বিশিষ্টজনদের সঙ্গে সংলাপের পর সিইসির ব্রিফিং ॥ অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন অপরিহার্য

2

কাজিরবাজার ডেস্ক :
বিশিষ্টজনের সঙ্গে সংলাপ করেছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। দ্বিতীয় ধাপের এই সংলাপে আমন্ত্রিত ৪০ জনের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন ১৯ জন। মঙ্গলবার দুপুরে আগারগাঁও নির্বাচন ভবনে এ সংলাপ অনুষ্ঠিত হয়। সংলাপে অংশ নিয়ে বিশিষ্টজনরা বলেছেন, সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য ইসিকে কঠোর হতে হবে। সংলাপ শেষে সাংবাদিকদের ব্রিফিংকালে প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়াল বলেছেন, গণতন্ত্র সুসংহত করতে সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন অপরিহার্য। এর আগে ১৩ মার্চ প্রথম ধাপে শিক্ষাবিদদের সঙ্গে সংলাপ করেছে ইসি। আর ৩০ মার্চ সিনিয়র সাংবাদিকদের সঙ্গে সংলাপ করবে ইসি।
সংলাপের শুরুতে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনসহ আগামী নির্বাচনগুলো কীভাবে সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য করা যায়, সে বিষয়ে সংলাপে অংশগ্রহণকারীদের কাছ থেকে মতামত জানতে চান সিইসি। এছাড়া তিনি নির্বাচনের বিষয়ে সর্বস্তরের মানুষের আস্থা ফেরাতে ও মানুষকে নির্বাচনমুখী করতে বিশিষ্টজনদের সহযোগিতা চান। পরে বিশিষ্টজনরা এক এক করে সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য তাদের মতামত তুলে ধরেন। তবে বেশ ক’জন বিশিষ্টজন ইভিএমে ভোট নেয়ার বিষয়ে ইসিকে নিরুৎসাহিত করেন। এ সময় সিইসি সবার মতামত পর্যালোচনা করে অংশগ্রহণমূলক ভোট করতে প্রয়োজনীয় উদ্যোগের আশ্বাস দেন।
সংলাপে বিশিষ্টজনরা জাতীয় নির্বাচনে সবার ঐকমত্য ছাড়া ইভিএম ব্যবহার না করা, ভোটারদের বাধাহীনভাবে ভোটদানের অধিকার নিশ্চিত করা, ভোটের আগে-পরে ভোটারদের বিশেষ করে নারী ও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, নির্বাচনকালীন প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে নির্বাচন কমিশনের নিয়ন্ত্রণে আনার পরামর্শ দিয়েছেন। এ সময় বিশিষ্টজনদের কেউ কেউ বলেন, অতীত অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, দলীয় সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়। সংবিধান ও আইনে ইসিকে যে ক্ষমতা দেয়া হয়েছে, তা তারা কতখানি প্রয়োগ করতে পারবে, সেটি অনেকাংশে নির্ভর করে নির্বাচনকালীন সরকারের ওপর। নির্বাচনকালীন সরকার এমন হতে হবে, যাতে ভোটের ফলাফল নিয়ে কারো মনে কোন সন্দেহ সৃষ্টি না হয়। সার্বিকভাবে নির্বাচন কমিশনকে কঠোর হতে হবে। প্রয়োজনে পদত্যাগ করতে হবে। নির্বাচন কমিশনকে সাহসিকতার সঙ্গে কাজ করতে হবে। কমিশন যদি মনে করে, নির্বাচনকালীন সরকার প্রশ্নে আইন ও সংবিধান সংশোধন প্রয়োজন, তাহলে তা করার ব্যবস্থা করতে হবে। ইসিকে নিরপেক্ষতার প্রমাণ দিতে হবে।
সংলাপ শেষে প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়াল বলেন, আমরা বিশিষ্টজনদের প্রস্তাব ও পরামর্শ শুনেছি। এসব প্রস্তাব ও পরামর্শ পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেয়া হবে। ইভিএম নিয়ে বিশিষ্টজনদের পরামর্শের প্রসঙ্গ টেনে সিইসি বলেন, ইভিএমে কোন অসুবিধা আছে কিনা, মেশিনের মাধ্যমে ভোটে কোন ডিজিটাল কারচুপি হয় কিনা এটা আমাদের দেখতে হবে। অনেকে অভ্যস্ত নন তাই ইভিএমের প্রতি আস্থা নিয়ে কথা উঠেছে। সিইসি বলেন, ইভিএমে ভাল দিকও রয়েছে, দ্রুত গণনা হয়ে যায়। কিন্তু পুনঃগণনার সমস্যা রয়েছে। তবে ব্যালটে পুনঃগণনা করা যায়। কারিগরি কমিটির সঙ্গে মিটিং করে আমাদের ইভিএম সম্পর্কে একটা ধারণা নিতে হবে। কেউ কেউ বলেছেন, সঠিক হলে তা চালিয়ে যেতে হবে। কাজে না লাগলে বর্জন করাই ভাল। এসব মতামত খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ধর্মকে যেন নির্বাচনে কোনভাবে উপজীব্য না করা হয়, নির্বাচনে এটাকে কেউ যেন কাজে না লাগায় আমরা অবশ্যই এটা দেখব। তবে আমরা সবার সহযোগিতা চাই।
সিইসি বলেন, যে দল সরকারে থাকে তাদের কিছুটা এ্যাডভান্টেজ থাকে। কারণ প্রশাসন, পুলিশ সবই তাদের নিয়ন্ত্রণে থাকে। ইসি তাদের ওপর কতটা নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারে সে বিষয়ে অবশ্য আইনের কোন অভাব নেই। তবে আইন প্রয়োগের দিক থেকে বাস্তবে ঘাটতি রয়েছে, আমরা এনফোর্সমেন্টটা যেন ভালভাবে করতে পারি সেটা চেষ্টা করব। এনফোর্সমেন্ট ক্যাপাসিটি আরও বাড়াতে পারলে তৃণমূলে ভোটারদের মধ্যে আস্থা সৃষ্টি হয়। তাহলে কেন্দ্রে কেন্দ্রে গন্ডগোল হবে না। আমরা নির্বাচনের অনুকূল পরিবেশ পাব।
সংলাপ শেষে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ডাঃ জাফরুল্লাহ চৌধুরী ইভিএমের বিরোধিতা করে বলেন, বিনা টেন্ডারে কিভাবে ইভিএম এলো। ইভিএম নিয়ে একজনের এত উৎসাহ কেন, তা নিয়ে শ্বেতপত্র প্রকাশ করতে হবে। কোনভাবে বড় পরিসরে ইভিএম ব্যবহার করা যাবে না। চাইলে ৫-১০ কেন্দ্রে ইভিএম ব্যবহার করতে পারে। তবে এটা না হওয়াই ভাল। সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য যা যা প্রয়োজন সাহসিকতার সঙ্গে ইসিকে তা করতে হবে। তিনি বলেন, সার্চ কমিটির কারণে বর্তমান নির্বাচন কমিশন কিছুটা আস্থা সঙ্কটে পড়েছে। ১০ জনের নাম প্রকাশ করেনি ওই কমিটি। এছাড়া নূরুল হুদা কমিশনের সাবেক সচিব ও আরেক সাবেক সচিবের শ্বশুর আওয়ামী লীগ নেতা হওয়ায় নতুন ইসির দুই সদস্য নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। ইসিকে উদ্দেশ করে তিনি বলেন, জোনায়েদ সাকি ও মাহমুদুর রহমান মান্নার দলের নিবন্ধন দেয়া উচিত।
সাবেক মন্ত্রী পরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার বলেন, ভোটাররা নির্বাচনবিমুখ হয়ে পড়েছে। ইসি প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। তাই অতীতের ভুলভ্রান্তি স্বীকার করে কাজ এগিয়ে নিতে হবে। তবে কোন রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় থেকে নিরপেক্ষ নির্বাচন করা সম্ভব নয়। গত দুটি নির্বাচনে দলীয় সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন করার বিষয়টি সরকার প্রমাণ করতে ব্যর্থ হয়েছে।
সিপিডির ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, নির্বাচনে ইভিএমের ব্যবহার অত্যন্ত বিতর্কিত বিষয়। এটা থেকে দূরে থাকা ভাল। ইভিএম ভবিষ্যতে পরিস্থিতি আরও জটিল করে দিতে পারে। তাই ঝুঁকি নিয়ে ইভিএম ব্যবহার করা উচিত নয়। সিইসিকে উদ্দেশ করে তিনি বলেন, নির্বাচন ব্যবস্থাপনার ওপর আস্থা ফিরিয়ে আনাই চ্যালেঞ্জ। নির্বাচনকালীন আইন-বিধির যথাযথ প্রয়োগ করতে পারেন কিনা তা দেখা যাবে। অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে সুষ্ঠু নির্বাচন করবেন। সাহসিকতার সঙ্গে কাজ করে দৃষ্টান্ত স্থাপন করবেন। প্রতিবন্ধকতা এলে পদত্যাগের সাহস রাখবেন।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. ফরাস উদ্দিন বলেন, ইভিএম সব সময় বিতর্কিত। এটার সমাধান না করে ব্যবহার করা ঠিক নয়। তাই জোরের সঙ্গে বলব, ইভিএম ব্যবহার না করার জন্য। তিনি বলেন, ভোটের আগে-পরে ছয় মাস নির্বাচনকালীন কর্তৃত্ব নির্বাচন কমিশনের কাছে থাকা উচিত। ২০২৩ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর থেকে একাদশ জাতীয় সংসদের অধিবেশন থাকবে না। এজন্য ভোটের আগে চার মাস ও ভোটের পরে দুই মাস-এ ছয় মাসের জন্য ক্ষমতা ইসির হাতে থাকতে পারে। আস্থা অর্জন করতে পারলে সবাইকে নিয়ে শান্তিপূর্ণ ভোট করা সম্ভব। বিশিষ্ট লেখক মহিউদ্দিন আহমেদ বলেন, ইভিএম নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। এ যন্ত্রে যে ম্যানুপুলেট করা যায় না, তা নিশ্চিত না করে ব্যবহার করা যাবে না।
লিডারশিপ স্টাডিজ ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান ড. সিনহা এম এ সাঈদ বলেন, ইসি এত সংলাপ করার মানে হচ্ছে এখানে সঙ্কট রয়েছে। আপনারা কাজ দিয়ে প্রমাণ করুন, আস্থা অর্জন করুন সবার। নির্বাচনের সময় কতটুকু নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করতে পারেন সংশয় রয়েছে। তবে আমি আশাবাদী মানুষ। টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান ইসিকে উদ্দেশ করে বলেন, নির্বাচনকালীন সরকারের চরিত্রের ধরনের ওপর নির্ভর করে কেমন নির্বাচন হবে। তবে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সমঝোতায় পৌঁছানোর জন্য আইনে কোন পরিবর্তন করা যায় কিনা তা চিহ্নিত করেন আপনারা।
সিইসি বলেন, ৫০-৬০ শতাংশ গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হলে তাতেই সফলতা। শতভাগ সফলতা কখনও সম্ভব না। সংলাপে কেউ কেউ বলেছেন এটা যদি ৫০ শতাংশ বা ৬০ শতাংশ নির্বাচন যদি গ্রহণযোগ্য হয়, তাহলে এটাও একটা বড় সফলতা। দেশের নির্বাচন নিয়ে বিবর্তনটা ইতিবাচক হয়নি জানিয়ে তিনি বলেন, সহিংসতা ব্যাপকতা লাভ করলে ভোটাররা আগ্রহ হারিয়ে ফেলে, ভোট দিতে পারে না। তাই সহিংসতা প্রতিরোধ করতে হবে। তবে এটা সত্য কথা আমাদের সাহস থাকতে হবে। সাহসের পেছনে থাকতে হবে সততা। আমাদের হারানোর কিছু নেই। পাওয়ারও কিছু নেই। জীবনের শেষ প্রান্তে আমরা ইতিবাচক যদি কিছু করতে পারি, নির্বাচনটা যদি অবাধ ও সুষ্ঠু করা যায় সবার অংশগ্রহণে, সেটা একটা সফলতা হতে পারে।
বিগত ইসির সময় নির্বাচন বেশ কিছু কারণে মানুষ মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন জানিয়ে সিইসি বলেন, কেউ কেউ বলছেন ভোট দেননি। তবে নারায়ণগঞ্জের ইলেকশন খুব সুন্দর হয়েছে। ইভিএমের মাধ্যমে ভোট এটা একটা বড় দিক। ইভিএমে সমস্যা আছে জানিয়ে তিনি বলেন, পৃথিবীর অনেক দেশ ইভিএম বাতিল করে দিয়েছে, কেন করল সেটা গবেষণা করা উচিত। তিনি বলেন, ভোটের আগে এবং ভোটের পরে ভোটারদের নিরাপত্তার বিষয়টা ওসি-ডিসিদের মাধ্যমে নিশ্চিত করতে পারলে ভাল হয়। র্র্নিাচন কমিশনের বিধিবিধানের অভাব নেই। কিন্তু এনফোর্সমেন্টের ঘাটতি আছে। তিনি বলেন, লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড একটা কষ্টসাধ্য কাজ। তবে আমাদের চেষ্টা করতে হবে।