দুই ইস্যুতে সরকারের সঙ্গে আলোচনায় বসতে রাজি বিএনপি

40

কাজিরবাজার ডেস্ক :
আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে আলোচনার পরিবেশ সৃষ্টিতে ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে সংলাপে অংশগ্রহণ করার বিষয়ে ইতিবাচক অবস্থানে রয়েছে বিএনপি।
বিএনপির নীতিনির্ধারকদের সঙ্গে আলাপকালে জানা গেছে, অন্ততপক্ষে দুটি বিষয়ে সরকার নমনীয় হলে তারা আলোচনার ব্যাপারে আন্তরিকতা দেখাবে। ইতোমধ্যে দলের উচ্চপর্যায়ে এ বিষয়ে আলোচনা-পর্যালোচনা শুরু হয়েছে।
বিএনপির প্রভাবশালী কয়েকজন নেতার সঙ্গে আলাপকালে জানিয়েছেন, দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার মুক্তি ও দলীয় নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে মামলা প্রত্যাহারে সরকার তাদের প্রতিশ্রুতি কার্যকর করলে তারা (বিএনপি) নির্বাচনি সংলাপে অংশগ্রহণ করবেন। এ নিয়ে দলের কোনও স্তরে আনুষ্ঠানিক আলোচনা না হলেও উচ্চপর্যায়ের নেতাদের সঙ্গে বিএনপির শীর্ষনেতৃত্বের আলোচনা শুরু হয়েছে।
অপরদিকে দাবি আদায়ের লক্ষ্যে নিয়মিত আন্দোলনের প্রক্রিয়া এগিয়ে নেওয়ার যে কার্যক্রম তাও পাশাপাশি চলবে, বলে জানান দলের নেতারা।
বিএনপির দায়িত্বশীল নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, স্বাভাবিক নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে বরাবরই বিদেশি শক্তিগুলো পরামর্শ দিয়ে থাকে। আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখেও একই প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে। ঢাকায় পর্দার আড়ালে রাজনৈতিক কয়েকটি পক্ষের সঙ্গে কূটনীতিকদের আলাপ-আলোচনা চলছে।
দলীয় সূত্র জানায়, ইতোমধ্যে বিএনপির নেতারা যেসব বিদেশি দেশগুলোর প্রতিনিধিদের সঙ্গে যোগাযোগ করছেন বা যোগাযোগ হচ্ছে, প্রত্যেকেই নির্বাচনে অংশ নেওয়ার পক্ষে মত দিয়েছে। এক্ষেত্রে তিন বছরের সময় ধরে কারাবন্দি খালেদা জিয়ার মুক্তির বিষয়টিকে সর্বাগ্রে দাবি হিসেবে রাখছে বিএনপি। একইসঙ্গে দলের জ্যেষ্ঠ নেতারা যেন নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পারেন সেজন্য রাজনৈতিকভাবে ‘এক-এগারো’ ও পরবর্তী সময়ে যেসব মামলা হয়েছে, সেগুলোও প্রত্যাহার চান বিএনপির নেতারা।
ইতোমধ্যে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্যদের কয়েকজন নির্বাচন ইস্যুতে সরকারের সঙ্গে কোনও ধরনের সংলাপে না যাওয়ার অগ্রিম ঘোষণা দিয়ে রেখেছেন। তবে খালেদা জিয়ার মুক্তি ও মামলা প্রত্যাহার হলে পরিস্থিতি নতুনভাবে তৈরি হতে পারে বলে জানিয়েছেন একাধিক গুরুত্বপূর্ণ নেতা।
শুক্রবার (৩ জুন) বিএনপির একজন প্রভাবশালী নেতা বলেন, খালেদা জিয়ার মুক্তি ও নেতাকর্মীদের মামলা প্রত্যাহার নিশ্চিত হলে নির্বাচন ইস্যুতে সরকারের সঙ্গে আলোচনার টেবিলে যেতে পারে বিএনপি। এটি এখনও সিদ্ধান্ত হয়নি, তবে আলোচনা হচ্ছে।
তবে দলের ভাইস চেয়ারম্যান প্রবীণ রাজনীতিক আব্দুল্লাহ আল নোমান ব্যক্তিগতভাবে মনে করেন, নির্বাচনি সংলাপের সঙ্গে খালেদা জিয়ার মুক্তির বিষয়টির কোনও সম্পর্ক নেই।
শনিবার (৪ জুন) বিকালে সাবেক এই মন্ত্রী বলেন, ‘ম্যাডাম জিয়ার মুক্তি হচ্ছে আমাদের একনম্বর দাবি। তাকে অন্যায়ভাবে গ্রেফতার করে রাখা হয়েছে। নির্বাচনি সংলাপের বিষয়ে কোনও আলোচনা আমাদের সঙ্গে হয়নি। ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, ম্যাডামের কারামুক্তির বিষয়টি সংলাপের সঙ্গে প্রাসঙ্গিক না। নির্বাচন হতে হবে নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে, সরকারকে পদত্যাগ করতে হবে। না হলে জনগণের আন্দোলনের মাধ্যমেই সরকারের পতন নিশ্চিত হবে।’
বিএনপি নেতারা জানিয়েছেন, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ক্ষমতাসীন সরকারের অধীনে অংশগ্রহণ না করার বিষয়ে যে সিদ্ধান্ত ইতোমধ্যে গৃহীত হয়েছে, তা এখনও বহাল রয়েছে। তবে নতুন কোনও পরিবেশ-পরিস্থিতির সৃষ্টি করলে তারা নির্বাচনমুখী হবেন। এ নিয়ে ইতোমধ্যে বিরোধী রাজনীতিতে দোলাচল, সন্দেহ শিরোনামে একটি সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে।
দলের প্রভাবশালী একজন দায়িত্বশীলের পর্যবেক্ষণ খালেদা জিয়ার চিকিৎসা ও তার মুক্তির বিষয়টি রাজনৈতিকভাবে বড় ইস্যু। তার স্বাধীনতা ও চিকিৎসা নিশ্চিত হলে তিনি নিজেই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবেন। তার মুক্তির বিষয়টিতে জড়িয়ে আছে দেশের রাজনৈতিক সহনশীলতার প্রশ্নটিও।
গুরুত্বপূর্ণ এই দায়িত্বশীলের দাবি, ইতোমধ্যেই খালেদা জিয়া রাজনৈতিকভাবে বা সাংগঠনিকভাবে কতটা সক্রিয় হবেনÍ তা পরিষ্কার। নিজের সন্তান তারেক রহমানের হাতে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের দায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়েছেন তিনি। আর খালেদা জিয়া তাকে রাজনৈতিকভাবে প্রতিষ্ঠিত করবেন বলেই যেসব শর্তে সরকার তাকে মুক্তি দিয়েছে, তার ব্যত্যয় তিনি ঘটাননি। ফলে সাবেক প্রধানমন্ত্রী আবারও রাজনীতিতে সক্রিয় হবেন কিনা সন্দেহ রয়েছে। সেদিক থেকে খালেদা জিয়ার হাতে পরিস্থিতি সামলে নেওয়ার সব সুযোগ রয়েছে। সমাধানের পথে খালেদা জিয়া মূল কেন্দ্রবিন্দু, বলে দাবি করেন তিনি।
বিএনপির চেয়ারপারসনের মিডিয়া উইং সদস্য শায়রুল কবির খান জানান, তারেক রহমান ১৯৮৮ সালে বগুড়া জেলা বিএনপিতে যোগদানের মধ্য দিয়ে এ পর্যন্ত নানা দায়িত্ব পালন করে দলের শীর্ষ অবস্থানে এসেছেন। তিনি ২০০৪ সালে সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব, ২০০৯ এ সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান ও সর্বশেষ ২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি থেকে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
বিএনপির উচ্চপর্যায়ের একজন দায়িত্বশীল বলেন, বাংলাদেশে নির্বাচনকালীন সমস্যাটিই সবচেয়ে বড় সমস্যা। যে সমস্যার সমাধান না হলে ঘুরে-ফিরে বারবার রাজনৈতিক অস্থিরতা সৃষ্টি করে। আগামী দিনেও দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে সহিংসতার শঙ্কা বিরাজ করছে। সেক্ষেত্রে দুই নেত্রীর সম্মতির মধ্য দিয়ে রাজনৈতিকভাবে নির্বাচনকেন্দ্রিক সমাধান হলে তা দেশে দীর্ঘস্থায়ী সহাবস্থান সৃষ্টিতে ব্যাপকভাবে অবদান রাখবে বলে মনে করেন এই দায়িত্বশীল।
অর্থনীতিবিদ ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক ড. মাহবুবউল্লাহ মনে করেন, খালেদা জিয়া এখনও ভূমিকা রাখতে সক্ষম। তিনি বলেন, ‘তার উপস্থিতি জনমানুষের মধ্যে সঞ্চারিত হয়। নির্বাচনি সংকট এত বড় সমস্যা নয়, যে সমাধান করা যাবে না। সমাধানের ইচ্ছা তো থাকতে হবে। খালেদা জিয়ার মুক্তিতে সুযোগ তৈরি হতে পারে, কিন্তু সেই সুযোগের ব্যবহার করবে কিনা, এখন পর্যন্ত তা দেখছি না।’
প্রসঙ্গত, ২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি কারাগারে যাওয়ার পর করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ শুরু হলে ২০২০ সালের ২৫ মার্চ সরকারের শর্তসাপেক্ষে ছয় মাসের জন্য মুক্তি পান খালেদা জিয়া।
বিএনপির মিডিয়া-দায়িত্বশীল শায়রুল কবির খান জানান, এরপর ২০২০ সালের সেপ্টেম্বর দ্বিতীয় দফা, ২০২১ সালের মার্চে তৃতীয় দফা ও সেপ্টেম্বর মাসে চতুর্থ দফা ও চলতি বছরের মার্চে পঞ্চম দফায় খালেদা জিয়ার মুক্তির সময়সীমা বাড়ানো হয়।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির প্রবীণ একজন সদস্য মনে করেন, খালেদা জিয়ার মুক্তি, নেতাকর্মীদের মামলা, তারেক রহমানকে দেশে ফেরানোর সুযোগ হলে সহনীয় পরিবেশ হবে।
তিনি উল্লেখ করেন, সরকার যদি এসব বিষয়ে নমনীয় হয়, তাহলে নিশ্চয়ই বিএনপি নির্বাচনে যেতে পারে, আসনও পেতে পারে। আপাতত সংসদে বিরোধী দলের ভূমিকাও কম নয়। বরং যে স্ট্রাগল চলছে, তাতে তো কোনও ফল আসছে না। বরং পরবর্তী নির্বাচনের জন্য শক্তিশালী অবস্থানে থাকবে বিএনপি। এখন তো নেতাকর্মীরা ঘরেও থাকতে পারেন না। প্রতিদিনই তাদের নামে মামলা হচ্ছে।
জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার জমির উদ্দিন সরকার বলেন, ‘খালেদা জিয়া অনেক দিন ধরে সাফার করছেন। তাকে ডিস্টার্ব না করে সম্মান দিলে, সেক্ষেত্রে ইতিবাচক পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে। আমাদের দলে এখনও অফিসিয়ালি কোনও আলোচনা হয়নি, এমনি এমনি আলাপ হচ্ছে।’
ব্যারিস্টার জমির উদ্দিন সরকার আরও বলেন, ‘খালেদা জিয়া দেশকে ভালোবাসেন। সংসদে না গেলে তো দেশ ঠিক করা যাবে না। তার মুক্তি হলে নতুন সিনারিও তৈরি হবে। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এমন চাইবেন বলে মনে হয় না। অতীতে তো তিনি প্রতিশ্রুতি দিয়েও রাখেননি। আন্দোলনের মাধ্যমেই বিএনপি জনগণের দাবি আদায় করবে।’