হাওরে থেকে হারিয়ে যাচ্ছে দেশী জাতের বোরো ধান

11
তাহিরপুরে শনির হাওরে লাকাই ধান।

বাবরুল হাসান বাবলু তাহিরপুর থেকে :
বোরো ফসলি হাওরে এখন আর দেশী জাতের বোরো ধান চাষাবাদ হয় না। এখন চাষাবাদ হয় উচ্চ ফলনশীল ধান। গত দুই যুগ আগেও সুনামগঞ্জ, নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জ, হবিগঞ্জ সহ সব কটি হাওর জেলায় চাষাবাদ হতো দেশীয় বিভিন্ন জাতের বোরো ধান। সেই ধান রোপণের পর তেমন কোন যত্ন করতে হতো না। জলবায়ু সহিষ্ণ ছিলো দেশী জাতের সব কটি ধান। ফলন একটু কম হলেও অতিবৃষ্টি কিংবা খরাতে তেমন কোন ক্ষতি হত না। সেচ দিতে হত না, কীটনাশক, সার দিতে হতো না। বর্তমানে হাইব্রিড আর বহুজাতিক কোম্পানির বাণিজ্যের দাপটে হারিয়ে যাচ্ছে দেশী জাতের বোরো ধান। বেশি ফলনের আশায় কৃষকরা ঝুঁকছেন হাইব্রিড ধান চাষাবাদে। খাদ্য নিরাপত্তা অর্জনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা ধরে রাখতে সরকারও জোড় দিচ্ছেন হাইব্রিড ধান চাসাবাদে। হাওর অঞ্চলে দেশীয় প্রজাতির ধান যা ইতিমধ্যে হারিয়ে গেছে তার মধ্যে রয়েছে- রাতা, গুচি শাইল, নাজিশাইল, লাকাই, পানি শাইল, টেপি, রঙ্গিলা টেপি, রাজাশাইল, বেগুন বিচি, ধলাকাচাই, মৌমাইল, কালো জিরা, বাঁশফুল ও গড়িয়া ইত্যাদি। একটা সময় অতিথিদের আপ্যায়নের জন্য বিভিন্ন রকমের সুস্বাদু জাতের ধানের চাল দিয়ে রান্না করা হতো। খেতেও সুস্বাদু ছিলো সে ধান।
স্থানীয় কৃষি বিভাগ বলেছেন, দেশী জাতের ধানে ফলন কম হওযায় কৃষক এখন আর আগেরে মতো দেশী ধান চাষাবাদে আগ্রহ দেখাচ্ছেন না। অধিকাংশ হাওরেই এখন চাষাবাদ হচ্ছে ব্রি আর -২৮, ব্রি আর ২৯ ধান।
সরজমিন তাহিরপুর উপজেলার শনির হাওরে গিয়ে দেখা যায় সে চিত্র। বিস্তৃর্ণ হাওর জুড়ে সবুজের হাতছানি। হাইব্রিড ধানই চাষাবাদ হচ্ছে হাওরের এপাশ থেকে ও পাশ। হাওরের অনেকটা জমি ঘুরাঘুরির পর পাওয়া গেলো যত সামান্য (১৫ শতক) জমি। হয়তো কৃষক নিজে খাবারের জন্য লাকাই ধান চাষাবাদ করেছেন। এভাবেই হয়তো হাওরের চতুরপাশে বিভিন্ন গ্রামের আরো কিছু কৃষক সৌখিনতা বশত কিছু জমি দেশী ধান চাষাবাদ করেছেন। এক সময় হয়তো সৌখিনতা বশতও আর এ ধান চাষাবাদ করবেন না কেনা কৃষক।
শনির হাওর০ পার উজান তাহিরপুর গ্রামের কৃষক নাজমুল হুদা তিনি জানান, দেশি জাতের ধান চাষের উৎপাদন খরচ কম ছিল। তখন ধান কাটার মৌসুমে গ্রামে পিঠা পায়েস, চিড়া, খই, মুড়ি তৈরির ধুমও ছিল। এখন তা আর হয় না। দেশি জাতের ধান আবাদে অতিরিক্ত সার-কীটনাশক ব্যবহারের প্রয়োজন হত না বলেও তিনি জানান।
বাংলাদেশ রিসোর্স সেন্টার ফর ইন্ডিজেনাস নলেজ (বারসিক) এর গবেষক জাহাঙ্গীর আলম, তিনি জানান, এক সময় তিনি সুনামগঞ্জ ও নেত্রকোনা জেলার হাওরে মাঠ পর্যায়ে এ সব দেশী ধানের জাত সংরক্ষণ নিয়ে কাজ করেছেন। এখনো তাদের সংস্থা দেশী প্রজাতির ধান গবেষণা নিয়ে কাজ করছে। তিনি জানান, বিগত বছর দশেক আগেও হাওরে প্রচুর পরিমাণে দেশী জাতের ধান চাষাবাদ করতেন কৃষক। এখন উচ্চ ফলনের আশায় হাওর পারের কৃষকরা ৪ থেকে ৫ টি হাইব্রডি জাতের ধানের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ছেন। এর মধ্যে ব্রি আর ২৮ ও ব্রি আর ২৯ অন্যতম।
হাওরপারের প্রবীণ একাধিক কৃষক জানান, দেশী ধান চাষাবাদ করতে কোনো বীজ বাজার থেকে কিনতে হতো না। বীজের জন্য কিছু ধান আলাদা করে ঘরে তুলে রাখলেই চলত। বর্তমানে আমরা যে ধান চাষাবাদ করছি তা বীজ রাখতে পারছি না। বছরে বছরে বাজার থেকে চড়া দামে বীজ কিনতে হচ্ছে। সেই সাথে ধান রোপণের পর জমিতে কীটনাশক, সার, সেচ প্রচুর পরিমাণ দিতে হচ্ছে। না হলে ফলন ভালো হচ্ছে না।
জেলা ও উপজেলা পর্যায়েও হারিয়ে যাওয়া দেশী জাতের ধান সংরক্ষণে সরকারি কোনো উদ্যোগ নেই বলে তাহিরপুর উপজেলা কৃষিক সম্প্রসারণ অফিস ও সুনামগঞ্জ জেলা কৃষিসম্প্রসারণ অফিস থেকে জানা গেছে।