ১৪’’ নারীজাতি পুরুষদের জন্য আকর্ষণীয় নিয়ামত। এ প্রসঙ্গে হাদীসের এক বর্ণনায় জানা যায়, রাসূল (সা.) বলেছেন, “এ পৃথিবীতে আমার প্রিয় বস্তু হচ্ছে নারী।” ‘‘নাসাঈ, ইমাম, আস-সুনান, অধ্যায়: ইশরাতিন্নিসা, অনুচ্ছেদ : হুববিন্নিসা, আল-কুতুবুসসিত্তা, রিয়াদ : দারুসসালাম, ২০০০;’’
রাসূল সা. বলেন, “আল্লাহ তাআলা মাতাগণের নাফরমানী, তাদের অধিকার আদায় না করা, চারদিক থেকে ধন সম্পদ লুন্ঠন করে সঞ্চয় করা এবং কন্যা সন্তানদেরকে জীবিত প্রোথিত করাকে তোমাদের জন্য চিরতরে হারাম করে দিয়েছেন।”‘‘বুখারী ইমাম, আস-সহীহ; বৈরুত: দারু ইহইয়াইত তুরাসিল আরাবী, তা. বি. : খ. ৮, পৃ. ২৫১, হাদীস নং- ২২৩১।’’ মহানবী (সা.) বলেন, “যে ব্যক্তির কন্যা সন্তান হবে, সে যদি জীবিত দাফন না করে, তার প্রতি তাচ্ছিল্যমূলক আচরণ না করে এবং নিজের পুত্রসন্তানে তার উপর প্রাধান্য না দেয়, তাহলে আল্লাহ তাআলা তাকে জান্নাতে প্রবেশ করাবেন।”‘‘আবূ দাউদ, ইমাম, আস-সুনান, অধ্যায়: আল-আদাব, অনুচ্ছেদ: ফি ফাদলে মান আলা ইয়াতামা, আল-কুতুবুসসিত্তা, রিয়াদ : দারুসসালাম, ২০০০।’’
কুরআন কন্যা সন্তান হত্যা করার মত মানবতাবিরোধী কাজকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে এবং কন্যা সন্তাকে মর্যাদা এতই বেশি দেয়া হয়েছে যে, কিয়মতের দিন কন্যা সন্তান ই দোযখের আগুন থেকে বাঁচার উপায় হতে পারে। এ প্রসঙ্গে হাদীসের এক বর্ণনায় এসেছে, “আল্লাহ যদি কন্যা সন্তানদের মাধ্যমে কাউকে কোন রকম পরীক্ষায় ফেলেন আর সে যদি তাদের প্রতি সদয় আচরণ করে, তাহলে ঐ সব কন্যা সন্তান তার জন্য দোযখের আগুন থেকে বাঁচার কারণ হবে।”‘‘মুসলিম, ইমাম, আলস-সহীহ, বৈরূত: দারু ইহইয়াইত তুরাসিল আরাবী, তা. বি. খ. ১৩, পৃ. ৭৫, হাদীস নং- ৪৭৬৩।’’
তৎকালীন আরব সমাজে ইয়াতীম শিশু কন্যারা নির্যাতিত হতো সবচেয়ে বেশি। তাদের অর্থ সম্পদ অন্যায়ভাবে ভক্ষণ করা হতো। কুরআন তাদের অধিকার ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করে। আল্লাহ তাআলা বলেন, “আর দিয়ে দাও ইয়াতীমদের তাদের সম্পদ এবং বদল করে না খারাপ মালের সাথে ভাল মালের। আর গ্রাস করো না তাদের মাল তোমারদের মালের সাথে মিশিয়ে। নিশ্চয় এরূপ করা গুরুতর পাপ।”‘‘আল-কুরআন, ৪ : ২।’’
আল্লাহ তাআলার এ স্পষ্ট ঘোষণা থেকে প্রতীয়মান হয় যে, ইয়াতীমরা অবহেলিত নয় বরং গুরুত্ব ও অধিকারের মর্যাদাপ্রাপ্ত। আল্লাহ তাআলা আরও বলেন- “আর তোমরা ইয়াতীমদের পরীক্ষা করে নেবে, যে পর্যন্ত না তারা বিবাহের বয়সে পৌঁছে। যদি তাদের মধ্যে ভাল-মন্দ বিচারের জ্ঞান দেখতে পাও তবে তাদের মাল তাদের হাতে ফিরিয়ে দেবে। ইয়াতীমের মাল প্রয়োজনাতিরিক্ত খরচ করো না এবং তারা বড় হয়ে যাবে মনে করে তাড়াতাড়ি খেয়ে ফেলো না যে সচ্চল যে যেন ইয়াতীমের মাল খরচ করা থেকে বিরত থাকে এবং যে অভাবগ্রস্ত সে যেন সঙ্গত পরিমাণে ভোগ করে। যখন তোমরা তাদের হাতে তাদের সম্পদ প্রত্যর্পন করবে, তখন সাক্ষী রাখবে। অবশ্য হিসেব গ্রহণে আল্লাহ যথেষ্ঠ।”‘‘আল-কুরআন, ৪: ৬।’’ আল্লাহ তাআলা বলেন- “নিশ্চয় যারা ইয়াতীমদের মাল অন্যায়ভাবে খায়, তারা তো শুধু তাদের পেটে আগুন ভর্তি করছে; আর তারা সত্বরই দোযখের আগুনে জ্বলবে।”‘‘আল-কুরআন, ৪ : ১০।’’
উর্পযুক্ত বর্ণনা হতে প্রতীয়মান হয়, ইয়াতীম শিশুরা কখনও অবহেলার পাত্র নয়। বরং মানুষ হিসেবে তারাও বিশেষ গুরুত্ব ও মর্যাদার অধিকারী। রাসূল (সা.) বলেছেন: “হে আল্লাহ! আমি দুই দুর্বল (ইয়াতীম ও নারী) এর প্রাপ্য অধিকার রক্ষা করব।”‘‘ইবনে মাজাহ, ইমাম, আস-সুনান, অধ্যায়: আল আদাব, অনুচ্ছেদ: হাককুল ইয়াতীম, আল-কাহেরা, দারু ইবনুল হাইছাম, ২০০৫, খ. ৪, পৃ. ১০০, হাদীস নং- ৩৬৭৮।’’ আল্লাহ তাআলা নারী ও পুরুষকে একজনকে অপরজনের ভূষণ তুল্য এবং একে অপরের পরিপূরক ঘোষণা দিয়ে তাদের বিশেষ মর্যাদায় ভূষিত করেছেন। স্ত্রী যে স্বামীর জন্য শান্তির আধার, প্রশান্তির উৎস তা আমরা কুরআনের এ বর্ণনা থেকে উপলব্ধি করতে পারি। আল্লাহ তাআলা বলেন, “হে যারা ঈমান এনেছ! তোমাদের জন্য হালাল নয় নারীদের জবরদস্তি উত্তরাধিকার গণ্য করা। আর তাদের আটকে রেখো না তাদের যা দিয়েছ তা থেকে কিছু আত্মসাৎ করতে, কিন্তু যদি তারা কোন প্রকাশ্র ব্যভিচার করে তবে তা ব্যতিক্রম। তোমরা তাদের সাথে সদ্ভাবে জীবন যাপন করবে। তারপর তোমরা যদি তাদের অপছন্দ কর, তবে এমন হতে পারে যে, তোমরা এরূপ জিনিসকে অছন্দ করছ যাতে আল্লাহ প্রভূত কল্যাণ রেখেছেন।”‘‘আল-কুরআন, ৪ : ১৯।’’
রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, “যে বিধবা নারী, সুশ্রী ও সম্ভ্রান্ত হওয়া সত্ত্বেও নিজ সন্তানদের সেবা-যন্ত ও লালন-পালনের ব্যস্থতায় নিজেকে বিবাহ হতে বিরত রেখেছে যে পর্যন্ত না সন্তান বড় হয়ে পৃথক হয়ে গিয়েছে এরপর মৃত্যুবরণ করেছে, তাহলে এমন নারী জান্নাতে আমার নিকটবর্তী হবে (দু’আঙ্গুলের মত দুরত্বের ন্যায়)।”‘‘আবু দাউদ, ইমাম, আস-সুনান, অধ্যায়: আল-আদাব, অনুচ্ছেদ : ফজলে মান আলা ইয়াতামা : প্রাগুক্ত।’’ আবু হুরাইরা (রা.) হতে বর্ণিত, “মহানবী স. বলেন, বিধবা নারী ও মিসকীনদের কল্যাণের জন্য প্রচেষ্টাকারী আল্লাহর পথে জিহাদকারী অথবা দিনভর রোজা পালনকাপরী ও রাতভর তাহাজ্জুদ নামাজে রত ব্যক্তির সমতুল্য সওয়াব পাবে।” ‘‘বুখারী, ইমাম, আস-সহীহ, অধ্যায়: আননাফাকাত, অনুচ্ছেদ : ফাদলিন নাফাকাতি আলাল আহলি, আল-কুতুবুসসিত্তা, রিয়াদ : দারুস সালাম- ২০০০, পৃ. ৪৬২।’’
নারীর সামাজিক দায়িত্ব: কুরআন মাজিদে পুরুষের ন্যায় নারীদেরকেও সামাজিক দায়িত্ব ও মর্যাদা প্রদান করা হয়েছে। আল্লাহ তাআলা বলেন: “তোমরা মানবগোষ্ঠীর মধ্যে শ্রেষ্ঠ জাতি। অর্থাৎ তোমরাই সর্বশ্রেষ্ঠ উম্মত এবং মানব জাতির সর্বাপেক্ষা হিত সাধানকারি।” ‘‘ইবনে কাছীর, তাফসীরুল কুরআনিল আজীম, বৈরুত: দারুল ফিকর, ১৪০১ হি: খ. ২, পৃ. ৯৩।’’ এখানে নারীদেরকে উত্তম জাতির অর্ধেক হিসেবে গণ্য করা হয়েছে।
মানব জাতির বংশ বিস্তারে নর ও নারী উভয়ের ভূমিকা সমান। আল কুরআনে এসেছে- “হে মানুষ! আমি তোমারদেকে সৃষ্টি করেছি একজন পুরুষ ও একজন নারী থেকে এবং তোমাদেরকে বিভাজন করেছি বিভিন্ন জাতিতে ও বিভিন্ন গোত্রে, যাতে তোমরা পরস্পরকে চিনতে পার। নিশ্চয় আল্লাহর কাছে তোমাদের মধ্যে সর্বাধিক মর্যাদাবান সেই ব্যক্তি, যে তোমাদের মধ্যে সর্বাধিক মুত্তাকী। নিশ্চয় আল্লাহ সবকিছু জানেন, সবকিছুর খবর রাখেন।” ‘‘আল-কুরআন, ৪৯ : ১৩।’’
অতএব বোঝা গেল, পুত্র-কন্যা নির্বিশেষে দুনিয়ার সকল মানুষকে একই উপাদান দ্বারা সৃষ্টি করা হয়েছে। পাপ ও পূণ্যের বিচারে পুত্র ও কন্যার মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। কুরআনে কারীমে বর্ণিত হয়েছে- “আমি বিনষ্ট করি না তোমাদের কোনো শ্রমিকের কর্ম, তা সে হোক পুরুষ কিংবা স্ত্রীলোক। তোমরা একে অন্যের অংশ।”‘‘আল-কুরআন, ৩ : ১৯৫।’’ (অসমাপ্ত)