মজুদদার : আইনী ও ইসলামী দৃষ্টিকোণ

17

॥ মুহাম্মদ মনজুর হোসেন খান ॥

সামাজিক জীব হিসেবে মানুষ সমাজবদ্ধভাবে একত্রে মিলেমিশে বসবাস করে। প্রয়োজনের তাগিদে একে অন্যের সাথে পারস্পরিক লেনদেন এবং জিনিসপত্রের আদান-প্রদান করে থাকে। প্রাত্যহিক লেনদেনের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে ব্যবসায়-বাণিজ্য। ব্যবহারিক জীবনে ব্যবসায়-বাণিজ্যে পণ্য ও মূল্যের বিনিময় হয়ে থাকে। ক্রেতা ও বিক্রেতার মাঝে পণ্য ও মূল্যে যৌক্তিক বিনিময় আদান প্রদান হওয়া কাম্য হওয়া সত্ত্বেও যখন বিক্রেতা অতি মুনাফার লোভে চড়ামূল্যে বিক্রয় করার জন্য পণ্য সামগ্রী কুক্ষিগত করে, তখন একে বলে মজুদদারি। এর ফলে পণ্যের মূল্য বেড়ে সাধারণ মানুষের ক্রয় ক্ষমতার বাইরেু চলে যায় এবং জনজীবন বিপর্যন্ত হয়ে পড়ে। ইসলাম এ সমস্যা সমাধানে যথাযথ দিক-নির্দেশনা দিয়েছে। ইসলাম মজুদদারিকে হারাম ঘোষণা করত: অতি মুনাফা অর্জনের মানসিকতা পরিহারের নির্দেশ দিয়েছে। মজুদদারির কারণে কোন ভাবেই যেন জনজীবন বিপর্যন্ত না হয়ে পড়ে, সে জন্য কুরআন ও হাদীসে এর প্রতি নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। ইসলামী দৃষ্টিকোণ থেকে মজুদদারির বিভিন্ন দিক আলোচ্য প্রবন্ধে তুলে ধরা হয়েছে।
মজুদদারি-এর পরিচয় : পারস্পরিক সম্পর্ক ও লেনদেনের মধ্যে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা বজায় রাখার স্বার্থে সামাজিক ও অর্থনৈতিক কর্মকান্ডে ইসলাম নিয়ম-নীতি নির্ধারণ করে দিয়েছে। অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হচ্ছে ব্যবসায়-বাণিজ্য। ইসলাম ব্যবসায়-বাণিজ্য উৎসাহিত করতে যেমন বিভিন্ন রকম জাগতিক ও পারলৌকিক প্রাপ্তির ঘোষণা দিয়েছে তদ্রুপ বিভিন্ন ধরনের নৈরাজ্যকর ও অবাঞ্ছনীয় পদক্ষেপ প্রতিরোধে জাগতিক এবং পারলৌকিক শাস্তিও ঘোষণা করেছে। পণ্য সামগ্রী জমা রেখে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে সমাজের দুর্ভোগ বৃদ্ধি ও অতি মুনাফা অর্জন করাকে দন্ডণীয় কাজ হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে।
আভিধানিক অর্থ : মাওজুদ ও মজুদ শব্দ থেকে মজুদদারি শব্দটি এসেছে। মাওজুদ অর্থ হচ্ছে, সঞ্চিত, জমা, হাজির, উপস্থাপিত ইত্যাদি। আর মজুদদারি অর্থ হচ্ছে, দ্রব্যাদি অন্যায়ভাবে মজুদ বা জমা রাখা। যে ব্যবসায়ী অন্যায়ভাবে দ্রব্যাদি মজুদ করে রাখে তাকে মজুদদার বলা হয়। ‘‘শৈলেন্দ্র্যে বিশ্বাস, সংসদ বাংলা অভিধান, কলকাতা সাহিত্য সংসদ, ২০০২, পৃ. ৬৭৬’’।
আরবী ভাষায় মজুদদারিকে ইহতিকার বলা হয়। ইহতিকার শব্দের অর্থ হচ্ছে: একচেটিয়াকরণ, একচ্ছত্র সুবিধাভোগ, মূল্যবৃদ্ধির উদ্দেশ্যে পণ্য ধরে রাখা ইত্যাদি। ‘‘ড. মুহাম্মদ ফজলুর রহমান, আধুনিক আরবী বাংলা অভিধান (আল-মুজামুল ওয়াফী), ঢাকা: রিয়াদ প্রকাশনী, ২০০৯, প. ৪২’’।
লিসানুল আরব গ্রন্থে বর্ণিত হয়েছে, ইহতিকার শব্দটি (হাকরুন) শব্দমূল থেকে এসেছে। শব্দের অর্থ হচ্ছে, খাদ্য সামগ্রী আটকে রেখে পুঞ্জীভূত করা। যে আটক রাখে তাকে (মুহতাকির) বলে। ‘‘ইবনে মানযুর, লিসানুল আরব, আল-কাহেরা: দারুল হাদীস, ২০০৩, পৃ. ৫৩৭’’। আররায়িদ প্রণেতা বলেন শব্দের অর্থ হচ্ছে, অন্যায়ভাবে হ্রাস করা, দুর্ব্যুবহার করা, পণ্য সামগ্রী আটকে রাখা এবং উচ্চমূল্যে লাভবান হওয়া ইত্যাদি। কিন্তু ব্যবসায়-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে শেষ অর্থটিই উদ্দেশ্য। ‘‘জাবরান মাসউদ. আর-রায়িদ, বৈরূত: দারুল ইলম লিল-মায়ায়িন, ১৯৯২, পৃ. ৩১৩’’। আল-মুনজিদ অভিধানে বলা হয়েছে, ‘‘পণ্য মজুদ করে চড়া মুল্যের অপেক্ষায় আটকে রাখা। অত:পর মূল্য বৃদ্ধি পেলে অধিক মুনাফায় তা বিক্রি করা’’। ‘‘কামিল ইসকান্দর হুশাইমার তত্ত্বাবধানে রচিত, আল-মুনজিদ ফিল লুগাতি ওয়াল-আলাম, বৈরূত: দারুল মাশরিক, ২০০০, পৃ. ১৪৬’’।
পারিভাষিক অর্থ : ইসলামী আইনশান্ত্রবিদদের মতে, ইসলামী পরিভাষায় মজুদদারি হচ্ছে, খাদ্যশস্য মজুদ করে কৃত্রিম অভাব সৃষ্টি করা। অত:পর মূল্য বৃদ্ধি পেলে তা বিক্রি করে প্রচুর পরিমাণে লাভবান হওয়া।
আল-হিদায়া প্রণেতার ভাষায়: অর্থাৎ-ইহতিকার বা মজুদদারি হচ্ছে, খাদ্য সামগ্রী ক্রয় করে মূল্য বৃদ্ধির আশায় গুদামজাত করা। ‘‘বুরহানুদ্দীন আল-মারগিনানী, আল-হিদায়া, দিল্লী: মাতবায়া মুজতাবাই, ১৯০৭, পৃ. ৪৫৪’’।
‘‘ইহতিকার হচ্ছে, খাদ্য সামগ্রী বা নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্য সামগ্রী ক্রয় করে উচ্চ মূল্যের জন্য চল্লিশ দিন পর্যন্ত পর্যন্ত আটক রাখা’’। ‘‘ইমাম ইবনে আবেদীন শামী, রাদ্দুল মুহতার, সাহারানপুর: মাকতাবায়ে যাকারিয়া, ১৯৯৬, খ. ৯, পৃ. ৫৭১’’।
ইমাম আবু ইউসূফ’র এর মতে- ‘‘যে সকল জিনিস আটকে রাখলে সর্বসাধারণের কষ্ট হয়, তাকে ইহতিকার বা মজুদদারি বলে’’। ‘‘বুরহানুদ্দীন আল-মারগিনানী, আল-হিদায়া, দিল্লী: মাতবায়া মজুতাবাই, ১৯০৭, পৃ. ৪৫৪’’।
ইমাম গাযালী র. বলেন, ‘‘মজুদদারি হলো, খাদ্য শস্য ক্রয় করত: মূল্য বৃদ্ধি পেলে বিক্রয় করার উদ্দেশ্যে মজুদ করে রাখা’’। ‘‘ইমাম গাযালী, (অনু. আব্দুল খালেক) সৌভাগ্যের পরশমনি, ঢাকা: ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, ১৯৯৩, খ. ২, পৃ. ৭২’’।
ফাতওয়ায়ে রাহমানিয়ায় বর্ণিত হয়েছে, ‘‘মানুষ বা প্রাণির প্রয়োজনীয় খাদ্য সামগ্রী ও জিনিসপত্র সংশ্লিষ্ট এলাকা থেকে ক্রয় করে এমনভাবে জমা করে রাখা যে, বিশেষ প্রয়োজনের মুহূর্তেও (অর্থাৎ যখন উক্ত মালের অভাবে মানুষ ও অন্যান্য প্রাণির কষ্ট হয়) আরো বেশি মুনাফার আশায় বিক্রয় না করাকেই ইহতিকার বা মজুদদারি বলা হয়’’। ‘‘মুফতী মাওলানা মানসূরুল হক, ফাতাওয়ায়ে রাহমানিয়া, ঢাকা: মাকতাবাতুল আশরাফ, ১৪২৭ হি., খ. ২, পৃ. ১৬৭’’।
অর্থনীতির দৃষ্টিতে- Wikipedia তে অর্থনীতির ভাষায় মজুদদারির সংজ্ঞায় বলা হয়েছে, Hoarding is the practice of buying up and holding resources so that they can be sold to customers for profit.  ‘‘মজুদদারি হচ্ছে, পণ্য সামগ্রী ক্রয় করে আটকে রাখার কারবার, যা পরে অধিক মুনাফায় ক্রেতার কাছে বিক্রি করা হবে’’।
পুঁজিবাদী তত্ত্বের ভিত্তিতে মজুদদারির সংজ্ঞা দেয়া হয়েছে এভাবে, If this is done so that the resource can be transferred to the customer or improved upon, then it is a standard business practice (eg buying up a bunch of wood to turn into a house); however, if the sole intent is to hold an otherwise unavailable resource it is considered hoarding.  ‘‘যদি এ কারবার এমন হয় যে, এই পণ্য সামগ্রী ক্রেতার কাছে হস্তান্তর করা হবে বা এ থেকে উৎকৃষ্ট কিছু উৎপন্ন করা হবে, তাহলে এটা একটি উত্তম ব্যবসায়িক কারবার যেমন: কাঠ ক্রয় করে ঘর তৈরী করা; আর যদি ক্রয়ের উদ্দেশ্য হয় দু®প্রাপ্য পণ্য সামগ্রী আটকে রাখা, তাহলে তা মজুদদারি হিসেবে বিবেচিত হবে’’।  ‘Internet, I: \Food Hoarding\Hoarding (economics)- Wikipedia, the free encyclopedia.htm’|  মজুদদারির ধরন : মজুদদারি বিভিন্ন ধরনের হয়ে থাকে। ক্রেতা ও বিক্রেতার উপর নির্ভর করে এর ধরনের ভিন্নতা পরিলক্ষিত হয়। নিম্নে কয়েকটি ধরন উপস্থাপিত হলো-
আংশিক মজুদদারি : অল্প সংখ্যক উৎপাদনকারী বা বিক্রেতা কোন একটি নির্দিষ্ট পণ্য মজুদ করে রাখবে। আর তাদের এই মজুদের কারণে পণ্যের মূল্য বৃদ্ধির পাবে।
পারস্পরিক মজুদদারি : বিক্রেতা বা উৎপাদনকারী নির্দিষ্ট একটি পণ্য আটকে রাখবে। আর এই পণ্যের ক্রেতা থাকবে একজন। ক্রেতাও এই পণ্যের ক্রয় আটকে রাখবে। এখানে পণ্যের মূল্য এই ক্রেতা ও বিক্রেতার মাঝে পারস্পরিক দরকষাকষির উপর নির্ভরশীল থাকবে।
পূর্ণাঙ্গ মজুদদারি : কোন ব্যক্তি একটি পণ্যের উৎপাদন ও বিক্রয় আটকে রাখবে। আর এই পণ্যের বিকল্প দেশের ভিতরে বা বাইরে কোথাও পাওয়া যাবে না।
রাষ্ট্রীয় মজুদদারি : কোন রাষ্ট্র কোন একটি পণ্যের উৎপাদন ও বিক্রয় নিয়ন্ত্রণ করবে। পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি বা পণ্যের মূল্য নিয়ন্ত্রনের উদ্দেশ্যে কখনো পণ্যের উৎপাদন কমিয়ে দিবে বা সরবরাহ যাতে ব্যাহত হয়, সে জন্য বিভিন্ন অপকৌশল গ্রহণ করবে।
আল-কুরআন মজুদদারি প্রসঙ্গ : ইসলাম ব্যবসায়-বাণিজ্যকে উৎসাহিত করেছে। কিন্তু খাদ্য সামগ্রী ও নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি আটকে রেখে কৃত্রিম সংকট তৈরীর মাধ্যমে অধিক মুনাফা অর্জনের মানসিকতাকে ইসলাম নিষিদ্ধ ঘোষনা করেছে। দুনিয়া ও আখিরাতে মজুদদারির ভয়াবহ শাস্তির কথা কুরআনে বর্ণনা করা হয়েছে। ইহতিকার সম্পর্কে আল্লাহ্ তাআলা বলেন, ‘‘যারা সোনা রূপা (ধন-সম্পদ) জমা করে এবং আল্লাহর রাস্তায় খরচ করে না তাদের জন্য আপনি যন্ত্রণাদায়ক আযাবের সংবাদ দিন। সে দিন এসব ধন-সম্পদ আগুনে গরম করা হবে। অত:পর তা দিয়ে তাদের কপাল, পাঁজর আর পিঠে দাগ দেয়া হবে। (বলা হবে), তোমরা যা কিছু নিজেদের জন্য জমা করে রেখেছিলে এগুলো তো সেসব ধন-সম্পদ। সুতরাং তোমরা যা কিছু জমা করে রেখেছিলে, এখন তার স্বাদ আস্বাদন করো’’। ‘‘আল কুরআন, ৯: ৩৪-৩৫’’। অন্য আয়াতে মহান আল্লাহ বলেন, ‘‘যাতে ধন-সম্পদ শুধু বিত্তবানদের মধ্যে পুঞ্জীভূত না হয়’’। ‘‘আল-কুরআন, ৫৯:৭’’। এ সকল আয়াতের তাফসীরে বলা হয়েছে, ধন-সম্পদ পুঞ্জীভূত করে রাখাকে অর্থনৈতিক অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়েছে। কেননা এতে ধন-সম্পদ বিকেন্দ্রীকরণ ও বণ্টন হওয়ার পরিবর্তে শ্রেণী ও সম্প্রদায়-বিশেষের মধ্যে কেন্দ্রীভূত হয়ে পড়ে আর সাধারণ মানুষ হয় নি:স্ব ও দরিদ্র। লেনদেনেও স্থবিরতা দেখা দেয় এবং উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হয়। অনুরূপভাবে পণ্য সামগ্রী আটকে রাখার ফলেও একই রকম সমস্যা পরিলক্ষিত হয়। সুতরাং সম্পদ পুঞ্জীভূতকারী এবং পণ্য মজুদকারী সমান অপরাধী হিসেবে বিবেচিত হবে। আল্লাহ তাআলা তাদের জন্য যন্ত্রণাদায়কে শাস্তির প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।
আল্লাহ তাআলা দৃষ্টান্ত স্বরূপ আল-কুরআনে কারুনের ঘটনা উল্লেখ করেন। কারুন ধন-সম্পদ জমা করে স্বীয় সম্প্রদায়ের প্রতি অন্যায় আচরণ করে এবং যমীনে বিশৃংখলা সৃষ্টি করে। ফলে আল্লাহ তাআলা তাকে, তার ঘর-বাড়ি ও ধন-সম্পদসহ যমীনে ধ্বসিয়ে দিয়ে শাস্তি দেন। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘‘কারুন ছিল মূসা আ. এর সম্প্রদায়ভুক্ত। সে তার প্রতি ঔদ্ধত্য প্রকাশ করল। আমি তাকে এত ধন-ভাণ্ডার দান করেছিলাম, যার চাবি বহন করা কয়েক জন শক্তিশালী লোকের পক্ষে কষ্টসাধ্য ছিল। যখন তার সম্প্রদায় তাকে বলল, দম্ভ করো না নিশ্চয় আল্লাহ দাম্ভিকদের ভালবাসেন না। আল্লাহ তোমাকে যা দান করেছেন, তা দ্বারা পরকালের গৃহ অনুসন্ধান কর এবং ইহকাল থেকে তোমার অংশ ভুলে যেয়ো না। তুমি অনুগ্রহ কর যেমন আল্লাহ তোমার প্রতি অনুগ্রহ করেছেন এবং পৃথিবীতে অনর্থ সৃষ্টি করতে প্রয়াসী হয়ো না। নিশ্চয় আল্লাহ অনর্থ সৃষ্টিকারীদেরকে পছন্দ করেন না। সে বলল, আমি এই ধন-সম্পদ আমার নিজস্ব জ্ঞান-গরিমা দ্বারা অর্জন করেছি। সে কি জানে না যে, আল্লাহ তার পূর্বে অনেক সম্প্রদায়কে ধ্বংস করেছেন, যারা শক্তিতে ছিল তার চাইতে প্রবল এবং ধন-সম্পদে অধিক সমৃদ্ধ। পাপীদেরকে কি তাদের পাপ কর্ম সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হবে না’’। ‘‘আল-কুরআন, ২৮: ৭৬-৭৮’’। কারুন ছিল অহংকারী। সে অঢেল ধন-সম্পদের মালিক ছিল। তার সম্প্রদায় তাকে এ থেকে দান করার জন্য উপদেশ দিয়েছিল কিন্তু সে দান করেনি। বরং আরো ঔদ্ধত প্রদর্শন করে বলেছিল; ধন-সম্পদ সে নিজ জ্ঞান-গরিমায় অর্জন করেছে। আল্লাহ সীমালংঘন ও অবাধ্যতার কারণে তাকে তার ধন-সম্পদ, সহায়-সম্পত্তি ও বাড়ি-ঘরসহ ধ্বংস করে দেন।
আল-হাদীসের মজুদদারি প্রসঙ্গ : ব্যক্তিগত বা সমষ্টিগতভাবে অতি মুনাফা অর্জনের লক্ষ্যে নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য সামগ্রী মজুদ করে আল্লাহর সৃষ্টিকে কষ্ট দেয়া ইসলামের দৃষ্টিতে জঘন্য অপরাধ। রসুলল্লাহ স. পণ্য মজুদ করাকে কঠোরভাবে নিষেধ করেন। তিনি বলেছেন, ‘‘যে লোক চল্লিশ দিন খাদ্য শস্য মজুদ করে রাখল, সে আল্লাহ থেকে নি:সম্পর্ক হয়ে গেল এবং আল্লাহও নি:সম্পর্ক হয়ে গেলেন তার থেকে’’। ‘‘ইমাম আহমাদ, আল-মুসনাদ, আল-কাহেরা: দারুল হাদীস, ১৯৯৫, খ. ৪, পৃ. ৪৩৭, হাদীস নং ৪৮৮০’’।
অধিক মুনাফা অর্জনের জন্য পণ্যদ্রব্য মজুদ করা থেকে বিরত থাকতে রাসূলুল্লাহ (স.) নির্দেশ দিয়েছেন। হাদীসে বর্ণিত হয়েছে ‘‘অধিক মূল্যে বিক্রয় করার উদ্দেশ্যে খাদ্যদ্রব্য আটক করে রাখতে নবী (স.) নিষেধ করেছেন’’। ‘‘মুয়াফ্ফিকুদ্দীন ও শামসুদ্দীন, আ-মুগনী ওয়াশ শারহুল কাবীর আলা মাতানিল মুকনি ফি ফিকহিল ইমাম আহমদ, বৈরূত: দারুল ফিতর, তাবি, খ. ৪, পৃ. ৩০৫’’।
যে ব্যক্তি খাদ্যদ্রব্য মজুদ করে রাখে সে চরম অপরাধী। এ প্রসঙ্গে রাসূলুল্লাহ (স.) বলেন, ‘‘অপরাধী ব্যক্তি ছাড়া কেউ পণ্য মজুদ করে রাখে না’’। ‘‘ইমাম মুসলিম, সহীহ মুসলিম, অধ্যায়: আল-মুসাকাত ওয়াল মুযারায়াত, অনুচ্ছেদ: তাহরীমুল ইহতিকার ফিল-আকওয়াত, আল-কুতুবুস সিত্তাহ, রিয়াদ: দারুল সালাম, ২০০০, পৃ. ৯৫৭’’।
এ অপরাধী কথাটি সহজ অর্থে নয়। যে পণ্য মজুদ করে সে অপরাধী হিসেবে বিবেচিত হবে। কুরআন মাজীদে ফিরাউন, হামান প্রভৃতি বড় বড় কাফির আল্লাহ দ্রোহীদের সম্পর্কে এ শব্দটির ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়। যেমন বলা হয়েছে, ‘‘নিশ্চয় ফিরাউন ও হামান এবং তাদের সৈন্য সামন্ত বড় অপরাধী ছিল”। “আল-কুরআন, ২৮:৮” মজুদদরাও খাদ্য সামগ্রী পুঞ্জীভূত রেখে আল্লাহর সৃষ্টিকে কষ্ট দেয়ার কারণে এরাও কাফির ও আল্লাহ দ্রোহীদের ন্যায় জঘন্য অপরাধী হিসেবে বিবেচিত হবে।
রাসূলুল্লাহ (স.) আরো বলেছেন, “বাজারে পণ্য আমদানীকারক রিযিক প্রাপ্ত হয়। আর পণ্য মজুদকারী অভিশপ্ত হয়”। “ইমাম ইবনে মাজাহ, আস-সুনান, অধ্যায়: আত-তিজারাত, অনুচ্ছেদ: আল-হুকারাতু ওয়াল জালব, আল-কুতুবুস সিত্তাহ, দারুস সালাম, ২০০০, পৃ. ২৬০৬”। আল্লামা ইউসুফ কারযাভী এ হাদীসের ব্যাখ্যায় বলেন, “ব্যবসায়ী দুই ভাবে মুনাফা লাভ করে। একটি হচ্ছে, সে পণ্যদ্রব্য মজুদ করে অধিক মূল্যে বিক্রয় করার আশায় অর্থাৎ পণ্য আটক করে রাখলে বাজারে তার তীব্র অভাব দেখা দেবে তখন যতো চড়া মূল্যই দাবি করা হোক না কেন, তাই দিয়েই তা ক্রয় করতে বাধ্য হবে।
আর দ্বিতীয়টি হচ্ছে, ব্যবসায়ী পণ্য বাজারে নিয়ে আসবে এবং অল্প অল্প মুনাফা নিয়েই তা বিক্রয় করে দেবে। পরে এই মূলধন দিয়ে সে আরো পণ্য নিয়ে আসবে এবং তাতেও সে মুনাফা পাবে। এভাবে তার ব্যবসায় চলতে থাকবে ও পণ্যদ্রব্য বেশি কাটতি ও বিক্রয় হওয়ার ফলে অল্প অল্প করে মুনাফা হতে থাকবে। মুনাফা লাভের এই নীতি ও পদ্ধতিই সমাজ সমষ্টির পক্ষে কল্যাণকর।” “আল্লামা ইউসুফ আল-কারযাভী, অনু. মওলানা মুহাম্মদ আবদুর রহীম, ইসলামে হালাল হারামের বিধান, ঢাকা: খায়রুন প্রকাশনী, ২০১০, পৃ. ৩৫৫”। মজুদদারা হিংস্র মনোভাব পোষণকারী হয়ে থাকে। এরা সব সময় উচ্চ মূল্যের প্রত্যাশায় থাকে। এরা যদি কখনো শুনতে পায় যে, পণ্যমূল্য কমে গেছে, তাহলে বিষণ্ন হয়ে পড়ে। আর যদি শুনতে পায় মূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে তাহলে উল্লাসিত হয়। এ জন্য অন্য আরেক হাদীসে এসেছে, পণ্য মজুদকারী ব্যক্তির উপর সমস্ত সৃষ্টিকুলের অভিশম্পাত বর্ষিত হয়।
মজুদদারি বিষয়ে খোলাফায়ে রাশেদীনের ভূমিকা : খোলাফায়ে রাশেদীনও মজুদদারির বিষয়ে কঠোর ছিলেন। খলিফা উমর রা. ব্যবসায়ীদের পণ্য মজুদকরণ সম্পর্কে ঘোষণা করেছিলেন, “আমাদের বাজারে কেউ যেন পণ্য মজুদ করে না রাখে। যাদের হাতে অতিরিক্ত অর্থ আছে তারা যেন বহিরাগত ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে সমস্ত খাদ্যশস্য কিনে তা মজুদ করে না রাখে। যে ব্যক্তি শীত-গ্রীষ্মের কষ্ট সহ্য করে আমাদের দেশে খাদ্যশস্য নিয়ে আসে সে উমরের মেহমান। অতএব সে তার আমদানীর খাদ্যশস্য যে পরিমাণে ইচ্ছা বিক্রি করতে পারবে, আর যে পরিমাণে ইচ্ছা রেখে দিতে পারবে”।“ইমাম মালিক, আল-মুয়াত্তা, আল-কাহেরা: দারু ইবনিল হায়সাম, ২০০৫, পৃ. ২৭৫, হাদীস নং-১৩২৯” (অসমাপ্ত)