মানব সভ্যতার ইতিহাসে মুদ্রার উদ্ভাবন

27

॥ মুহাম্মদ মনজুর হোসেন খান ॥

মানব সভ্যতার ইতিহাসে মুদ্রার উদ্ভাবন এক বিরল ঘটনা। আদিম ও প্রাচীন সমাজে মুদ্রার ব্যবহার না থাকলেও আধুনিক জগতে প্রতিটি সমাজের অর্থনৈতিক অবস্থা এতই জটিল হয়েছে যে, মুদ্রা ব্যবস্থা ও মুদ্রার ব্যবহার না থাকলে সভ্যতার চাকা অচল হয়ে পড়বে। মানব সভ্যতার ইতিহাসে এই অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টির উন্নয়নের ক্ষেত্রে ইসলামের অবদান অনস্বীকার্য। কুরআন মাজীদ ও হাদীসে “দ্রব্য বিনিময়” প্রথার পরিবর্তে শাসনামলে একটি পূর্ণাঙ্গ ইসলামী মুদ্রা ব্যবস্থা গড়ে ওঠেছিল, যা গোটা পৃথিবীর বিভিন্ন জাতি ও গোষ্ঠির নিকট ‘হার্ড কারেন্সি’ হিসেবে গৃহীত হয়েছিল। এখন থেকে প্রায় এক হাজার বছর পূর্বে মুসলিম মনীষীগণ মুদ্রা ব্যবস্থা বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন এবং অনেকে মুদ্রা বিষয়ে বিশেষ বিশেষ গ্রন্থও রচনা করেছেন।
মুদ্রা বা অর্থকে আরবী ভাষায় আন-নুকূদ বা আল-আমালা বলা হয়। ইংরেজীতে বলা হয় গড়হবু বা ‘ঈঁৎৎবহপু’। পূর্বেকার ফিক্হবিদগণ নুকূদ বা মুদ্রা বলতে শুধু স্বর্ণ মুদ্রা এবং রৌপ্য মুদ্রাকেই বুঝাতেন। তবে কাগজী মুদ্রা আবিষ্কারের পর ফিক্হবিদগণও অর্থনীতিবিদদের মতই নুকূদ বা মুদ্রা বলতে এমন কোন বস্তুকেই বুঝান যা কোন দ্রব্য কিংবা সেবার বিনিময় মূল্য হিসেবে প্রদান করা হয়। স্বর্ণ হোক কিংবা রৌপ্য অথবা অন্য কোন ধাতু কিংবা কাগজী মুদ্রা হোক বর্তমানকালে আধুনিক ফিক্হবিদগণ এবং অর্থনীতিবিদদের মধ্যে এ ব্যাপারে কোন পার্থক্য নেই।
অর্থনীতিবিদদের মধ্যে মুদ্রা বা অর্থের সর্বসম্মত কোন সংজ্ঞা নেই। অর্থনীতিবিদগণ ভিন্ন ভিন্নভাবে মুদ্রার সংজ্ঞা প্রদান করেছেন। অর্থনীতিবিদ কোলের মতে “অর্থ এমন বস্তু যা সাধারণভাবে সকলেই দেনা-পাওনা মেটাতে ও ঋণ পরিশোধ করতে ব্যবহার করে”। লর্ড কীনসের মতে, “অর্থ এমন একটি দ্রব্য যা হস্তান্তর করে ঋণ চুক্তি মেটানো যায় এবং ক্রয় ক্ষমতাকে ধরে রাখা যায়”।
ড. আহমদ আব্দুহ মাহমুদ বলেছেন, “বিনিময়ের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহৃত হয়, মূল্যের পরিমাপ করে, সম্পদের ভাণ্ডার হিসেবে পরিগণিত হয় এবং ঋণ পরিশোধে ব্যবহৃত হতে পারে এমন যে কোন বস্তুই মুদ্রা হতে পারে”। আব্দুল্লাহ ইবনে সুলায়মান ইবনে মুনি বলেছেন, “এমন সকল বস্তু যা সকলের নিকট বিনিময় মাধ্যম হিসেবে গ্রহণযোগ্য তাই মুদ্রা, তা যাই হোক না কেন এবং যে অবস্থাতেই থাকুক না কেন”।
শেখ আব্দুল ওহাব খাল্লাফ বলেছেন, “মুদ্রা হল এমন বস্তু যার মাধ্যমে সমাজের সকল ব্যক্তি কারবার, ক্রয়-বিক্রয় এবং সকল প্রকার অর্থনৈতিক কার্যকলাপ পরিচালনা করে এবং যাকে দ্রব্যের মূল্য পরিমাপক হিসেবে দেশের প্রচলিত আইন স্বীকৃতি দিয়েছে, চাই তা স্বর্ণের তৈরী হোক কিংবা রৌপ্যের অথবা অন্য কোন ধাতব পদার্থের”।
উপরোক্ত সংজ্ঞাগুলো কোনটিতে মুদ্রার কার্যাবলীর প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে আবার কোনটিতে মুদ্রার প্রকৃতিগত দিকের প্রতি গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। তবে প্রতিটি সংজ্ঞায় একটি সাধারণ বিষয় উল্লেখ রয়েছে তা হল, “সর্ব সাধারণের নিকট গ্রহণযোগ্যতা”। সুতরাং মুদ্রা বা অর্থের পূর্ণ সংজ্ঞা হল, “যে বস্তু দেনা-পাওনা মেটানোর মাধ্যম হিসেবে সর্বজনগ্রাহ্য এবং সঙ্গে সঙ্গে মূল্যের পরিমাপক ও সঞ্চয়ের ভাণ্ডার হিসেবে কাজ করে তাকেই মুদ্রা বলে।
আদিম সমাজে ব্যক্তি মানুষ তার প্রয়োজনীয় সকল জিনিস নিজেই তৈরী করতো। ঐ সময় বিনিময়ের প্রয়োজন ছিল না। কিন্তু সভ্যতার অগ্রগতির সাথে সাথে মানুষের চাহিদা তৈরী হতে থাকে এবং ব্যক্তির একার পক্ষে তার প্রয়োজনীয় সকল দ্রব্যের উৎপাদন অসম্ভব হয়ে পড়ে। ফলে সমাজে শ্রম বিভাগের সৃষ্টি হয়। এক পর্যায়ে মানুষ প্রয়োজনীয় সকল দ্রব্য উৎপাদনের চেষ্টা না করে কোন একটি বিশেষ দ্রব্য উৎপাদনে নিজেকে নিয়োজিত করে এবং প্রয়োজনীয় অন্যান্য দ্রব্য নিজের দ্রব্যের বিনিময়ে অপরের নিকট থেকে সংগ্রহ করে। এভাবে সমাজে শ্রম বিভাগ দেখা দেয়ায় মানুষের জীবনে বিনিময়ের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়।
পরস্পরের সঙ্গে নিজ নিজ উদ্বৃত্ত দ্রব্যের সরাসরি বিনিময় দ্বারা মানুষ তার প্রয়োজন মিটাতে পারে। কোন একটি দ্রব্যের পরিবর্তে অন্য একটি দ্রব্য সরাসরি বিনিময় করাকে দ্রব্য বিনিময় প্রথা বলে। আদিম সমাজে যখন মুদ্রার প্রচলন ছিল না তখন দ্রব্য বিনিময় প্রথাই বিনিময়ের একমাত্র মাধ্যম হিসেবে ব্যবহৃত হতো। তখন কেউ কোন জিনিস ক্রয় করতে চাইলে তাকে নিজের দ্রব্যের বিনিময়ে অন্যের দ্রব্য সংগ্রহ করতে হতো। কিন্তু দ্রব্য বিনিময় প্রথার বহু সমস্যা ও অসুবিধা ছিল। যেমন, প্রয়োজনের অসঙ্গতি, দ্রব্যের অবিভাজ্যতা, মূল্য পরিমাপকের অভাব, দীর্ঘ সময়ের প্রয়োজন, ঋণ পরিশোধের অসুবিধা ইত্যাদি।
সমাজে মুদ্রা বা অর্থের প্রচলনের সাথে সাথে দ্রব্য বিনিময় প্রথার উপরোক্ত অসুবিধাগুলো দূর হয়েছে। বস্তুত মানব সভ্যতার ইতিহাসে অগ্নি উদ্ভাবনের মত মুদ্রার উদ্ভাবনও একটি অন্যতম যুগান্তকারী ঘটনা। মুদ্রার প্রচলনের ফলে নিম্নোক্ত উপায়ে দ্রব্য বিনিময়ের অসুবিধাগুলো দূরীভূত হয়েছে। এক কথায় মুদ্রা অর্থনৈতিক জীবনকে অনেক সহজ করে দিয়েছে। বিনিময় প্রথাকে ইসলামে নিন্দা করা হয়নি কিন্তু এর মধ্যে এমন কিছু রীতি বা রেওয়াজ রয়েছে যা একে শোষণ ও অবিচারের দিকে ঠেলে দেয়। তাই মহানবী স. শুধু সীমিত ক্ষেত্রেই এ পদ্ধতি ব্যবহারের অনুমোদন দান করেছেন এবং বিনিময়ের মাধ্যম হিসেবে মুদ্রার ব্যবহারকে উৎসাহিত করেছেন। বর্তমান অর্থনৈতিক জগতে মুদ্রার গুরুত্বকে বাড়িয়ে বলার উপায় নেই। একথা আজ সর্বজনস্বীকৃত যে, মুদ্রার ব্যবহার না থাকলে সভ্যতার চাকা অচল হয়ে পড়বে। সমাজতান্ত্রিক দেশগুলো প্রথম দিকে একটি মুদ্রাবিহীন অর্থনৈতিক ব্যবস্থা প্রবর্তনের চেষ্টা করেছিল। কিন্তু তাদের সে চেষ্টা সফল হয়নি। বস্তুতপক্ষে মানুষের অর্থনৈতিক জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে মুদ্রার গুরুত্ব অপরিসীম।
মুদ্রা বিনিময় ব্যবস্থাকে সহজসাধ্য করেছে। মুদ্রা সর্বজনগ্রাহ্য হওয়ার ফলে মানুষ যে কোন দ্রব্যের পরিবর্তে মুদ্রাকে গ্রহণ করেছে। তদুপরি মুদ্রাকে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র এককে ভাগ করা যায় বলে মুদ্রার দ্বারা বিনিময় আরো সহজসাধ্য হয়েছে।
মুদ্রা হল মূল্য পরিমাপের মাপকাঠি। মুদ্রার মাধ্যমে সকল দ্রব্যের মূল্য পরিমাপ করা যায়। সমাজে যখন মুদ্রার প্রচলন ছিল না তখন দ্রব্য মূল্যের কোন সাধারণ পরিমাপক ছিল না। কিন্তু বর্তমানে মুদ্রার মাধ্যমে দ্রব্যের মূল্য পরিমাপ করা যায়।
আধুনিককালে সমাজের অর্থনৈতিক কার্যক্রম সর্বদা নগদ অর্থে লেনদেন হয় না। অর্থনৈতিক উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে ক্রমশ বর্ধিত হারে ঋণের সাহায্যে অর্থনৈতিক কাজ কর্ম চলছে। মুদ্রার মাধ্যমে ঋণ গ্রহণ করা যেমন সহজ, ঋণ পরিশোধ করাও তেমনি সুবিধাজনক। এ কারণে মুদ্রার প্রচলনের ফলে সমাজে ঋণের লেনদেন সহজ ও ঋণের বাজার বিস্তৃত হয়েছে; এর ফলে সমাজে উৎপাদন ও অন্যান্য যাবতীয় অর্থনৈতিক কাজ কর্মের দ্রুত সম্প্রসারণ ঘটেছে।
সঞ্চয় অর্থনৈতিক উন্নয়নের অপরিহার্য উপাদান। মুদ্রা সঞ্চয়ের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। দ্রব্যের মাধ্যমে সঞ্চয় করা অসুবিধাজনক। কারণ দ্রব্য সামগ্রী পঁচনশীল বলে সঞ্চিত সম্পদ সহজে বিনষ্ট হয়ে যাওয়ার আশংকা থাকে। কিন্তু মুদ্রার বেলায় সে অসুবিধা থাকে না। মুদ্রার প্রচলনের ফলে মানুষের ব্যক্তিগত সঞ্চয় বৃদ্ধি পেয়ে সমাজে মূলধন গঠনের হার বৃদ্ধি পেয়েছে।
সমাজের উৎপাদন ব্যবস্থায় মুদ্রা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ক্রেতাদের আর্থিক ব্যয়ের ধরণ লক্ষ্য করে কোন কোন দ্রব্য সামগ্রী উৎপাদন করতে হবে মুদ্রা উৎপাদনকারীকে তা সহজে স্থির করতে সাহায্য করে। সুতরাং আধুনিক কালের বৃহদায়তন উৎপাদন ব্যবস্থাকে সহজতর করে মুদ্রা মানব সভ্যতার অগ্রগতির ধারাকে দ্রুততর করেছে।
আধুনিক কালে রাষ্ট্রের বিপুল আয়-ব্যয় ও ঋণ এবং এর নানা কার্যাবলী প্রসারেও মুদ্রার গুরুত্ব অপরিসীম। সরকার মুদ্রার মাধ্যমে কর ধার্য ও সংগ্রহ করে। সরকারের বিভিন্ন ব্যয়ও মুদ্রার মাধ্যমেই হয়ে থাকে। তদুপরি মুদ্রার ব্যবহার সমাজের অভ্যন্তরীণ বিনিময়কে রাষ্ট্রীয় তত্ত্বাবধানে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে পরিণত করেছে।
মুদ্রা বণ্টনের ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। উৎপাদনের বিভিন্ন উপাদানসমূহ উৎপাদন কাজে নিয়োজিত হয়ে যে আয় উপার্জন করে তা মুদ্রার মাধ্যমেই তাদের মধ্যে বিতরণ করা হয়।
তবে মুদ্রার এতসব সুবিধা ও গুরুত্ব থাকলেও এর কিছু কিছু নেতিবাচক দিকও আছে। যেমন- মুদ্রার প্রচলন সমাজকে ধনী ও দরিদ্র- এ দুই শ্রেণীতে বিভক্ত করেছে। মুদ্রা প্রচলনের পর থেকে এক শ্রেণীর লোক মূলধন করায়ত্ত্ব করে ধনিক শ্রেণীতে পরিণত হয়েছে। এ মূলধনের জোরেই তারা সমাজের দরিদ্র শ্রেণীকে অবাধে শোষণ করার সুযোগ লাভ করেছে। এ জন্য বলা হয় যে, মুদ্রার প্রচলনই সমাজে শ্রেণীবিভাগ সৃষ্টির জন্য প্রধানত দায়ী। এ ছাড়াও মুদ্রা ব্যবস্থা সমাজে মুদ্রাস্ফীতি ও মুদ্রা সংকোচনজনিত সমস্যার সৃষ্টি করেছে। কারণ মুদ্রার যোগান বেশি হলে মুদ্রার মূল্য কমে যায় এবং মুদ্রাস্ফীতি দেখা দেয়। মুদ্রাস্ফীতিতে মানুষের প্রকৃত আয় কমে যায় এবং স্থির আয়ের জনসাধারণ- দুঃখ কষ্টের সম্মুখীন হয়ে পড়ে। পক্ষান্তরে মুদ্রার যোগান কম হলে দেশে মুদ্রা সংকোচন দেখা দেয় এবং এর ফলে সমাজে আয় ও বিনিয়োগ হ্রাস পায়।
পরিশেষে বলা যায়, মুদ্রার এসব অসুবিধা বা নেতিবাচক দিক থাকা সত্ত্বেও একথা সর্বজনবিদিত যে, মুদ্রা আধুনিক কালে উৎপাদন, ভোগ, বিনিময়, বণ্টন, তথা সমাজের প্রতিটি অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। মুদ্রা যে আধুনিক অর্থনীতিতে কেন্দ্রিয় ভূমিকা গ্রহণ করেছে তাতে কোন সন্দেহ নেই।
মুসলিম অর্থনীতিবিদগণ এ ব্যাপারে সকলেই একমত যে, ইসলামী শরীয়তের মৌলিক দু’টি উৎস হচ্ছে, পবিত্র কুরআন এবং রাসূলুল্লাহ (স.) এর হাদীস।
প্রথমত: কুরআন মাজীদ হল মানুষের পথপ্রদর্শক গ্রন্থ, এতে সকল বিষয়ের বিস্তারিত বিবরণ নেই। বিস্তারিত বর্ণনার জন্য রয়েছে রাসূলের সুন্নাহ। আর ইসলামী পণ্ডিতদের কাজ হল, যাতে তা পরিবর্তিত পরিস্থিতির আলোকে স্থায়ী বিধানের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ করা। আর এজন্যই কুরআন মাজীদ সর্বস্থান ও সর্বকালের জন্য প্রযোজ্য গ্রন্থ হিসেবে পরিগণিত হয়েছে।
‘নুকুদ’ শব্দটি আরবী। কুরআন মাজীদে এ শব্দটির উল্লেখ নেই, তবে ‘মুদ্রা’ বা ‘নুকুদ’ অর্থে যা বুঝানো হয় অর্থাৎ স্বর্ণ এবং রৌপ্যের বর্ণনা যা কুরআন মাজীদ অবতীর্ণের সময় প্রচলিত ছিল যার অনেক বর্ণনা কুরআনে আছে এবং এতে মুদ্রার একটি বিশেষ প্রকার অর্থাৎ ধাতব মুদ্রার যথেষ্ট উল্লেখ রয়েছে, যা পূর্ববর্তী সম্প্রদায়ের মাধ্যমে প্রচলিত ছিল। (অসমাপ্ত)