প্রজন্মের জন্য ইতিহাস

2

অপ্রিয় হলেও সত্য যে, বাংলাদেশ ও বাঙালি জাতির কোন পূর্ণাঙ্গ ও সঠিক ইতিহাস নেই। এ পর্যন্ত যা লেখা হয়েছে সেসবই খন্ড বিখন্ড, অপূর্ণাঙ্গ, অপর্যাপ্ত, তথ্যবিকৃত কিংবা মনগড়া। বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও বিজয়ের সুবর্ণজয়ন্তী এবং জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবর্ষ অতিক্রান্ত হতে চলেছে। সঠিক ইতিহাস লিখিত না হলে নতুন প্রজন্ম তথা আজকের শিশু-কিশোর দেশ ও জাতি সম্পর্কে কি শিখবে? কি জানবে? প্রকৃত ইতিহাস না জানলে তরুণ প্রজন্ম কিভাবে উদ্বুদ্ধ ও অনুপ্রাণিত হবে দেশপ্রেমে! ব্রতী হবে দেশসেবা ও মানুষের কল্যাণে। মূলত এসব বিষয় বিবেচনায় রেখে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মহান মুক্তিযুদ্ধের মাস মার্চের শুরুতে আবারও প্রকৃত ইতিহাস রচনার আহ্বান জানিয়েছেন ইতিহাসবেত্তাদের প্রতি। বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষ উদযাপন জাতীয় বাস্তবায়ন কমিটি আয়োজিত ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব : মহাজীবনের মহাপট’ শীর্ষক ১৫০ ফুট দীর্ঘ স্ক্রল পেইন্টিংয়ের প্রদর্শনীর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে রবিবার ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে প্রধানমন্ত্রী এ আহ্বান জানান। তিনি বলেন, ’৭৫-এ বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর দীর্ঘ একুশ বছর তরুণ প্রজন্মকে দেশের সঠিক ইতিহাস জানতে দেয়া হয়নি। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধুর অবদানকে নানাভাবে মুছে ফেলার হীন অপচেষ্টা করা হয়েছে। সে সময়ে জাতির পিতার ছবি টাঙানো এবং জয়বাংলা বলাও ছিল নিষিদ্ধ। তবে ইতিহাসের সত্য এই যে, ষড়যন্ত্রকারী ও কুচক্তীরা চাইলেও তাদের এ অপচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে। আজ সময় এসেছে দেশ ও জাতির সঠিক এবং পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস প্রণয়নের।
বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের একটি বড় প্রভাব বিস্তারি অংশ অবশ্যই ভাষা আন্দোলন, মুক্তি সংগ্রাম ও স্বাধীনতাযুদ্ধ। বিভিন্ন গল্প-উপন্যাস, কবিতা ও ছড়ায় এর অনেকটাই বিধৃত হয়েছে। তবে আরও বিস্তৃত ও গভীর দ্যোতনার অবকাশ রয়েছে। এর বাইরেও স্বাধীনতা-পূর্ব ও যুদ্ধকালীন শরণার্থী শিবিরের মানবেতর পরিস্থিতি, যুদ্ধে বিদেশী ও প্রবাসী বাংলাদেশীদের সহায়তা-সহযোগিতা, প্রবাসে মুক্তিযুদ্ধের কর্মকা- ইত্যাদি সুবিস্তৃত পরিসরে লেখালেখির যথেষ্ট অভাব পরিলক্ষিত হয়। তরুণ প্রজন্মের জন্য এসব বিষয়ে প্রামাণ্য বই-পুস্তক অপরিহার্য। বিশ্বের দরবারে জাতি হিসেবে উন্নত ও সমৃদ্ধ হতে হলে ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের তথ্যভিত্তিক ইতিহাস এবং প্রেক্ষাপট জানা অত্যাবশ্যক। বিশেষ করে তরুণ প্রজন্ম, যারা হবে আগামী দিনের বাংলাদেশের কর্ণধার ও চালিকাশক্তি, তাদের জন্য তা আরও বেশি অপরিহার্য। প্রজন্মের কথা বিবেচনায় রেখে আরও বেশি মুক্তিযুদ্ধের সৃজনশীল বই ও ইতিহাস গ্রন্থ লেখা আবশ্যক, যার অভাব এবারের বইমেলায়ও প্রকট। প্রকাশকদেরও এসব বিষয়ে আরও বেশি মনোযোগ দাবি করে তরুণ প্রজন্ম।
মহান স্বাধীনতাযুদ্ধ ও মুক্তযুদ্ধের প্রামাণ্য দলিল, সঠিক ও তথ্যনির্ভর পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস অদ্যাবধি লেখা হয়নি, এটা বড়ই পরিতাপের বিষয়। বঙ্কিমচন্দ্র প্রশ্ন রেখেছিলেন, ‘এই ইতিহাস কে লিখিবে?’ উত্তরও তিনিই দিয়েছিলেন, ‘তুমি লিখিবে, আমি লিখিব, সকলেই লিখিবে।’ সেসব থেকেই যথাসময়ে বেরিয়ে আসবে মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা সংগ্রামের পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস। বর্তমানে স্বাধীনতার সপক্ষের শক্তি ক্ষমতায়। তবে সব সময় যে সরকারী উদ্যোগেই লিখিত হতে হবে ইতিহাস গ্রন্থমালা, তা নয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন সরকারী-বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের পন্ডিতবর্গও এক্ষেত্রে এগিয়ে আসতে পারেন স্বতঃস্ফূর্তভাবে।