বাংলাদেশের নাগরিকত্ব পেতে মরিয়া আশ্রিত রোহিঙ্গারা

6

কাজিরবাজার ডেস্ক :
বাংলাদেশে আশ্রিত রোহিঙ্গারা এ দেশের নাগরিকত্ব পেতে মরিয়া হয়ে উঠেছে। এ বিষয়ে তারা আন্তর্জাতিক মহলে একাধিক নেতার সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করছে। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে একটি মহল এ বিষয়ে সরকারের সঙ্গে আলোচনা করে ব্যবস্থা করার আশ্বাসও দিয়েছে।
সূত্র জানায়, রোহিঙ্গারা সত্যিকারভাবে মিয়ানমারের (আরাকান) নাগরিক। তারা সে দেশে রোহিঙ্গা জাতি হিসেবে নাগরিকত্ব ভোগ করেছে দীর্ঘকাল। পার্লামেন্টের মেম্বার এবং দেশটির মন্ত্রিসভার সদস্যও হয়েছে রোহিঙ্গা জাতিগোষ্ঠী থেকে। ১৯৮২ সালে মিয়ানমার সরকার সংসদে বিল পাস করে দেশটির রোহিঙ্গা জাতিগোষ্ঠীর নাগরিকত্ব বাতিল করে দেয়। বলা হয়, রোহিঙ্গারা বাংলাদেশী। তারা সেখান থেকে পালিয়ে এসে মিয়ানমারে আশ্রয় নিয়েছিল। বাংলাদেশী ও রোহিঙ্গা নাগরিকদের চেহারা, ভাষা ও চলাচলে মিল রয়েছে।
সূত্র আরও জানায়, ১৯৪৮ সালের সংবিধানে বার্মার অনেক সম্প্রদায় তাদের অধিকার লাভ করেনি, যার ফলে পরবর্তী ১০ বছর তুমুল গৃহযুদ্ধ বার্মার রাজনৈতিক জীবন সংঘাতময় করে রাখে। অর্থনীতিতেও ধ্বস নামে। এমন অবস্থায় দেশে আইন ও শৃঙ্খলা পুনর্বহালের জন্য ১৯৫৮ সালে জেনারেল নে উইন এক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মাধ্যমে ইউ ন্যুকে অপসারণ করেন। সমগ্র দেশের ভার গ্রহণ করে নে উইন সার্থকভাবে সকল সম্প্রদায়কে কেন্দ্রীয় সরকারের অনুগামী হতে বাধ্য করেন। তার সরকারের অধীনেই ১৯৬০ সালে ইউ ন্যু পুনর্নির্বাচিত হন। কিন্তু মাত্র দুবছর পরে নে উইন এক সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করে বার্মার সামরিক একনায়ক হিসেবে আবির্ভূত হন। নে উইন পূর্বের সংবিধান বাতিল করে স্বৈরাচারী সামরিক শাসন চালু করেন। কমিউনিস্ট ও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়গুলোর বিদ্রোহের সশস্ত্র দমনের ওপর পূর্ণ মনোযোগ দেয়া হয়। কুসংস্কারাচ্ছন্ন, বিদেশীবিদ্বেষী ও নির্দয় নে উইন পরবর্তী তিন দশকে একটি উন্নয়নশীল দেশকে পরিবেশ, সংস্কৃতি, অর্থনীতি সবদিক দিয়ে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যায়। দেশের বিভিন্ন জায়গায় সশস্ত্র বিদ্রোহ রোজকার বিষয় হয়ে দাঁড়ায়।
রোহিঙ্গারা আরাকান রাজ্যের নাগরিক, সে কথা সবারই জানা। ১৯৮৮ সালের জুলাইয়ে হঠাৎ নে উইন ঘোষণা দেন যে, তিনি ক্ষমতা ছাড়ছেন। এত দিনের সামরিক শোষণ, নিয়মতান্ত্রিক মানবাধিকার লঙ্ঘন ও অর্থনৈতিক অবনতি হতে মুক্তির আশা দেখে রেঙ্গুনের রাস্তায় জনতার ঢল নামে। কিন্তু ৮ জুলাই সবাইকে অবাক করে দিয়ে সেনাবাহিনী রাস্তায় নেমে আসা নারী-পুরুষ ও শিশুদের ওপর নির্বিচারে গুলি চালায়। চারদিন ধরে চলা এ হত্যাযজ্ঞে প্রায় ১০ হাজার মানুষ নিহত হয়। হাজার হাজার ছাত্র ও গণতন্ত্রকামী মানুষ সীমান্তবর্তী এলাকায় পালিয়ে যায়। ঠিক এই অশান্ত অবস্থাতেই বার্মার স্বাধীনতা আন্দোলনের নেতা আউং সানের কন্যা বিদেশে অবস্থানরত আউং সান সু চি অসুস্থ মাকে দেখতে দেশে (আরাকানে) আসেন। সময়ের প্রয়োজনে তিনিও রাজনীতিতে পা রাখেন। এ সময় আন্তর্জাতিক চাপ এড়াতে সামরিক সরকার এক বহুদলীয় নির্বাচনের ঘোষণা দেয়। সমমনাদের নিয়ে গঠিত সু চির ন্যাশনাল লীগ ফর ডেমোক্রেসি (এনএলডি) দেশব্যাপী জনপ্রিয়তা লাভ করে। সু চির জনপ্রিয়তার ফলাফল টের পেয়ে তাকে গৃহবন্দী করা হয়। ১৯৯০ সালের ২৭ মে প্রতিশ্রুত নির্বাচনে সু চির দল শতকরা ৮২ ভাগ ভোট পেয়ে জয়ী হয়। কিন্তু সামরিক সরকার সে ফলাফল গোপন রেখে ক্ষমতা ছাড়তে অস্বীকৃতি জানায়।
২০০২ সালে সু চিকে মুক্তি দেয়া হলেও ক্ষমতা সামরিক সরকারের হাতেই থাকে। টানা একনায়কতন্ত্রের ফলে গৃহযুদ্ধ, মানবেতর জীবন, সংঘাত, রক্তপাত, অর্থনৈতিক দুর্বলাবস্থা সব মিলিয়ে জাতিসংঘের সবচেয়ে অনুন্নত দেশগুলোর তালিকায় প্রথম দিকে থাকে বার্মা। সমগ্র রাজনৈতিক জীবনের ১৫ বছরই সু চির বিভিন্ন সময়ে গৃহবন্দী অবস্থায় কাটে। ২০০৯ সালে আসিয়ান সামিটে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা সু চির মুক্তির ওপর বিশেষ জোর দেন। আমেরিকা ও ব্রিটেন উভয়ই বার্মায় সাধারণ নির্বাচনের ওপর জোর দিতে থাকে। ২০১০ সালে মুক্তি পান সু চি। রোহিঙ্গাদের আপ্রাণ প্রচেষ্টা ও সহযোগিতায় ২০১২ সালে সাধারণ নির্বাচনে সু চি ও তার দল (এনএলডি) বিজয়ী হয়ে শপথ গ্রহণ করেন। ২০১২ সালের ৯ মে সু চি প্রথম আইন প্রণেতা হিসেবে পার্লামেন্টে উপস্থিত হন। ছয় দশকের রক্তপাত ও সশস্ত্র সংঘাত ও একনায়কতন্ত্রের পর বার্মা বা মিয়ানমার গণতন্ত্রের মুখ দেখে। কিন্তু রোহিঙ্গা সমস্যা রয়েই গেল। সুচিই দেশটির সেনাবাহিনীকে দিয়ে রোহিঙ্গাদের ওপর নির্বিচারে গুলি চালিয়েছে। জ্বালিয়ে দিয়েছে শত শত পাড়ার ঘরবাড়ি। ২০১৭ সালে ২৫ আগস্টের পর তিনমাসে অন্তত সাড়ে ৮ লাখ রোহিঙ্গা পালিয়ে এসে আশ্রয় গ্রহণ করে বাংলাদেশে। এর আগে ১৯৭৮ সাল থেকে পর্যায়ক্রমে পালিয়ে এসে থেকে যাওয়া আরও সাড়ে চার লাখ রোহিঙ্গার অনেকে এনআইডি হাতিয়ে নিয়েছে। দালান নির্মাণ করে বসবাস করছে চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার শহরে। তাদের দেখাদেখিতে ক্যাম্পে আশ্রিত রোহিঙ্গারাও দাবি করছে বাংলাদেশী এনআইডি। তারা বাংলাদেশী নাগরিক বনতে চাইছে। এ জন্য অঢেল টাকাও খরচ করছে রোহিঙ্গারা। পুরনো রোহিঙ্গাদের এনআইডি বাতিল করার পক্ষে জেলার সর্বস্তরের জনতা পরামর্শ দিয়েছেন।