ক্ষমতার অপব্যবহার করলে পরিণতি ভয়াবহ ॥ সিনহা হত্যা মামলার রায় বড় ধরনের মেসেজ

12

কাজিরবাজার ডেস্ক :
অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মোঃ রাশেদ খান হত্যা মামলায় সোমবার প্রদত্ত রায় ‘টক অব দ্য কান্ট্রি’তে পরিণত হয়েছে। শুধু তাই নয়, এ রায় এবং রায়ের পর্যবেক্ষণ ক্ষমতার অপব্যবহারকারীদের জন্য বড় ধরনের একটি মেসেজ হিসেবে উঠে এসেছে। যদিও কক্সবাজার জেলা ও দায়রা জজ আদালতের এ রায় চূড়ান্ত নয়, মামলায় যারা দণ্ডিত হয়েছে তাদের বিভিন্নভাবে উচ্চতর আদালতে যাওয়ার সুযোগ রয়েছে এবং সেসব আদালতে এ রায়ের ভাগ্য কিভাবে নির্ধারিত হবে তা কেবল ভবিষ্যতই বলে দেবে। তবে কক্সবাজার জেলা ও দায়রা জজ আদালতের এ সংক্রান্ত ৩০০ পৃষ্ঠার পর্যালোচনা, পর্যবেক্ষণ এবং সবশেষে প্রদত্ত রায় ইতিবাচক হিসেবে সংশ্লিষ্ট প্রায় সকল মহলে প্রশংসিত হচ্ছে। এমনকি এ হত্যাকাণ্ড পরিচালনার মূল নায়ক হিসেবে চিহ্নিত টেকনাফ থানার সাবেক ওসি প্রদীপ কুমার দাশের গ্রামের বাড়িতে ভাই ও আত্মীয়স্বজনরাও রায়ের ব্যাপারে কোন ধরনের অসন্তুষ্টি প্রকাশ না করে বলেছেন, অন্যায় করলে তো শাস্তি পেতেই হবে।
আইন আদালত অঙ্গনে এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় নিয়োজিত বাহিনীর বিভিন্ন পর্যায়েও সিনহা হত্যা মামলার রায়ের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শনের আলোচনাই বেশি হচ্ছে। অনেকেই বলছেন, আইনকে নিজস্ব গতিতে চলতে দেয়া হলে কাক্সিক্ষত ফল যে আসে সিনহা হত্যা মামলায় দুজনের মৃত্যুদন্ড, ৬ জনের যাবজ্জীবন ও ৭ জনের বেকসুর খালাস পাওয়ার ঘটনা তাই প্রমাণ করে। এদিকে সোমবার রায় ঘোষণার পর আদালত থেকে দ-িত আসামিদের কক্সবাজার কারাগারে আনার পর প্রদীপ কুমার দাশ ও লিয়াকত আলীর ডিভিশন বাতিল হয়ে গেছে। তাদের কনডেম সেলে রাখা হয়েছে। যদিও কক্সবাজার কারাগারে কনডেম সেল হিসেবে সুনির্দিষ্ট কোন কক্ষ নেই। এরপরও জেল কর্তৃপক্ষ দুটি কক্ষকে কনডেম সেল ঘোষণা করে। সেগুলোতে প্রদীপ ও লিয়াকতকে রাখা হয়েছে। যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত ৬ জনকে কয়েদি হিসেবে জেলকোড অনুযায়ী রাখা হয়েছে। কক্সবাজার জেল সুপার নেসার আলম এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
অপরদিকে ওসি প্রদীপের ফাঁসির দন্ডাদেশের পর থেকে টেকনাফসহ জেলাজুড়ে চলছে ব্যাপক সরস আলোচনা। স্বজনহারা পরিবারগুলোর সদস্যদের মাঝে হাসি ফুটেছে। তাদের সকলেরই এক বক্তব্য, আমরা আমাদের আপনজনদের ফেরত পাব না। কিন্তু খুনী প্রদীপের যে ফাঁসির আদেশ হয়েছে এতেই আমরা খুশি। আমাদের মন বলছে আমরা সঠিক বিচার পেয়েছি। স্বজনহারানো পরিবারগুলোতে এবং উৎসুক বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষ মিষ্টি বিতরণ করেছে। মঙ্গলবারও টেকনাফে এ চিত্র দেখা গেছে।
সিনহা হত্যার সঙ্গে জড়িত থাকা ছাড়াও ওসি থাকাকালে প্রদীপ কুমার টেকনাফে মাদক কারবারি হোক বা ধনাঢ্য হোক টার্গেট করে নির্দিষ্ট লোকজনদের থানায় ধরে এনে মোটা অঙ্কের অর্থ আদায় করে নেন। আর যারা প্রদীপের চাহিদা মেটাতে পারতেন না তাদের পরিণতি হতো নির্মম। টেকনাফে বিচারবহির্ভূতভাবে ১০৬টি ক্রসফায়ারের নামে ১৭৪টি হত্যাকা- সংঘটিত করার অভিযোগ রয়েছে প্রদীপের বিরুদ্ধে।
টেকনাফে সিনহার চাকরি জীবন : সীমান্তের অতন্দ্র প্রহরী হিসেবে এক সময় সিনহা মোঃ রাশেদ খান টেকনাফ বিজিবিতে দায়িত্ব পালন করেছেন। টেকনাফ বিজিবি ব্যাটালিয়নে মেজর পদে দায়িত্ব পালনকালীন স্থানীয় বহু লোকজনের সঙ্গে পরিচয় হয় সিনহার। এই চাকরি ও পূর্ব পরিচিত জায়গা হিসেবে তার ইউটিউব চ্যানেল ‘জাস্ট গো’ ডকুমেন্টারি নির্মাণ করতে টেকনাফকে বেছে নিয়েছিলেন তিনি। এরই সূত্র ধরে ইউটিউব চ্যানেল ডকুমেন্টারি তৈরিতে টেকনাফে আসলে মেজর সিনহার পরিচিতরা তাকে সহযোগিতা দেন। তথ্য দেন মাদক কারবার, চাঁদাবাজি, নারী ধর্ষণসহ ওসি প্রদীপের নানান অপকর্মের। এসবের কিছু ভিডিও ফুটেজও মেজর সিনহার হাতে চলে আসে। এ সংবাদ জানতে পেরে মেজর সিনহাকে কক্সবাজার ত্যাগ করতে নির্দেশ দেন ওসি প্রদীপ। সেনা বাহিনীর সাহসী এই মেজর (অব.) সিনহা মোঃ রাশেদ খান তার ইউটিউব চ্যানেল ‘জাস্ট গো’ ডকুমেন্টারি নির্মাণে কক্সবাজারে অবস্থান করে নিজ কার্যক্রম চালিয়ে যান। এতেই মেজর সিনহাকে ক্রস ফায়ার নতুবা গণপিটুনি দিয়ে হত্যার পরিকল্পনা করেছিলেন ওসি প্রদীপ। ষড়যন্ত্র শুরু করেন ওসি প্রদীপ ও তার সহযোগীরা। প্রথমে ৩১ জুলাই রাতে বাহারছড়ার মারিশবুনিয়া পাহাড়ে ভিডিও ফুটেজ ধারণ করার সময় ডাকাত আখ্যা দিয়ে মেজর সিনহাকে গণপিটুনি দিয়ে হত্যার পরিকল্পনা ছিল প্রদীপের। আদালতে যাবজ্জীবন কারাদ-প্রাপ্ত স্থানীয় মারিশবুনিয়ার তিন ব্যক্তি সেই গণপিটুনির প্রস্তুতিও নিয়েছিলেন। কিন্তু স্থানীয় লোকজন মেজর পরিচয় পেয়ে তাকে সম্মানজনকভাবে বিদায় দেয়ায় তাদের পরিকল্পনা ভেস্তে যায়।
ওসি প্রদীপের ক্ষোভ মেটাতে চতুর্দিকে ঘেরাও ছিলেন সিনহা : ডাকাত আখ্যা দিয়ে গণপিটুনিতে হত্যা করতে না পেরে গুলি করে হত্যা করতে হোয়াইক্যং ফাঁড়ির এসআই মশিউরকে নির্দেশ দেয়া হয়। হোয়াইক্যং রাস্তা দিয়ে সিনহার গাড়ি গেলে এসআই মশিউরের গুলিতে মারা যেতেন। টেকনাফের দিকে গেলে স্বয়ং ওসি প্রদীপের দলের গুলিতে নিহত হতেন। মেরিন ড্রাইভ দিয়ে আসায় বাহারছড়া ফাঁড়ির ইনচার্জ লিয়াকতকে নির্দেশনা দিয়ে রাখেন ওসি প্রদীপ। অর্থাৎ ওই দিন রাতে মেজর সিনহাকে চতুর্দিকে ঘিরে ফেলার বন্দোবস্ত করেন ওসি প্রদীপ। এ খবর মোটেও জানতেন না সিনহা। পাহাড় থেকে নেমে সিনহা মেরিন ড্রাইভ দিয়ে কক্সবাজারের দিকে যাচ্ছেন খবর পেয়ে এপিবিএন চেকপোস্টে ইন্সপেক্টর লিয়াকত পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী সিনহাকে গুলি করে হত্যা করেন।
আদালতের পর্যবেক্ষণেও উঠে এসেছে সিনহার সহযোগী সাহেদুল ইসলাম সিফাত তার দেয়া সাক্ষীতে বলেছেন, মেজর সিনহাকে ৪ রাউন্ড গুলি করে লিয়াকত আলী। লিয়াকত তার জবানবন্দীতে উল্লেখ করেছেন, ওসি প্রদীপ সিনহার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দিয়েছিলেন তাকে। সিনহার হাতে পিস্তল আছে ভেবে লিয়াকত ঘটনার সময় রাতে সিনহাকে গুলি করার কথা আদালতে স্বীকার করেছেন। ঘটনাস্থলে পৌঁছে ওসি প্রদীপ সিনহার বামপাশে লাথি মারেন। এরপর মেজর সিনহা নিস্তেজ হয়ে যান।
প্রদীপকে শেল্টার দিতেন যারা : পুলিশের একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার আস্থাভাজন ছিলেন প্রদীপ। তাকে ম্যানেজ করেই ভাল ভাল জায়গায় পোস্টিং পেতেন। অন্যান্য শ্রেণী-পেশার লোকজনকেও ওসি প্রদীপ মাসোহারা দিতেন। যার মধ্যে রাজনৈতিক নেতাকর্মীও রয়েছেন।
সিসি ক্যামেরায় প্রদীপের বাণিজ্য কারবার : টেকনাফ থানায় প্রদীপের সঙ্গে কেউ দেখা করতে গেলে তার বিস্তারিত প্রদীপকে জানাতেন তার দেহরক্ষী। তিনি কক্ষে (বাসা) বসেই সিসি ক্যামেরায় দেখতেন আগন্তুক ব্যক্তি বাণিজ্য করার মতো লোক কিনা। ২০১৫ সালে সিলেট রেঞ্জে বদলি হয়ে অল্পদিন সেখানে থাকার পর আবার চট্টগ্রামে ফিরে এসে কক্সবাজারের মহেশখালীর ওসি হিসেবে নিযুক্ত হন প্রদীপ। ২০১৮ সালের মে মাসে টেকনাফ থানায় বদলি হন। তখন থেকে ওসি প্রদীপ দেদার মোটা অঙ্কের অবৈধ অর্থ কামাই করেন। টেকনাফে ইয়াবার তকমা লাগিয়ে একজনকে বন্দুকযুদ্ধে নিহত দেখিয়ে ১৫-২০ জনকে আসামি করে লাখ লাখ টাকা কামাই করতেন প্রদীপ। নিরীহ লোককে ধরে নিয়ে ইয়াবা দিয়ে ফাঁসিয়ে দিতেন তিনি। থানায় আটকে রেখে তার পরিবারের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা নেয়া হতো। শেষ পর্যন্ত সিনহা হত্যা মামলার রায়ে ফাঁসির দণ্ড হয়েছে সাবেক ওসি প্রদীপের।