ওমিক্রন ঠেকাতে সরকার সর্বোচ্চ সতর্ক ॥ নো ভ্যাকসিন নো সার্ভিস- স্বাস্থ্যমন্ত্রী

8

কাজিরবাজার ডেস্ক :
বিশ্বব্যাপী আতঙ্ক তৈরি করা করোনার নতুন ধরন ওমিক্রনের প্রবেশ ঠেকাতে সরকার সর্বোচ্চ সতর্ক অবস্থায় রয়েছে। এর জন্য আফ্রিকান দেশগুলো থেকে ফিরলেই মানতে হবে বাধ্যতামূলক কোয়ারেন্টাইন এবং তা প্রাতিষ্ঠানিকভাবেই। এক্ষেত্রে নিজেকেই কোয়ারেন্টাইনের খরচ বহন করতে হবে। কোয়ারেন্টাইন নিশ্চিতে প্রয়োজনে নেয়া হবে সশস্ত্র বাহিনীর সহায়তা। ওমিক্রন যদি বাংলাদেশে প্রবেশও করে তাহলে এটির ভয়াবহতা রোধে দেশে প্রস্তুত রয়েছে বিভিন্ন হাসপাতালের ১৮ হাজার বেড। যার মধ্যে ১২০ টি হাসপাতালেই রয়েছে সেন্ট্রাল অক্সিজেন লাইন। দৈনিক প্রায় ৩০০ টন অক্সিজেন তৈরি করছে বাংলাদেশ।
এদিকে ওমিক্রনের ভয়াবহতা থেকে বয়স্কদের বাঁচাতে বুস্টার ডোজের কথা চিন্তা করছে সরকার। মানুষকে করোনা টেস্টে উৎসাহিত করতে টেস্ট ফি মওকুফ করারও চিন্তা করছে সরকার। সর্বোপরি টিকাদান কার্যক্রমের পরিধি আরও বাড়ানো হবে। এখন থেকে ‘নো মাস্ক, নো সার্ভিস’ এর পরিবর্তে ‘নো ভ্যাকসিন, নো সার্ভিস’ প্রতিপাদ্যটিকে প্রাধ্যান্য দেয়া হবে।
মঙ্গলবার সচিবালয়ে আন্তঃমন্ত্রণালয় বৈঠক শেষে সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা জানান স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণমন্ত্রী জাহিদ মালেক। এ সময় ওমিক্রন সম্পর্কে তিনি বলেন, ওমিক্রন করোনার নতুন একটি ভ্যারিয়েন্ট, এটি সাউথ আফ্রিকায় দেখা দিয়েছে। এটা আফ্রিকার অনেকগুলো দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। এমনকি যুক্তরাজ্যসহ ইউরোপের অনেকগুলো দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। এ বিষয়ে আমরা আলোচনা করেছি। বাংলাদেশে কীভাবে ওমিক্রন নিয়ন্ত্রণ করা যায়। প্রথমত হলো যাতে না আসে, ঠেকানো যায়, সেই চেষ্টা করা। যদি আসে, কীভাবে ভাইরাস নিয়ন্ত্রণ করব, আক্রান্তদের চিকিৎসার বিষয়ে কাজ করব, বিদেশ থেকে যারা আসবে তাদের কীভাবে গ্রহণ করব, কিভাবে কোয়ারেন্টাইন করব সে বিষয়ে আলোচনা করেছি।
ওমিক্রন ডেল্টা থেকেও বেশি সংক্রমণের ক্ষমতা রাখে জানিয়ে মন্ত্রী বলেন, আক্রান্ত হলে রোগীর মৃদু লক্ষণ থাকে। রোগী দুর্বল হয়, হাল্কা কাশি থাকে, জ্বর হয় না। যে কারণে বোঝা মুশকিল। তিনি বলেন, আমাদের হাসপাতালগুলো প্রস্তুত রয়েছে। করোনা নিয়ন্ত্রণ ও চিকিৎসা মোকাবেলায় যেসব অবকাঠামো তৈরি করেছি এগুলো সেই অবস্থায়ই আছে। বরং আরও বৃদ্ধি করা হয়েছে। বেডও ১৮ হাজার আছে, ১২০টি হাসপাতালে সেন্ট্রাল অক্সিজেন লাইনও রয়েছে। মন্ত্রী জানান, লিকুইড অক্সিজেনের পরিমাণও অনেক, প্রায় ৩০০ টনের কাছাকাছি বাংলাদেশ তৈরি করছে।
এসময় মন্ত্রী বয়স্কদের বুস্টার ডোজ দেয়ার বিষয়ে বলেন, করোনায় সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে রয়েছেন বয়স্ক মানুষ। যদি ওমিক্রন দেশে প্রবেশ করে বয়স্ক ব্যক্তিরাই সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে থাকবেন। তাই ৬০ বছরের বেশি বয়সী নাগরিকদের বুস্টার ডোজ দেয়ার কথা ভাবা হচ্ছে। স্কুল-কলেজ টিকাদান কর্মসূচী এখন যে অবস্থায় আছে এরকমই থাকবে উল্লেখ করে মন্ত্রী বলেন, আমরা বলেছি স্কুলে-স্কুলে গিয়ে টিকা দেয়া হবে। কিন্তু অনেক শিক্ষার্থী টিকা নিতে আসে না। এজন্য স্কুল কর্তৃপক্ষের সহায়তা আমরা কামনা করছি।
ওমিক্রন ঠেকাতে সকলকে স্বাস্থ্যবিধি মানার পাশাপাশি গণজমায়েত না করতে অনুরোধ জানিয়ে স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, দেশে করোনার প্রকোপ কমায় যে ঢিলেঢালাভাব চলে এসেছে তা নিয়ন্ত্রণে কঠোর হতে হবে। করোনা প্রতিরোধে দুই ডোজের টিকা নিয়েছেন এমন অনেকেরই ছয় মাস পেরিয়েছে, যাদের শরীরের এ্যান্টিবডি অনেকটাই কমে এসেছে বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। এ অবস্থায় বিশ্বব্যাপী করোনার নতুন নতুন ধরনও দেশে সংক্রমণ বাড়ার আশঙ্কা তৈরি করছে।
সম্প্রতি আফ্রিকার বিভিন্ন দেশ থেকে যারা ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় এসেছেন, তারা যেভাবে এয়ারপোর্ট থেকে সোজা বাড়িতে চলে গেলেন এ রকম যদি ওইসব দেশ থেকে আরও লোকজন আসে তাহলে কি তারা সরাসরি বাড়িতে কোয়ারেন্টাইনে থাকবেন নাকি প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টাইনের ব্যবস্থা করা হবে সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে মন্ত্রী বলেন, ওরা তো আগে চলে গেছে বাড়িতে। আমরা তো ওমিক্রন সম্বন্ধে জানলামই সাত দিন হলো। সব কিছু বলার আগেই তো ওখানে চলে গেছে। এর মধ্যেও আমরা ডিজি হেলথকে নির্দেশনা দিয়েছিলাম। তারা ১৫ দফা নির্দেশনা দিয়েছেন। ন্যাশনাল টেকনিক্যাল কমিটিও পরামর্শ দিয়েছে।
এসময় আফ্রিকা থেকে আসা লোকজনের ভুল ঠিকানা দেয়াতে ক্ষোভও প্রকাশ করেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী। তিনি বলেন, এই যে লোকজন আমাদের ফাঁকি দিয়ে চলে গেল। আমরা এ্যাড্রেস করতে পারছি না। তারা ওই দেশ থেকে এসেছে, মোবাইল ফোনটাও বন্ধ করে রেখেছে, ভুল ঠিকানা দিয়েছে এই জিনিসগুলো কী রকম! এ জন্য আমরা ওই সব দেশ থেকে আসা লোকজনের বিষয়ে বেশি কড়াকড়ি করব। যারা আফ্রিকান দেশগুলো থেকে আসবে তাদের ১৪ দিনের কোয়ারেন্টাইন তো থাকবেই। আমরা ওখান থেকে আসতেই নিরুৎসাহিত করব।
স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, বিদেশ থেকে বিশেষ করে আফ্রিকা মহাদেশ বা দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে যখন কেউ আসবে, আমরা তাদের আসতে নিরুৎসাহিত করতে চাইব। তাদের সঙ্গে আমাদের যাতে কোন ফ্লাইট না থাকে। ওখান থেকে যারাই আসুক তাদের ১৪ দিনের কোয়ারেন্টাইনে থাকতে হবে বাধ্যতামূলক। সেটা হোম কোয়ারেন্টাইন নয়, প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টাইন। সেই ব্যবস্থা থাকতে হবে, সেই কোয়ারেন্টাইন ম্যানেজমেন্ট খুব শক্ত হতে হবে। আমরা চাই সশস্ত্র বাহিনীর ব্যক্তিরা সেই কোয়ারেন্টাইন ম্যানেজ করবেন।
তিনি আরও বলেন, অন্য দেশগুলো যেখানে এখনও ওমিক্রন ইনফ্যাক্টেড হয়নি সেখান থেকে টেস্টের সার্টিফিকেট নিয়ে আসতে পারবে। কিন্তু অন্য কোন দেশেও যদি এর সংক্রমণ বৃদ্ধি পায়, সেই দেশের লোক এলে আমরা ১৪ দিনের কোয়ারেন্টাইনের কথা ভাবছি। এটাই আমরা করব।
জাহিদ মালেক বলেন, কোয়ারেন্টাইনের বিষয়ে বলা হয়েছে, যাকে হোটেল কোয়ারেন্টাইন করতে দেয়া হয়েছে, তারা অনেক সময় হোটেলে থাকেনি। ফাঁকি দিয়ে বের হয়েছে, বাড়িতে পর্যন্ত চলে গেছে। আমরা এ বিষয়ে শক্ত হওয়ার জন্য বলেছি।
দিয়াবাড়ীতে আগের করা কোয়ারেন্টাইনের স্থানটি থাকলে সেখানেও প্রায় ১০০ হোটেলে কোয়ারেন্টাইন নিশ্চিত করা হবে বলে জানিয়েছেন মন্ত্রী। কোয়ারেন্টাইনের খরচ কে বহন করবে- জানতে চাইলে স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, খরচটা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে নিজে বহন করবেন। কেউ যদি না পারেন তখন আমরা বিবেচনা করব। টেস্টের বিষয়ে আমরা ৭২ ঘণ্টার পরিবর্তে চিন্তা-ভাবনা করছি ৪৮ বা ২৪ ঘণ্টায় নামিয়ে আনা যায় কিনা। কিন্তু কমিয়ে আনব। আমাদের সীমান্তে মনিটরিংটা আরও জোরদার করতে বলা হয়েছে। আমাদের পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্র যেখানে অনেক লোক যাওয়া-আসা করে সেটাকেও একটু কমিয়ে আনা যায় কিনা এ বিষয়গুলো আমরা আলোচনা করেছি।
মন্ত্রী বলেন, আমরা আরেকটি সিদ্ধান্ত নিয়েছে, সব জেলায় চিঠি দেব। জেলা কমিটি উপজেলা কমিটি, ইউনিয়ন কমিটিকেও জানাব। তাদের দায়িত্ব আমরা বলে দেব। আমরা চাই সামজিক, রাজনৈতিক, ধর্মীয় অনুষ্ঠান সীমিত করা হোক। নতুন করে কোন অনুষ্ঠানে গ্রামগঞ্জে ও উপজেলায় যাতে না নেয়া হয়, সেদিকেও আমরা একটা পরামর্শ দেব।
ওমিক্রন মোকাবেলায় করণীয় বিষয়ে জনপ্রতিনিধিদের কাছে চিঠি দেয়ার জন্য স্থানীয় সরকার বিভাগকে অনুরোধ করা হয়েছে জানিয়ে স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, মসজিদের মাধ্যমেও যাতে আলোচনা হয়, ভুল মেসেজ না দেয়া হয়। এটি ইসলামিক ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে করার জন্য আমরা অনুরোধ করেছি। তিনি বলেন, চলাচলের সময় কেউ মাস্ক না পরলে জরিমানা করা ও মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করতে বলা হয়েছে। আমরা স্বাস্থ্য অধিদফতরকে বলেছি তারা যাতে একটা ন্যাশনাল মনিটরিং সেল তৈরি করেন। এই সেলের মাধ্যমে সব জেলা ও উপজেলায় খোঁজ খবর রাখবে ও ত্বরিতগতিতে সিদ্ধান্ত নেবে।
জাহিদ মালেক বলেন, আমরা যেসব সভা করে থাকি। এখন থেকে সভাগুলো, ফিজিক্যাল প্রেজেন্সগুলো একটু কমিয়ে দিয়ে ভার্চুয়াল সভার দিকে যাওয়ার জন্য। সব মিনিস্ট্রি যাতে করে এবং আমরাও সেটা ফলো করব ও এ বিষয়ে পরামর্শ দেব।
ইউরোপের দেশগুলোতেও ওমিক্রন ছড়িয়েছে, ওইসব দেশ থেকে লোকজন আসার বিষয়ে কী সিদ্ধান্ত- জানতে চাইলে তিনি বলেন, ইউরোপে ছড়িয়েছে আমরা জানি, কিন্তু অল্প। তাই ঢালাওভাবে তো আমরা ফ্লাইট বন্ধ করতে পারব না। যারা সংক্রমিত দেশ থেকে আসবে তাদের পরীক্ষা-নিরীক্ষায় আমরা জোর দেব। যে ১৫-২০টি দেশে ওমিক্রন ছড়িয়েছে সেসব দেশকে আমরা আলাদাভাবে দেখব। প্রয়োজন হলে কোয়ারেন্টাইনের বিষয়টাও জোরদার করব।
সভায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, স্থানীয় সরকার বিভাগ, শিক্ষা মন্ত্রণালয়, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়, ত্রাণ ও দুর্যোগ মন্ত্রণালয়, মন্ত্রী পরিষদ বিভাগ, সশস্ত্র বাহিনী বিভাগসহ বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।