রাশিয়া ও চীনের টিকা দেশেই তৈরি হবে ॥ অর্থনৈতিক বিষয় সংক্রান্ত মন্ত্রী সভা কমিটির বৈঠকে অনুমোদন

9

কাজিরবাজার ডেস্ক :
দেশেই তৈরি হবে করোনার টিকা স্পুটনিক-ভি ও সিনোফার্ম। রফতানি নিষেধাজ্ঞায় ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউটের (অক্সফোর্ড-এ্যাস্ট্রাজেনেকা) টিকা পেতে দেরি হওয়ায় বড় ধরনের সঙ্কট তৈরির আগেই বুধবার জরুরী ভিত্তিতে রাশিয়ার স্পুটনিক-ভি ও চীনের সিনোফার্ম টিকার উৎপাদনের অনুমোদন দিয়েছে সরকার। ভারত সরকারের রফতানি নিষেধাজ্ঞার কারণে সেরামের চুক্তি অনুযায়ী তিন কোটি ডোজ টিকা সময়মতো সরবরাহ করা সম্ভব হচ্ছে না বলে জানিয়েছে বেক্সিমকো ফার্মা। তাই সরকারের চলমান টিকা কর্মসূচী সফল করতে এখন বিকল্প টিকার ব্যবস্থা করা ছাড়া আর কোন উপায় নেই। ইতোমধ্যে দুটি পৃথক টিকা ব্যবহার, উৎপাদন ও আমদানির মাধ্যমে সরকার টিকা কর্মসূচিকে অব্যাহত রাখার প্রচেষ্টা চালাচ্ছে।
বুধবার অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত অর্থনৈতিক বিষয় সংক্রান্ত মন্ত্রী সভা কমিটির ১৪তম সভায় এ অনুমোদন দেয়া হয়েছে। সভা শেষে অর্থমন্ত্রী সাংবাদিকদের এ তথ্য জানিয়েছেন। এর আগে মঙ্গলবার রাশিয়ার টিকা স্পুটনিক-ভি বাংলাদেশে ব্যবহারের অনুমোদন দেয়া হয়। সেরামের টিকার বিকল্প খুঁজতে গঠিত কমিটির সুপারিশের পরপরই টিকা পেতে রাশিয়ার সঙ্গে চুক্তি করে বাংলাদেশ সরকার। একইসঙ্গে রাশিয়া থেকে জরুরী ভিত্তিতে আমদানির কথাও বলা হয়েছে। বুধবার স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক রাশিয়ার পর চীনের সিনোফার্মের টিকা আনতে চুক্তি করা হচ্ছে উল্লেখ করেছেন। রাশিয়া ও চীনের টিকা আনার চুক্তির কারণে টিকাদান কাজে বড় বাধা কেটে গেল বলেও সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন।
ভার্চুয়াল সভায় আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেন, রাশিয়ার স্পুটনিক-ভি ও চীনের সিনোফার্ম টিকা দেশে উৎপাদনের অনুমোদন দেয়া হয়েছে। যেসব কোম্পানির সক্ষমতা রয়েছে তারা এসব টিকা উৎপাদন করবে। তবে সরকারের প্রথম অগ্রাধিকার ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউট থেকে এ্যাস্ট্রাজেনেকা ও অক্সফামের টিকা পাওয়ার যে উদ্যোগ তা বাতিল হয়নি। উৎপাদনের চেষ্টার পাশাপাশি সেরাম ইনস্টিটিউট থেকে টিকা পাওয়ার চেষ্টা চালিয়ে যাওয়া হবে। সভায় স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেন, দেশের কয়েকটি কোম্পানির টিকা উৎপাদনের সক্ষমতা আছে। তারাই উৎপাদনের অনুমোদন পাবে। তবে কোন কোন কোম্পানির টিকা উৎপাদনের ক্ষমতা রয়েছে সেটি উল্লেখ করা হয়নি।
সভা শেষে মন্ত্রী পরিষদ বিভাগ অতিরিক্ত সচিব ড. সাহিদা আক্তার বলেন, সরকারের কোভিড-১৯ বিষয়ক জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির পরামর্শ অনুযায়ী চূড়ান্ত অনুমোদন দেয়া হয়েছে। প্রস্তাবনা পেশ করার পরই টিকা উৎপাদনের খরচ সম্পর্কে জানা যাবে। এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, চীন তাদের টিকা বাংলাদেশে উৎপাদনের অনুমতি দিয়েছে। যত শীঘ্রই সম্ভব উৎপাদন শুরু হবে। সভায় দরপত্র ছাড়াই সরাসরি ক্রয় পদ্ধতিতে পিপিই, মাস্ক, পিসিআর কিট কেনার অনুমোদনও দেয়া হয়।
নির্ধারিত সময়ে টিকা সরবরাহ করতে পারছে না বেক্সিমকো ॥ ভারত সরকারের রফতানি নিষেধাজ্ঞার কারণে সেরাম ইনস্টিটিউট অব ইন্ডিয়া (এসআইআই) চুক্তি অনুযায়ী নির্ধারিত সময়ের মধ্যে করোনাভাইরাসের তিন কোটি ডোজ টিকা বাংলাদেশে সরবরাহ করতে পারবে না বলেই মনে করছে বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালস।
বাংলাদেশে সেরাম ইনস্টিটিউটের টিকার ‘এক্সক্লুসিভ ডিস্ট্রিবিউটর’ বেক্সিমকো ফার্মা বুধবার লন্ডন স্টক এক্সচেঞ্জকে জানিয়েছে, ভারত সরকার রফতানি নিষেধাজ্ঞা শিথিল করলে আলোচনার মাধ্যমে বাংলাদেশের টিকার চালান পাওয়ার নতুন সূচী নির্ধারণ করা হবে।
সেরাম ইনস্টিটিউটের কাছ থেকে অক্সফোর্ড-এ্যাস্ট্রাজেনেকার তিন কোটি ডোজ করোনাভাইরাসের টিকা কিনতে গত বছরের নবেম্বরে ত্রিপক্ষীয় চুক্তি করে বাংলাদেশ। চুক্তি অনুযায়ী প্রতি মাসে ৫০ লাখ ডোজ করে ছয় মাসে তিন কোটি ডোজ টিকা পাওয়ার কথা ছিল বাংলাদেশের। বেক্সিমকো ফার্মা বাংলাদেশের ওই টিকা সংরক্ষণ এবং সারাদেশে সরবরাহের দায়িত্বে রয়েছে এবং সেজন্য তারা আলাদা ‘ফি’ পাবে বলে লন্ডন স্টক এক্সচেঞ্জকে জানিয়েছে।
জানুয়ারিতে ৫০ লাখ ডোজ পাওয়ার পর ভারতে ব্যাপক সংক্রমণের মধ্যে বিপুল চাহিদা তৈরি হওয়ায় এবং বিশ্বজুড়ে টিকার সঙ্কটের কারণে ফেব্রুয়ারির চালানে বাংলাদেশ ২০ লাখ ডোজ হাতে পায়। এরপর কেনা টিকার আর কোন চালান আসেনি। এছাড়া ভারতের উপহার হিসেবে ৩২ লাখ টিকা বাংলাদেশ পায়। ৫৭ লাখ প্রথম ডোজ দেয়ার পর সেরামের টিকাই এখন পর্যন্ত ব্যবহার করা হচ্ছে। এখন নতুন করে সেরামের টিকা না আসলে প্রথম ডোজ গ্রহণকারী ১৪ লাখ দ্বিতীয় ডোজ পাবেন না।
লন্ডন স্টক এক্সচেঞ্জের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত বিবৃতিতে বেক্সিমকো ফার্মা বলেছে, ভারতে কোভিড-১৯ ব্যাপক মাত্রায় ছড়িয়ে পড়ায় সেদেশের সরকার টিকা রফতানিতে সাময়িক নিয়ন্ত্রণ আরোপ করেছে। এর ফলে টিকা সরবরাহে কিছুটা দেরি হতে পারে বলে বেক্সিমকো ফার্মা ধারণা করছে কারণ এসআইআই তাদের পরিকল্পনামাফিক মাসিক সরবরাহ নিশ্চিত করতে পারবে না। সেই কারণে এসআইআই ২০২১ সালের জুনে নির্ধারিত তারিখের মধ্যে বাকি দুই কোটি ৩০ লাখ ডোজ টিকা সরবরাহ করতে পারবে বলে বেক্সিমকো ফার্মাও আশা করছে না। বিবৃতিতে বলা হয়, ভারতের রফতানি নিষেধাজ্ঞা শিথিল হলে টিকা সরবরাহের একটি পরিবর্তিত সূচী নির্ধারণে আমাদের প্রতিষ্ঠান এসআইআই-এর সঙ্গে যৌথভাবে কাজ করবে। পাশাপাশি, বেসরকারীভাবে পর্যায়ে ১০ লাখ ডোজ টিকা বিক্রির যে পরিকল্পনার কথা বেক্সিমকো ফার্মা এর আগে জানিয়েছিল, তাও স্থগিত থাকছে বলে এবারের বিবৃতিতে জানানো হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, টিকার সরবরাহ পরিস্থিতি স্থিতিশীল হলে কোম্পানি ওই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের বিষয়টি পর্যালোচনা করবে।
সেরামের টিকা আনতে এজেন্ট প্রতিষ্ঠান হিসেবে বেক্সিমকো ফার্মার বিবৃতিতে স্পষ্ট বলা হয়েছে, ঠিক কবে নাগাদ সেরামের টিকা পাওয়া যাবে সেই বিষয়ে কোন নিশ্চয়তা নেই। তাই বাংলাদেশে টিকাকরণের কাজ এগিয়ে নিতে বিকল্প দুটি টিকা ছাড়া উপায় নেই। তাই দ্রুত সময়ের মধ্যে সরকার রাশিয়া ও চীনের টিকা পেতে উদ্যোগী হয়েছে।
ঔষধ প্রশাসন অধিদফতর কর্মকর্তারদের মতে, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) অনুমোদন দিলে এবং যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, জার্মানি, জাপান, অস্ট্রেলিয়া, ফ্রান্স ও সুইজারল্যান্ডÑ এই সাত দেশে ব্যবহারের অনুমোদন থাকলে সেসব ওষুধ, টিকা বা চিকিৎসা সামগ্রী বাংলাদেশে অনুমোদন দেয়া হয়। ধরে নেয়া হয় বৈজ্ঞানিকভাবে কার্যকর ও নিরাপদ বলেই এসব ওষুধ এবং টিকা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বা ওই দেশগুলো অনুমোদন দেয়। কিন্তু রাশিয়ার টিকাটি ওইসব দেশ বা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অনুমোদন এখনও পায়নি। সে কারণে টিকাটির বিশেষ অনুমোদন দরকার ছিল। চীনের তৈরি সিনোফার্মের টিকা ব্যবহারের ক্ষেত্রেও অনুমোদনের প্রয়োজন রয়েছে।
২০২০ সালের শুরুর দিকে বেজিং ইনস্টিটিউট অব বায়োলজিক্যাল প্রডাক্টস বিবিআইবিপি-করভি নামের নিষ্ক্রিয় করোনাভাইরাসের একটি টিকা তৈরি করে। চীন, সংযুক্ত আরব আমিরাত, বাহরাইন, মিসর, পাকিস্তানসহ আরও কয়েকটি দেশ বর্তমানে এ টিকা ব্যবহার করছে। তবে বাংলাদেশে এটি ব্যবহারের অনুমোদন ছিল না।
অন্যদিকে, রাশিয়া দেশের অভ্যন্তরে ব্যবহারের জন্য স্পুটনিক-ভি টিকার অনুমোদন দেয় গত বছরের আগস্টে। করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ে বিপর্যস্ত ভারত টিকা সঙ্কট কাটিয়ে উঠার জন্য সম্প্রতি স্পুটনিক-ভি ব্যবহারের অনুমোদন দিয়েছে। সেরামের টিকার অনিশ্চয়তা থাকায় বাংলাদেশও এখন এই টিকা ব্যবহারের অনুমোদন দিয়েছে।
এর আগে গত ১৯ এপ্রিল স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালককে প্রধান করে ভারতের সেরামের (অক্সফোর্ড-এ্যাস্ট্রাজেনেকা) টিকার বাইরে কিভাবে দ্রুততম সময়ে বিকল্প উৎস থেকে পাওয়া যায় সেই বিষয়ে প্রস্তাব দিতে কমিটি গঠন করা হয়। এই কমিটিকে ৫ কার্যদিবসের মধ্যে টিকা আমদানির বিকল্প খুঁজতে নির্দেশ দেয়া হয়েছিল। এই সংশ্লিষ্ট কমিটি সোমবার তাদের প্রতিবেদন জমা দেয়। প্রতিবেদন জমা দেয়ার পরদিনই সরকার দ্রুততার সঙ্গে রাশিয়ার টিকা ব্যবহারের অনুমোদন দিল।
করোনা সংক্রমণ কমে এসেছে ॥ দেশে চলমান লকডাউনের ফলে করোনার সংক্রমণও কিছুটা কমে এসেছে বলে দাবি করেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী। তিনি বলেন, কয়েকদিন হলো রোগীর সংখ্যা কমে আসছে। এর অনেক কারণ আছে। জনগণ সচেতন হয়েছে। মাস্ক বেশি পরছে। লকডাউনের কারণে এটা কমে আসছে। দেশে এখন করোনা রোগীর জন্য অর্ধেক বেড ফাঁকা রয়েছে।
প্রতিবেশী ভারতে করোনার বিস্তার লাফিয়ে বাড়ছে। প্রতিদিনই করোনা শনাক্তে বিশ্ব রেকর্ড হচ্ছে দেশটিতে। বাড়ছে মৃত্যুর সংখ্যাও। করোনার এই ঢেউ যাতে দেশে আঁচড়ে না পড়ে সেজন্য ভারতের সঙ্গে সীমান্ত যোগাযোগ বন্ধের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে বলে জানালেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী। তিনি বলেন, ভারতে ভয়াবহ পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। যে কারণে ভারতে সঙ্গে আমাদের সীমান্ত বন্ধ করা হয়েছে।
ভিন্ন টিকার ব্যবহার নিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) ফার্মাকোলোজি বিভাগের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ সায়েদুর রহমান বলেন, ল্যানসেট-এর গবেষণা প্রবন্ধে দেখা গেছে, রাশিয়ার টিকার কার্যকারিতা ৯১ শতাংশের কিছু বেশি। মাঠ গবেষণায় দেখা গেছে, কার্যকারিতা ৯৬ শতাংশের বেশি। টিকাটি ৫০টির বেশি দেশে ব্যবহার করা হচ্ছে। তিনি বলেন, ইতোমধ্যে বিশ্বের কয়েক কোটি মানুষ এই টিকা নিয়েছেন। বাংলাদেশের মানুষের জন্য টিকা এখন জরুরী প্রয়োজন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অনুমোদনের জন্য বসে থাকার সময় নেই। জরুরী অনুমোদনের নজির অন্য অনেক দেশে আছে। তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশে প্রথম ডোজের দুই মাস পর দ্বিতীয় ডোজ দেয়া হলেও অক্সফোর্ড গবেষকরা জানিয়েছেন, দুই ডোজের মধ্যে ১২ সপ্তাহের ব্যবধান থাকলে তা সর্বোচ্চ সুরক্ষা দেয়। তিনি বলেন, এ কারণে যুক্তরাজ্য সরকার ১২ সপ্তাহের ব্যবধানে দুই ডোজ দিয়ে তাদের টিকাদান কর্মসূচী চালাচ্ছে। এমনকি, কানাডার মতো দেশও দ্বিতীয় ডোজ দিচ্ছে ১৬ সপ্তাহ পর। তাই বাংলাদেশ সরকারের হাতে টিকা সংগ্রহের জন্য অতিরিক্ত আরও আট সপ্তাহ আছে। সেক্ষেত্রে সেরামের টিকা পৌঁছাতে কিছুটা দেরি হলে দ্বিতীয় ডোজে ব্যবহার করা যেতে পারে। অধ্যাপক সায়েদুর রহমান বলেন, মহামারীর এ সময়ে পর্যাপ্ত গবেষণা-প্রমাণ না থাকলেও কিছু দেশে দুটি ভিন্ন টিকা ব্যবহার করা হচ্ছে। সরকার এই বিকল্পটির কথাও ভেবে দেখতে পারে।