গবেষণায় তথ্য প্রকাশ ॥ তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণে আগামী দশকে সিলেট সহ ৫টি শহর বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়ার আশংকা

8

কাজিরবাজার ডেস্ক :
বসবাস অনুপযোগী হতে যাচ্ছে সিলেট শহর। সম্প্রতি এক গবেষণায় জানা গেছে- অত্যধিক তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণে আগামী এক দশকের মধ্যে সিলেট মহানগরী বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়ার আশংকা প্রকাশ করেছেন গবেষকরা। এতে সিলেট মহানগরীতে কঠিন হয়ে পড়বে মানুষের বসবাস। এমন শঙ্কার কথাই ওঠে এসেছে একটি আন্তর্জাতিক গবেষণায়। অস্ট্রেলিয়ার কার্টিন বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যোগে কানাডার ক্যালগারি বিশ্ববিদ্যালয় এবং বাংলাদেশের মোট ছয়জন গবেষকের গবেষণাপত্রটি আন্তর্জাতিক সাময়িকী ‘সাসটেইনেবল সিটিজ অ্যান্ড সোসাইট “তে প্রকাশিত হয়েছে।
শুধু সিলেট মহানগরীই নয়, একই শঙ্কা ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী ও খুলনা মহানগরীর জন্যও প্রকাশ করা হয়েছে। এর কারণ হিসেবে বলা হচ্ছে, অস্বাভাবিক জনঘনত্ব, কংক্রিটের বাড়িঘর, এয়ারকন্ডিশনিং, কলকারখানার আধিক্য, অপরিকল্পিত নগরায়ণ, জলাভূমি ভরাট, গাছপালা কেটে ফেলা, যানবাহনের অত্যধিক বৃদ্ধি প্রভৃতির কারণে তাপমাত্রা অত্যধিক বৃদ্ধি পাচ্ছে।
আগস্টে সিলেটসহ দেশের পাঁচটি প্রধান শহরে দিনে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা যেখানে থাকার কথা ৩২ থেকে ৩৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস, সেখানে থাকছে ৩৪ থেকে ৩৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস। বৃষ্টিতে তাপমাত্রার খুব বেশি হেরফের হয়নি। গত এপ্রিল থেকে এই সময় পর্যন্ত দিনের বেলা গ্রীষ্মের সময়ের তাপমাত্রাই পরিলক্ষিত হচ্ছে। বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে অস্ট্রেলিয়ার কার্টিন বিশ্ববিদ্যালয় ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা, রাজশাহী ও সিলেটÍএই পাঁচ প্রধান শহরের তাপমাত্রার পরিবর্তন নিয়ে একটি গবেষণা করেছে। তাতে দেখা গেছে, বর্ষা মৌসুমেও রাজধানীসহ এই শহরগুলোর দিনের তাপমাত্রা গ্রীষ্মকালের মতো উত্তপ্ত থাকে। ঢাকা ও চট্টগ্রাম শহর থেকে দিনের বেলা শীতকাল হারিয়েই গেছে। এই দুই শহরে শীতকালে দিনের বেলা শরৎকালের মতো আধা উষ্ণ তাপমাত্রা থাকছে। গত ১৬ বছরে ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, খুলনা ও সিলেটের তাপমাত্রা বেড়েছে। এর মধ্যে ঢাকায় গড়ে ৩ ডিগ্রি আর চট্টগ্রামে ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা বেড়েছে।
বাংলাদেশে ডিসেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সময়কে শীতকাল ধরা হয়। এই সময়ে ঢাকার সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ১২ থেকে ১৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস থাকার কথা। চট্টগ্রামে ১৩ থেকে ১৬ ডিগ্রি। শীতে কোনো এলাকার সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ১০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে নামলে সেখানে শৈত্যপ্রবাহ হচ্ছে বলে বলা হয়। দেশের বেশির ভাগ এলাকায় শীতকালে ছয় থেকে দশটি শৈত্যপ্রবাহ বয়ে যায়। এই দুই শহরে গত পাঁচ বছরে শৈত্যপ্রবাহ হয়নি। শীতে সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ১৫ থেকে ১৮ ডিগ্রি থাকছে।
গবেষণা দলের দলনেতা ও কার্টিন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. আশরাফ দেওয়ান বলেন, জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে আলোচনায় শুধু বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। কিন্তু এই তাপমাত্রা বৃদ্ধির সঙ্গে বড় শহরগুলোর অভ্যন্তরীণ কারণে বেড়ে যাওয়া তাপমাত্রা যোগ হচ্ছে না। ঢাকাসহ দেশের বড় শহরগুলো ধীরে ধীরে অসহনীয় হয়ে উঠছে। পরিকল্পিত বৃক্ষরোপণ ও জলাভূমি না করতে পারলে এই শহরগুলোকে বসবাসের উপযোগী রাখা যাবে না।
চলতি মাসে প্রকাশিত বিশ্বের জলবায়ু পরিবর্তনসংক্রান্ত বিজ্ঞানীদের প্যানেল-আইপিসিসির ষষ্ঠ মূল্যায়ন প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত ৩০০ বছরে বিশ্বের তাপমাত্রা গড়ে ১ দশমিক ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়েছে। এই শতাব্দীর মধ্যে তাপমাত্রা দেড় ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি যাতে না বাড়ে, সে ব্যাপারে প্যারিস চুক্তির আওতায় বিশ্বের রাষ্ট্রগুলো কাজ করছে। অথচ ঢাকাসহ দেশের প্রধান পাঁচটি শহরের তাপমাত্রা গত ১৬ বছরে ৩০০ বছরের বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির তুলনায় অনেক বেশি।
ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা, রাজশাহী ও সিলেট বিভাগের ২০০৩ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত তাপমাত্রা কতটা বেড়েছে, তা বিশ্লেষণ করে গবেষণাটি করা হয়েছে। বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধির সঙ্গে এসব শহরে অপরিকল্পিত নগরায়ণের কারণে উষ্ণতা বেড়ে যাওয়ায় ঋতুচক্রের এ পরিবর্তন ঘটছে বলে গবেষণাটিতে বেরিয়ে এসেছে। চলতি মাসে বিজ্ঞান সাময়িকী সায়েন্স ডাইরেক্ট গবেষণাটির ফলাফল প্রকাশিত হয়েছে।
গবেষণার জন্য ২০০৩ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত প্রতিদিনের চারটি সময়ের তাপমাত্রা বিশ্লেষণ করা হয়েছে। ওই পাঁচ শহরের সকাল সাড়ে ১০টা, বেলা দেড়টা আর রাত সাড়ে দশটা ও দেড়টার তাপমাত্রা স্যাটেলাইট থেকে চিত্র ও তথ্য-উপাত্ত নিয়ে বিশ্লেষণ করা হয়েছে।
গবেষণায় দেখা গেছে, ওই পাঁচ নগরে শীতের সময়ে রাতে ও দিনের তাপমাত্রায় খুব বেশি পার্থক্য থাকছে না। ফলে গরম কাপড় কম পড়তে হচ্ছে। ঘরে বেশির ভাগ সময় বৈদ্যুতিক পাখা ব্যবহার করতে হচ্ছে। শীতাতপনিয়ন্ত্রিত যন্ত্রের ব্যবহার বাড়ছে। এতে নগরবাসীর ব্যয় ও বিদ্যুৎ খরচ বেড়েছে। আর বিদ্যুৎ ব্যবহারে বেড়ে গেছে কার্বন নিঃসরণের পরিমাণও। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) সমীক্ষা অনুযায়ী, ১৯৯৯ সালে ঢাকা শহরের ৬৫ ভাগ কংক্রিট বা অবকাঠামোতে আচ্ছাদিত ছিল। ২০১৯ সালে তা বেড়ে হয় প্রায় ৮২ ভাগ। এই সময়ে জলাশয় ও খোলা জায়গা প্রায় ১৪ ভাগ থেকে কমে ৫ ভাগের নিচে নেমেছে।