অ্যাস্ট্রাজেনেকা ভ্যাকসিনে রক্ত জমাটের ঝুঁকি কতটা উদ্বেগের

3

ড. মুহম্মদ দিদারে আলম মুহসিন :

করোনা অতিমারি এ ধরিত্রীর বাসিন্দাদের পরীক্ষা নেওয়া অব্যাহত রেখেছে। প্রথম ধাক্কাটা কাটতে না কাটতে অনেক দেশেই অতিমারির দ্বিতীয় ঢেউ, এমনকি কোথাও কোথাও তৃতীয় ঢেউ আঘাত হেনে চলেছে। সুনির্দিষ্টভাবে কার্যকর কোনো চিকিৎসাব্যবস্থার অনুপস্থিতিতে বিজ্ঞানীরা অতিমারির সূচনালগ্ন থেকেই সংক্রমণের বিস্তার ঠেকাতে এর বিরুদ্ধে সুরক্ষা দিতে সক্ষম এমন ভ্যাকসিন তৈরির ওপর সর্বোচ্চ গুরুত্ব আরোপ করে আসছিলেন।
বিজ্ঞানীদের অসামান্য পরিশ্রমের ফলে অতিমারি শুরুর এক বছরের মধ্যেই ভ্যাকসিন তৈরিতে সাফল্য আসতে শুরু করে। এখন পর্যন্ত যেসব ভ্যাকসিন সাধারণ্যে প্রয়োগের জন্য বিভিন্ন দেশে অনুমোদন লাভ করেছে, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হলো : ফাইজার-বায়োএনটেক ভ্যাকসিন, মডার্না-এনআইএআইডি ভ্যাকসিন, অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকা ভ্যাকসিন, জনসন অ্যান্ড জনসন (জেঅ্যান্ডজে) ভ্যাকসিন, সাইনোফার্ম-বেইজিং ভ্যাকসিন, সাইনোভ্যাক ভ্যাকসিন এবং স্পুিনক ভি ভ্যাকসিন। ফাইজার ও মডার্নার ভ্যাকসিনে মূল উপাদান হিসেবে করোনাভাইরাসের স্পাইক প্রোটিন নির্দেশকারী এমআরএনএ ব্যবহৃত হয়েছে। অন্যদিকে অ্যাস্ট্রাজেনেকা, জেঅ্যান্ডজে এবং স্পুিনক ভি ভ্যাকসিনে স্পাইক প্রোটিনের কোডবাহী এডেনোভাইরাস (নন-রেপ্লিকেটিং) ভেক্টর ব্যবহার করা হয়েছে। এ ধরনের ভাইরাস মানুষ ও অন্যান্য প্রাণীর দেহে পরিলক্ষিত সাধারণ ঠাণ্ডা সৃষ্টি করে থাকে। অন্যদিকে সাইনোফার্ম ও সাইনোভ্যাক ভ্যাকসিনে সরাসরি করোনাভাইরাসের একটি নিষ্ক্রিয়কৃত ভার্সন ব্যবহার করা হয়েছে।
বাংলাদেশ ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউটের সঙ্গে তিন কোটি ডোজ অ্যাস্ট্রাজেনেকা ভ্যাকসিনের জন্য চুক্তিবদ্ধ হয়েছে। এ ছাড়া কোভ্যাক্স কর্মসূচির আওতায় একই ভ্যাকসিনের আরো ছয় কোটি ৮০ লাখ ডোজ পাওয়ার কথা রয়েছে। সেরাম ইনস্টিটিউট থেকে এরই মধ্যে চুক্তির আওতায় ৭০ লাখ ডোজ এবং ভারত সরকারের উপহার হিসেবে আরো ৩৩ লাখ ডোজ ভ্যাকসিন দেশে এসেছে এবং এর ভিত্তিতে ফেব্রুয়ারি মাস থেকে গণটিকাদান কর্মসূচি চালু হয়েছে। অ্যাস্ট্রাজেনেকা ভ্যাকসিনের উল্লেখযোগ্য সুবিধাদির মধ্যে রয়েছে এর নিম্ন মূল্য (ডোজপ্রতি মাত্র ৪-৮ ডলার) এবং সাধারণ রেফ্রিজারেটরের তাপমাত্রায় (৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস) এর সংরক্ষণযোগ্যতা। তা ছাড়া এটি করোনা সংক্রমণের বিরুদ্ধে ৭০ শতাংশ সুরক্ষা দিতে সক্ষম বলে পরীক্ষায় প্রমাণিত হয়েছে।
মূল্য ও সংরক্ষণ তাপমাত্রার বিচারে অ্যাস্ট্রাজেনেকা ভ্যাকসিন নিঃসন্দেহে আমাদের জন্য একটি ভালো অপশন। তবে দেশে ইদানীং ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়া সাউথ আফ্রিকান ভেরিয়েন্টের বিরুদ্ধে এই ভ্যাকসিন কতটুকু কার্যকর তা নিয়ে কিছুটা প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। অবশ্য সংবাদ সূত্রে প্রকাশ, অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকা এরই মধ্যে এই ভ্যাকসিনের সাউথ আফ্রিকান ভেরিয়েন্টের উপযোগী একটি পরিবর্তিত ভার্সন তৈরির কাজ শুরু করে দিয়েছে, যা বছরের শেষ নাগাদ পাওয়া যাবে বলে আশা করা হচ্ছে। অন্য একটি কারণে এই ভ্যাকসিন সাম্প্রতিক সময়ে বিশেষভাবে সংবাদ শিরোনাম হয়েছে। তা হলো, এই ভ্যাকসিন গ্রহণের ফলে গ্রহীতাদের একটি অতি ক্ষুদ্র অংশের মধ্যে বিশেষ ধরনের রক্ত জমাটের প্রবণতা দেখা গেছে, যা কিছু রোগীর মৃত্যুরও কারণ হয়েছে। এই সমস্যা দেখা দেওয়ায় বিশ্বের অনেক দেশ এই ভ্যাকসিনের প্রয়োগ সাময়িকভাবে স্থগিত করেছে। একটি দেশ, ডেনমার্ক তো এর প্রয়োগ সম্পূর্ণরূপে বাতিলই করে দিয়েছে।
এই সমস্যায় প্রধানত মস্তিষ্ক কিংবা উদর অঞ্চলের শিরাগুলোয় রক্ত জমাট বাঁধতে এবং যুগপতভাবে রক্তের অণুচক্রিকার সংখ্যা হ্রাস পেতে দেখা যায়। সাধারণভাবে ভ্যাকসিন গ্রহণের পাঁচ থেকে ২০ দিনের মধ্যে সমস্যাটি পরিলক্ষিত হতে দেখা গেছে। রোগীর মধ্যে যেসব উপসর্গ দেখা দেয় তার মধ্যে রয়েছে শ্বাসকষ্ট, বুকে ব্যথা, পা ফুলে যাওয়া, অবিরাম পেটে ব্যথা, অনবরত প্রচণ্ড মাথা ব্যথা, চোখে ঝাপসা দেখা, ত্বকে ছোট ছোট লাল দাগ ইত্যাদি। সাধারণত হেপারিন নামক রক্ত জমাট প্রতিরোধী ওষুধ সেবনের পর কিছু বিরল ক্ষেত্রে এ ধরনের সমস্যা হতে দেখা যায়, যা চিকিৎসাশাস্ত্রে হেপারিন ইনডিউসড থ্রম্বোসাইটোপেনিয়া (এইচআইটি) নামে পরিচিত। এর অনুকরণে বিজ্ঞানীরা ভ্যাকসিন গ্রহণের ফলে দেখা দেওয়ায় এই সমস্যাটির নাম দিয়েছেন ভ্যাকসিন ইনডিউসড থ্রম্বোটিক থ্রম্বোসাইটোপেনিয়া (ভিআইটিটি)। এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে, করোনা সংক্রমণের ফলেও এ ধরনের রক্ত জমাটের সমস্যা দেখা দিতে পারে (কভিড-১৯ অ্যাসোসিয়েটেড কোয়াগুলোপ্যাথি-সিএসি)।
দেখা গেছে, যেসব লোকের ক্ষেত্রে হেপারিন গ্রহণের ফলে এ সমস্যা দেখা দেয়, হেপারিন তাদের দেহে প্লাটিলেট ফ্যাক্টর চার নামের একটি প্রোটিনের সঙ্গে বিক্রিয়া করার কারণে শরীরের রোগ প্রতিরোধব্যবস্থার বিরুদ্ধে অ্যান্টিবডি তৈরি করে, যা অবশেষে প্লাটিলেট ভেঙে রক্ত জমাটকারী উপাদানের নিঃসরণ ঘটায়। অ্যাস্ট্রাজেনেকা ভ্যাকসিন গ্রহণে যাদের রক্ত জমাটের সমস্যা হয়েছে, তাদের দেহেও এ ধরনের অ্যান্টিবডির অস্তিত্ব মিলেছে। তবে যে বিষয়টি বিজ্ঞানীদের কাছে এখনো পরিষ্কার নয়, তা হলো এসব ভ্যাকসিন গ্রহীতার শরীরে ভ্যাকসিন নেওয়ার আগে থেকেই কি এ ধরনের কিছু অ্যান্টিবডি ছিল, নাকি ভ্যাকসিন নেওয়ার পরেই শুধু এতে ব্যবহৃত এডেনোভাইরাস, এ থেকে উৎপাদিত স্পাইক প্রোটিন কিংবা এতে বিদ্যমান কোনো অপদ্রব্যের প্রভাবে এগুলো তৈরি হয়েছে। এদিকে ইউনিভার্সিটি অব ইউটাহের ইমিউনোলজিস্ট এরন পেট্রি মনে করেন, করোনা সংক্রমণের ফলে যে রক্ত জমাটের সমস্যা দেখা যায়, সেখানেও একই অ্যান্টিবডি কাজ করে। তবে এ ক্ষেত্রে আরো কিছু মেকানিজম যুগপত্ভাবে সক্রিয় হয়ে থাকে, ফলে সমস্যাটি অধিকতর গুরুতর আকার ধারণ করে।
শুধু অ্যাস্ট্রাজেনেকা ভ্যাকসিন নয়, জেঅ্যান্ডজে ভ্যাকসিনের ক্ষেত্রেও রক্ত জমাটের সমস্যা দেখা গেছে। যেহেতু এ দুটি ভ্যাকসিনই এডেনোভাইরাসে তৈরি, এডেনোভাইরাসের কোনো উপাদান কিংবা এতে মিশ্রিত কোনো অপদ্রব্যের প্রভাবে এসব অ্যান্টিবডি তৈরি হচ্ছে এমনটি মনে করার যুক্তিসংগত কারণ রয়েছে। কিন্তু এডেনোভাইরাসে তৈরি অন্য ভ্যাকসিন স্পুিনক ভির ক্ষেত্রে এ ধরনের কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ঘটেনি বলে দাবি করা হয়েছে। যদিও প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে এর স্বপক্ষে ভ্যাকসিন তৈরিতে ভিন্নতর এডেনোভাইরাস ব্যবহার এবং প্রক্রিয়াজাতকরণকালে উন্নততর বিশোধন পদ্ধতি প্রয়োগসহ বিভিন্ন যুক্তি দেওয়া হয়েছে, এ বিষয়ে এক্ষুনি চূডান্ত কোনো উপসংহার টানা সমীচীন হবে না।
রেগুলেটরি বডিগুলোর কাছে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হলো, ভ্যাকসিন গ্রহণে করোনা থেকে সুরক্ষা প্রাপ্তির উপকারিতার তুলনায় রক্ত জমাটের যে ঝুঁকি তা কতটা গুরুতর। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিচালিত সাম্প্রতিক সময়ে এক গবেষণায় দেখা গেছে, করোনা সংক্রমণের ফলে সেরেব্রাল ভেনাস থ্রম্বোসিস (সিভিটি) অর্থাৎ মস্তিষ্কে রক্ত জমাট বাঁধার ঝুঁকি প্রতি ১০ লাখে ৩৯ এবং অ্যাস্ট্রাজেনেকা ভ্যাকসিনের প্রথম ডোজের পর প্রতি ১০ লাখে পাঁচ। এর মানে দাঁড়ায় করোনা সংক্রমণে সিভিটির আশঙ্কা অ্যাস্ট্রাজেনেকা ভ্যাকসিনের তুলনায় প্রায় চার গুণ বেশি। পাশাপাশি যে বিষয়টি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ তা হলো, অ্যাস্ট্রাজেনেকা ভ্যাকসিন করোনাজনিত গুরুতর অসুস্থতা ও মৃত্যুর বিরুদ্ধে প্রায় পুরোপুরি সুরক্ষা দিতে সক্ষম। কাজেই স্পষ্টতই বোঝা যাচ্ছে, এই ভ্যাকসিন নেওয়ার ফলে রক্ত জমাটের যে বিরল ঝুঁকি রয়েছে তার চেয়ে উপকারিতা বহুগুণ বেশি।
সবাই ভালো থাকুন।
লেখক : অধ্যাপক, ফার্মেসি বিভাগ, জাবি।