অনিশ্চিত রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন

7

কাজিরবাজার ডেস্ক :
সর্বশেষ রোহিঙ্গা ইস্যুতে জাপানও মুখ খুলেছে। বলেছে দেশটির ইন্দো-প্যাসিফিক লক্ষ্য অর্জনে বড় বাধা রোহিঙ্গা সঙ্কট। এখন চীন, রাশিয়া এবং ভারত এই ইস্যুতে ইতিবাচক ভূমিকা নিয়ে কঠোর অবস্থানে গেলে রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে ফেরত যাওয়া বা প্রত্যাবাসিত হওয়া আর কঠিন কোন বিষয় হয়ে থাকবে না। এসব দেশ বাংলাদেশেরও বন্ধু। সময় অনেক গড়িয়ে গেছে। মিয়ানমারের বর্বরতার বিপরীতে বাংলাদেশ ক্ষতিগ্রস্ত রোহিঙ্গাদের জন্য যে মানবিকতা প্রদর্শন করেছে তা বিশ^জুড়ে নন্দিত। এই ইস্যুর সমাধান যতই বিলম্বিত হচ্ছে বাংলাদেশ ততই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। তাদের প্রতি মানবিকতার দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে বাংলাদেশের স্থানীয় পর্যায়ের লোকজন চরম ক্ষতিগ্রস্ত, পরিবেশ বিপর্যস্ত। আশ্রিত রোহিঙ্গা অধ্যুষিত ক্যাম্পগুলোতে দিন দিন সহিংস তৎপরতা বেড়েই চলেছে। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষায় নিয়োজিতরা কঠোর অবস্থানে থাকলেও সীমান্ত গলিয়ে অপরাধীরা গা ঢাকা দিয়ে থাকছে। আশ্রয় শিবিরগুলোতে উত্থান হচ্ছে উগ্রবাদের। রোহিঙ্গাদের নিয়ে কর্মরত বিভিন্ন সূত্র থেকে এসব তথ্য দেয়া হয়েছে।
রোহিঙ্গা ইস্যুতে পানি অনেক গড়িয়ে গেছে। প্রত্যাবাসনের চুক্তি করেও মিয়ানমার এ পর্যন্ত একজন রোহিঙ্গাকেও ফিরিয়ে নেয়নি। আন্তর্জাতিক আদালতে রোহিঙ্গা ইস্যুটি নিয়ে যে মামলা হয়েছে সেখানে মিয়ানমারের তৎকালীন নেত্রী আউং সান সুচি উল্টো সেনা তৎপরতার পক্ষে সাফাই গেয়েছেন। সেই সেনাবাহিনীই পরবর্তীতে সুচিকে ক্ষমতা থেকে কুপোকাত করে জেলবন্দী করেছে। প্রশ্ন উঠেছে, সেনা নিয়ন্ত্রিত সুচির গণতান্ত্রিক সরকারের আমলে রোহিঙ্গাদের ওপর চরম বর্বরতার ঘটনাবলী ঘটেছে। প্রত্যাবাসন প্রসঙ্গে চুক্তি হয়েছে, কিন্তু ফেরত নেয়নি। যেই সেনাবাহিনী এ ঘটনার জন্য দায়ী এখন সেই সেনাবাহিনী মিয়ানমার সরকারে অধিষ্ঠিত। সঙ্গত কারণে প্রশ্ন উঠেছে জান্তা সরকার রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন প্রশ্নে আদৌ আন্তরিক কিনা।
উল্লেখিত পরিস্থিতিতে আবারও আলোচনায় উঠে এসেছে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন ইস্যু। বাংলাদেশে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের সংখ্যা বেসরকারী পরিসংখ্যান অনুযায়ী বর্তমানে প্রায় ১৪ লাখ। সরকারীভাবে নিবন্ধিত হয়েছে ১১ লাখেরও বেশি। ২০১৭ সালের ২৫ আগস্টের পর সেনা বর্বরতায় টিকতে না পেরে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য থেকে জাতিসংঘের হিসাব মতে প্রায় ৮ লাখ রোহিঙ্গা পালিয়ে আসে। ওই সময়ের আগে থেকে রিফিউজি হিসেবে আশ্রিত হয়ে আছে আরও চার লাখ। আর এরই মধ্যে রোহিঙ্গা পরিবারগুলোতে জন্ম নিয়েছে আরও প্রায় ২ লাখ শিশু। ফলে এই সংখ্যার যোগফল দাঁড়ায় মোট ১৪ লাখ। এই বিপুল সংখ্যক রোহিঙ্গাকে মিয়ানমার নামক দেশটি ‘রোহিঙ্গা’ নামে আখ্যায়িত করে না। যে রোহিঙ্গাদের ওপর সেনাবাহিনী লেলিয়ে দিয়ে বর্বর কায়দায় দেশান্তরী করা হয়েছে, সেই রোহিঙ্গাদের পুনরায় নিজ দেশে ফেরত নেয়ার বা প্রত্যাবাসন হতে দেয়ার সুযোগ সৃষ্টি মিয়ানমারের বর্তমান সরকার করবে কিনা সেটি একটি বড় প্রশ্নবোধক হয়ে দাঁড়িয়েছে।
যেই সেনাবাহিনীর সমর্থনে এনএলডি নেত্রী আউং সান সুচি ক্ষমতায় ছিলেন এবং যে সেনাবাহিনী নির্বিচারে রোহিঙ্গাদের ওপর গণহত্যা, নারী ধর্ষণ, বাড়িঘর জ¦ালাও-পোড়াও ইত্যাদি ঘটনা ঘটিয়েছেই। বর্তমানে সেই সেনাবাহিনী সুচিকে ক্ষমতা থেকে হটিয়ে জেলে ঢুকিয়েছে, রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল করেছে, সেই সামরিক জান্তা বাহিনী রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনে আন্তরিক কিনা সেটাও এই অঞ্চলের সচেতন বিভিন্ন মহলে বড় ধরনের জিজ্ঞাসার সৃষ্টি করেছে।
একদিকে চরম বর্বরতা, আরেক দিকে দৃষ্টান্ত সৃষ্টিকারী মানবতা। মিয়ানমারের বর্বরতা বিশ^ব্যাপী নিন্দিত হয়েছে। বিপরীতে নির্যাতিত-নিপীড়িত রোহিঙ্গাদের প্রতি মানবতা প্রদর্শন করে আশ্রয় দিয়ে বিশ^ সম্প্রদায়ের কাছে নন্দিত হয়েছে বাংলাদেশ। জাতিসংঘ ও দেশী-বিদেশী এবং বাংলাদেশ সরকারের আর্থিকসহ সব ধরনের সহায়তা নিয়ে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে আশ্রিত হয়ে আছে।
অবস্থাদৃষ্টে এটাই প্রতীয়মান মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের দেশান্তরী করে শান্তির জাবর কেটে আসছে। কিন্তু বিলম্বিত হলেও এটা সত্য যে, এই রোহিঙ্গাদের পুনরায় তাদের বাপ-দাদার ভিটায় ফিরে যাওয়ার অর্থাৎ প্রত্যাবাসনের ব্যবস্থা মিয়ানমারকেই করে দিতে হবে। গত কয়েকদিনে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন ইস্যু নিয়ে আবার আলোচনা শুরু হওয়ায় রোহিঙ্গাদের নিয়ে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সূত্রে এ ধরনের আলাপ-আলোচনা জোরালো হয়েছে।
সূত্রসমূহের সুনির্দিষ্ট ধারণা রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন ইস্যুতে চাপে পড়ে মিয়ানমার গত ২৭ জানুয়ারি বাংলাদেশের সঙ্গে আকস্মিক এক বৈঠক করেছে। ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে দুদেশের মধ্যে এ বৈঠকটি অনুষ্ঠিত হয়েছে। উল্লেখ্য, ২০২১ সালের ১৯ জানুয়ারি চীনের মধ্যস্থতায় ত্রিপক্ষীয় বৈঠকের পর মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশের এটাই প্রথম বৈঠক। যদিও ওই বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ওই বছরের ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথম সপ্তাহে দুদেশের ওয়ার্কিং গ্রুপের বৈঠক হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু সে দেশের এনএলডি নেত্রী আউং সান সুচিকে সরিয়ে সেনাবাহিনী ক্ষমতা দখল করে নেয়ায় সবকিছু থমকে যায়।
এদিকে, এরমধ্যে জাতিসংঘের পক্ষ থেকে বড় ধরনের চাপে রয়েছে মিয়ানমার। দিনদিন সে চাপ বাড়ছে। অপরদিকে, মিয়ানমারের সামরিক জান্তা সে দেশের রোহিঙ্গাদের মতো আরও কয়েকটি ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর ওপর
দমন নিপীড়ন চালিয়ে আন্তর্জাতিক সংবাদের শিরোনাম হয়েছে এবং এখনও হচ্ছে। এ অবস্থায় গত প্রায় সাড়ে চার বছর রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে ফিরে যাওয়া অর্থাৎ প্রত্যাবাসন বিষয়টি নিয়ে মিয়ানমার সরকার রীতিমতো নীরবতাই পালন করে যাচ্ছে। পক্ষান্তরে, বাংলাদেশ জাতিসংঘসহ বিশ^ দরবারে বার বার রোহিঙ্গা বিষয়টি উত্থাপন করে এর একটি সমাধান কামনা করে যাচ্ছে। পাশাপাশি চালিয়ে যাচ্ছে কূটনৈতিক পর্যায়ের সর্বোচ্চ তৎপরতাও।
বিস্ময়কর হলেও সত্য যে, জাতিসংঘের হিসাব মতে ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট গভীর রাতে রাখাইন রাজ্যে সেনা অভিযান শুরু হওয়ার পর পালিয়ে আসা রোহিঙ্গার সংখ্যা প্রায় ৮ লাখ। আরও আগে আসা রোহিঙ্গার সংখ্যা ৪ লাখেরও বেশি। সে হিসেবে এ সংখ্যা দাঁড়িয়েছিল প্রায় ১২ লাখ। কিন্তু ইত্যবসরে এই জনগোষ্ঠীর প্রজনন ক্ষমতার জোরে এতে যোগ হয়েছে নতুন আরও প্রায় ২ লাখ শিশু। সব মিলিয়ে এ সংখ্যা এখন ১৪ লাখেরও বেশি বলে বেসরকারী পরিসংখ্যান রয়েছে।
রোহিঙ্গা ইস্যুতে বাংলাদেশ সরকার বড় ধরনের সমস্যার সম্মুখীন। কক্সবাজারের উখিয়া-টেকনাফ অঞ্চল বিপর্যস্ত। ফলে সরকার বাধ্য হয়ে এক লাখেরও সামান্য বেশি রোহিঙ্গাকে নোয়াখালীর হাতিয়ার ভাসানচরে স্থানান্তর কাজ শুরু করে তা অব্যাহত রেখেছে। এ ব্যবস্থা অস্থায়ী। ভাসানচরকে রোহিঙ্গাদের অস্থায়ী বসবাস উপযোগী করতে জাতিসংঘের সব নির্দেশনা মানতে হয়েছে। আর এজন্য এ প্রকল্পটি গড়া হয়েছে প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের ৩ হাজার কোটি টাকারও বেশি অর্থব্যয়ে। মূলত এদের মানবিক কারণেই বাংলাদেশ সীমান্ত পেরিয়ে আসার সুযোগ ও থাকার আশ্রয় দেয়া হয়েছে। এটা কোনভাবেই স্থায়ী প্রক্রিয়া নয়। আজ হোক কাল হোক রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে প্রত্যাবাসনে বাংলাদেশ অত্যন্ত জোরালো অবস্থান নিয়ে আছে। কিন্তু নেয়ার প্রশ্নে মিয়ানমার সরকার এখনও সম্পূর্ণ বিপরীত অবস্থানে রয়েছে। এছাড়া ফিরে যাওয়ার প্রশ্নে রোহিঙ্গারা রয়েছে দ্বিধাগ্রস্ত। একটি গ্রুপ যেতে চাইলেও আরেক গ্রুপ এর বিপক্ষে অবস্থান নিয়ে রয়েছে। ফিরে যাওয়া না যাওয়া নিয়ে আশ্রয় ক্যাম্পগুলোতে খুন-খারাবির ঘটনাও ঘটছে। ফিরে যাওয়ার পক্ষে আগ্রহীদের নেতৃত্বদানকারী নেতা মহিবুল্লাহকেও গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। ইতোমধ্যে কয়েক দফায় বিভিন্ন ক্যাম্পের বহু কক্ষ জ¦ালিয়ে দেয়া হয়েছে। এসবের নেপথ্যে মিয়ানমারের হাত রয়েছে বলে ধারণা করা হয়।
রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর সশস্ত্র গ্রুপ যারা নিজেদের স্বাধীনতাকামী মনে করে এ গ্রুপটির নাম আরসা (আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি)। গত চার বছরেরও বেশি সময়ে আরসার একটি গ্রুপ বাংলাদেশের অভ্যন্তরে নিজেদের স্বার্থে কাজ করছে। অপর গ্রুপটি মিয়ানমার সীমান্তের ওপারে থেকে প্রত্যাবাসনে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে যাচ্ছে এবং এর পাশাপাশি ৩৪ আশ্রয় শিবিরে খুন খারাবি এবং মাদকের চোরাচালান তৎপরতায় লিপ্ত রয়েছে। এ পরিস্থিতি দিন দিন অবনতি ঘটছে। ইয়াবা এবং আইস নামের মরণ নেশার মাদক মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে আসার রুট তৈরি হয়েছে এসব রোহিঙ্গাদের মাধ্যমে। সীমান্তের ওপারে মিয়ানমারের বিভিন্ন পয়েন্টে ৪৭টি কারখানায় উৎপাদিত ইয়াবা সম্পূর্ণভাবে বাংলাদেশে বাজারজাত করা হচ্ছে। কি পরিমাণ উৎপাদন হচ্ছে আর কি পরিমাণ বাংলাদেশে আসছে এর সঠিক কোন পরিসংখ্যান সরকারী বেসরকারী কোন মহলে নেই। সুনির্দিষ্ট পরিসংখ্যান করাও অসম্ভব একটি বিষয়।
এদিকে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন ইস্যু, অপরদিকে মিয়ানমার থেকে অনবরত আসতে থাকা মাদকের চোরাচালান নিয়ে ব্যতিব্যস্ত অবস্থায় রয়েছে সংশ্লিষ্ট প্রশাসন। এ ধরনের পরিস্থিতিতে আকস্মিকভাবে গত বৃহস্পতিবার দুদেশের মধ্যে ভার্চুয়ালি যে বৈঠকটি হয়েছে সেটি আশার আলো সৃষ্টি করবে কিনা সেটা একমাত্র ভবিষ্যতই বলে দেবে। তবে নিজ দেশে বিভিন্ন বিদ্রোহী গোষ্ঠীর ওপর ন্যক্কারজনক দমন নিপীড়ন চালিয়ে মিয়ানমার বড় ধরনের চাপের মুখে পড়েছে।
রোহিঙ্গা ইস্যুতে আন্তর্জাতিক আদালতে মামলা হওয়ার পর গণহত্যা নিয়ে আগামী ২১ ফেব্রুয়ারি নতুন দফায় শুনানি শুরু হতে যাচ্ছে। ২০১৯ সালে ক্ষমতায় থাকাকালে আউং সান সুচি প্রথম গণশুনানিতে মিয়ানমারের পক্ষে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। পশ্চিম আফ্রিকার ছোট দেশ গাম্বিয়ার তৎকালীন এ্যাটর্নি জেনারেল ও বিচার বিষয়ক মন্ত্রী
আবু বক্কর তাম্বাদু ২০১৯ সালের ১১ নভেম্বর আন্তর্জাতিক আদালতে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে রোহিঙ্গাদের গণহত্যার অভিযোগ এনে মামলা করেন। ওই বছরের ১০ থেকে ১২ ডিসেম্বর নেদারল্যান্ডসের হেগে এ মামলার শুনানি হয়। শুনানিতে মিয়ানমার নিজেদের অপকর্ম ঢাকার জন্য সাফাই বক্তব্য দেয়। এরপর জাতিসংঘের তদন্ত দল যে প্রতিবেদন দেয় তাতে বলা হয় গণহত্যার উদ্দেশ্যে সেনাবাহিনী অভিযান চালিয়েছিল। গত বছরের আগস্ট মাসে আর্জেন্টিনা কেন্দ্রীয় অপরাধ আপীল আদালতে সাক্ষ্য দিয়েছে ৫ নারীসহ কয়েক রোহিঙ্গা পুরুষ। সাক্ষ্যদানকারী নারীরা মিয়ানমার সেনাদের যৌন নির্যাতনের শিকার। ভার্চুয়ালি কক্সবাজার থেকে তারা এ সাক্ষ্য প্রদান করে। নিরাপত্তার স্বার্থে তাদের পরিচয় গোপন রাখা হয়।
অপরদিকে, বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে প্রত্যাবাসনে জাতিসংঘের থার্ড কমিটি সর্বসম্মতভাবে একটি প্রস্তাব পাস করে। এতে ১০৭ দেশের পূর্ণ সমর্থন মিলে, যা ছিল একটি বিরল ঘটনা। এদিকে বাংলাদেশের পক্ষে এ পর্যন্ত এদেশে আশ্রিত ৮ লাখ ২৯ হাজার রোহিঙ্গার একটি তালিকা মিয়ানমারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। এ তালিকার মধ্যে ৪২ হাজারকে মিয়ানমার ঠিক বলে সম্মতি দিয়েছে। বাকিগুলোর বিষয়ে তাদের এখনও আপত্তি এবং তা তদন্তসাপেক্ষ বলে মতব্যক্ত করেছে। এখানে উল্লেখ্য, রোহিঙ্গা ইস্যুতে চীনের মধ্যস্থতায় ২০২০ সালের জানুয়ারিতে মিয়ানমার প্রাথমিকভাবে ৮৪০ রোহিঙ্গাকে ফিরিয়ে নেয়ার মত দেয়। কিন্তু এরপর থেকে পুরো বিষয়টি থমকে রয়েছে। ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট রোহিঙ্গাদের পালিয়ে আসা শুরু হওয়ার পর বিশ^ব্যাপী এ নিয়ে হৈচৈ পড়ে যায়। এরপরের মাসে অর্থাৎ ২৩ নবেম্বর এদের প্রত্যাবাসনে মিয়ানমারের সঙ্গে মূল চুক্তিটি স্বাক্ষর হয়। ২০১৮ সালের ১৬ জানুয়ারি মাঠপর্যায়েও চুক্তিও হয়। ওই বছরের ১৫ ও ২৩ নবেম্বর দুদফায় প্রত্যাবাসন প্রয়াস ব্যর্থ হয়। ফলে এখন পর্যন্ত একজন রোহিঙ্গাও প্রত্যাবাসন হয়নি। গত বছর ১৯ জানুয়ারি চীনের মধ্যস্থতায় মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশের বৈঠক হলেও প্রত্যাবাসন শুরু করা যায়নি। গত বৃহস্পতিবার ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে অনুষ্ঠিত বৈঠকে জানানো হয় মিয়ানমার পক্ষ ৮ লাখ ২৯ হাজারের মধ্যে মাত্র ৪২ হাজারের ভেরিফিকেশন শেষ করেছে মিয়ানমার। এ প্রক্রিয়ায় অতি ধীরগতির কারণে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে হতাশা ব্যক্ত করা হয়। বাংলাদেশের পক্ষে বৈঠকে নেতৃত্ব দিয়েছেন শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার শাহ রেজওয়ান হায়াত। পক্ষান্তরে মিয়ানমারের পক্ষে নেতৃত্ব দিয়েছেন সে দেশের ইমিগ্রেশন ও পপুলেশন মন্ত্রণালয়ের উপমহাপরিচালক ইয়ে তুন ও।
এ বৈঠকের পর রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন ইস্যুটি আবার নতুন করে আলোচনায় এসেছে। চাপে পড়ে মিয়ানমার আবার নতুন কৌশলে নেমেছে কিনা সে প্রশ্নও উঠেছে। যেখানে ১২ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গার অবস্থান এখন বাংলাদেশে সেখানে ১১ লাখেরও বেশি রেজিস্ট্রিভুক্ত হয়েছে ২০১৭ সালের ২৫ আগস্টের পর। বাংলাদেশের পাসপোর্ট ও ইমিগ্রেশন বিভাগের পক্ষ থেকে এ তালিকা সম্পন্ন করা হয়। তবে বেসরকারী পরিসংখ্যান আছে এ সংখ্যা ১২ লাখেরও বেশি। আর এরইমধ্যে রোহিঙ্গা পরিবারগুলোতে নতুন প্রায় ২ লাখ শিশুর আগমন ঘটেছে।
রোহিঙ্গা ইস্যুতে কাজ করছে এমন সংস্থার দায়িত্বশীল একটি সূত্র জানিয়েছে, মিয়ানমার প্রত্যাবাসন ইস্যুতে গত বৃহস্পতিবার যে বৈঠক করেছে তাতে নতুন আশার কোন আলো দেখা যাচ্ছে না। সাড়ে চারবছর কেটে যাচ্ছে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের ভেরিফিকেশন চালাতে। তাও আবার মাত্র ৪২ হাজারের। কিন্তু বাংলাদেশের পক্ষে তালিকা দেয়া হয়েছে ৮ লাখেরও বেশি। এত বিশাল সংখ্যক রোহিঙ্গার তালিকা সুনির্দিষ্ট করতে ধীরগতির কারণে কি পরিমাণ সময় নেবে তা বলাই বাহুল্য। এটা মিয়ানমারের কৌশলী ইচ্ছার প্রতিফলন। কারণ, যে পরিকল্পনায় রোহিঙ্গাদের নিপীড়নের মাধ্যমে দেশান্তরী করা হয়েছে সেটি তাদের সরকারের বহু আগের পরিকল্পনার জের। সঙ্গত কারণে যে পরিমাণে রোহিঙ্গারা পালিয়ে এসেছে তা থেকে ইনিয়ে বিনিয়ে নানা ছলচাতুরী করে তারা আদৌ রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেবে কিনা, আর নিলেও এর সংখ্যা কততে গিয়ে দাঁড়াবে তা নিয়েও বড় ধরনের প্রশ্ন রয়েছে।
উল্লেখ্য, ২০১৭ সালের বহু আগে যেসব রোহিঙ্গা অত্যাচার নিপীড়নে পালিয়ে এসেছিল তাদের মধ্য থেকে এখনও এদেশে রয়ে যাওয়া রোহিঙ্গার সংখ্যা চার লাখেরও বেশি। নতুন করে আরও যে ৮ লাখ যোগ হয়েছে সেখানে প্রত্যাবাসনের বিপক্ষে যত কৌশল আছে সবই গ্রহণ করেছে মিয়ানমার পক্ষ। শুধু তাই নয়, তারা এক সময়ে তাদের চরম শত্রু বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরসার একটি গ্রুপকে প্রত্যাবাসনবিরোধী তৎপরতার ইন্ধন দিয়ে যাচ্ছে। ফলে আশ্রিত রোহিঙ্গারা এখন নিজ দেশে ফিরে যেতেও তেমন আগ্রহী নয়। এছাড়া বাংলাদেশে তারা নির্ভয়ে খেয়ে দেয়ে মিয়ানমারের অবস্থান থেকে বহুগুণে ভাল অবস্থায় রয়েছে। ফলশ্রুতিতে বিভিন্ন মহলে এটিই এখন আলোচনার বিষয় যে, প্রত্যাবাসন শুরু করার সুনির্দিষ্ট দিনক্ষণ ঠিক হলেও রোহিঙ্গারা আদৌ ফিরে যাবে কিনা? কেননা অতীতে দুদফায় প্রত্যাবাসন শুরু করার প্রক্রিয়া ভ-ুল হয়েছে রোহিঙ্গাদের নেতিবাচক মনোভাব অর্থাৎ ফিরে না যাওয়ার ঘোষণার কারণে।