শেখ হাসিনাকে হত্যাচেষ্টা মামলায় ১০ আসামির মৃত্যুদণ্ড হাইকোর্টে বহাল

10

কাজিরবাজার ডেস্ক :
গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়ায় বোমা পুঁতে রেখে আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যাচেষ্টার মামলায় বিচারিক আদালতে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ১০ জঙ্গি আসামির সাজা বহাল রেখেছেন হাইকোর্ট। রায়ে যাবজ্জীবন দণ্ডিত এক আসামি ও ১৪ বছর করে কারাদণ্ডপ্রাপ্ত তিন আসামির মধ্যে একজনকে খালাস দিয়েছেন হাইকোর্ট।
হরকাতুল জিহাদের শীর্ষনেতা মুফতি আবদুল হান্নান এই মামলায় মূল আসামি ছিলেন। কিন্তু অন্য মামলায় তার ফাঁসি কার্যকর হওয়ায় এই মামলার রায়ে তার নাম বাদ দেয়া হয়েছে।
২০০০ সালের ২২ জুলাই গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়ায় শেখ লুৎফর রহমান সরকারি আদর্শ কলেজ মাঠ প্রাঙ্গণে তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেত্রী শেখ হাসিনার জনসভার জন্য প্যান্ডেল তৈরির সময় শক্তিশালী একটি বোমার সন্ধান মেলে। পরে ৭৬ কেজি ওজনের ওই বোমাটি উদ্ধারের পর নিষ্ক্রিয় করে সেনাবাহিনী। পরদিন (২৩ জুলাই) ওই এলাকা থেকে ৪০ কেজি ওজনের আরও একটি বোমা উদ্ধার করা হয়। এ ঘটনায় ওইদিনই কোটালীপাড়া থানার পুলিশ হত্যাচেষ্টা এবং বিস্ফোরক দ্রব্য আইনে মামলা করে।
ওই মামলায় ডেথ রেফারেন্স ও আসামিদের করা আপিলের বিষয়ে রাষ্ট্র ও আসামি উভয়পক্ষের শুনানি শেষে বুধবার (১৭ ফেব্রুয়ারি) হাইকোর্টের বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেন সেলিম ও বিচারপতি মো. বদরুজ্জামানের সমন্বয়ে গঠিত ভার্চুয়াল বেঞ্চ এ রায় দেন।
এ বিষয়ে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল ড. মো. বশির উল্লাহ জানান, প্রধানমন্ত্রীকে হত্যাচেষ্টার এই মামলায় বিচারিক আদালতে দেয়া ১০ আসামির মৃত্যুদণ্ড বহাল রেখেছেন হাইকোর্ট। তারা হলেন- ওয়াসিম আকতার, রাশেদ ড্রাইভার ওরফে আবুল কালাম, ইউসুফ ওরফে আবু মুসা হারুন, শেখ ফরিদ ওরফে মাওলানা শওকত ওসমান, হাফেজ জাহাঙ্গীর আলম বদর, মাওলানা আবু বক্কর, হাফেজ মাওলানা ইয়াহিয়া, মুফতি শফিকুর রহমান, মুফতি আবদুল হাই ও মাওলানা আবদুর রউফ ওরফে আবু ওমর। এছাড়া মেহেদি হাসান ওরফে আবদুল ওয়াদুদের যাবজ্জীবন কারাদণ্ডও বহাল রয়েছে।
বিচারিক আদালতে ১৪ বছর করে সাজাপ্রাপ্ত বাকি তিন আসামি আনিসুল ওরফে আনিস, মো. মহিবুল্লাহ ওরফে মফিজুর রহমান এবং সরোয়ার হোসেন মিয়ার মধ্যে সরোয়ারকে ঘটনায় সম্পৃক্ততা না থাকায় খালাস দিয়েছেন হাইকোর্ট। বাকি দুজনের সাজা খাটা শেষ হলে তারা মুক্তি পাবেন।
রায় ঘোষণার সময় আদালতে এদিন রাষ্ট্রপক্ষের প্রধান আইন কর্মকর্তা এএম আমিন উদ্দিন উপস্থিত ছিলেন। তার সঙ্গে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল বিশ্বজিৎ দেবনাথ ও ড. মো. বশির উল্লাহ, সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল মিজানুর রহমান খান শাহীন, মো. শাহীন আহমেদ মৃধা, আশিকুজ্জামান বাবু, শাফায়াত জামিল ও সৈয়দা জাহিদা সুলতানা রত্না।
অন্যদিকে, আসামিপক্ষে ছিলেন এডভোকেট এস এম শাহজাহান, মোহাম্মদ আহসান, মো. নাসির উদ্দিন ও অমূল্য কুমার সরকার (স্টেট ডিফেন্স আইনজীবী)।
এর আগে গত ১ ফেব্রুয়ারি এই আপিলের ওপর শুনানি শেষ হয়। পরে এ বিষয়ে রায় ঘোষণার জন্য বুধবার দিন ধার্য করেন উচ্চ আদালত। সে অনুযায়ী হাইকোর্ট আজ এই রায় দিলেন।
রায়ের পর আসামি মেহেদী হাসান ওরফে আব্দুল ওয়াদুদ ওরফে গাজী খানকে বিচারিক আদালতের দেওয়া যাবজ্জীবন কারাদণ্ড এবং ১৪ বছরের দণ্ডিত আসামি আনিসুল ইসলামের দণ্ড বহাল রেখেছেন হাইকোর্ট।
ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল ড. মো. বশির উল্লাহ সাংবাদিকদের বলেছেন, গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়ায় বোমা পুঁতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যাচেষ্টার মামলায় ১০ জঙ্গির মৃত্যুদণ্ড বহাল রেখেছেন হাইকোর্ট। যাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্ত এক আসামি ও ১৪ বছর করে কারাদণ্ডপ্রাপ্ত তিন আসামির মধ্যে একজনকে খালাস দিয়েছেন হাইকোর্ট।
তবে ১৪ বছরের দণ্ডিত মহিবুল্লাহ ওরফে মফিজুর রহমানের দণ্ড বহাল রেখে আদালত বলেন, দেখা যাচ্ছে, শ্যোন অ্যারেস্ট দেখানোর পর থেকে তার ১৪ বছর দণ্ড ভোগ করা হয়ে গেছে। তাকে বিচারিক আদালত ১৪ বছর দণ্ডের পাশাপাশি ১০ হাজার টাকা করে জরিমানা, অনাদায়ে আরও এক বছর করে কারাদণ্ডের নির্দেশ দেন। সুতরাং জেলকোড অনুসারে এ আসামি তার ওপরে প্রদত্ত দণ্ড যদি ভোগ করে থাকেন, তবে তাকে মুক্তি দিতে (যদি অন্য কোনো মামলা না থাকে) নির্দেশ দেয়া হচ্ছে।
এছাড়া, ১৪ বছরের আরেক দণ্ডিত আসামি সারোয়ার হোসেন মিয়াকে খালাস দিয়েছেন হাইকোর্ট। যদি অন্য মামলা না থাকে, তাহলে তাকে মুক্তির নির্দেশ দিয়েছেন।
মামলা সূত্রে জানা গেছে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যাচেষ্টা মামলায় ২০১৭ সালের ২০ আগস্ট ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল-২-এর বিচারক মমতাজ বেগম ১০ জঙ্গির মৃত্যুদণ্ড দিয়ে রায় দেন। এছাড়া চার আসামিকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দেয়া হয়। আসামিদের আপিলের পর এ মামলার রায়সহ সব নথি ওই বছরের ২৪ আগস্ট হাইকোর্টে পাঠানো হয়। এরপর প্রধান বিচারপতির কাছে নথি উপস্থাপন করা হলে তিনি জরুরি ভিত্তিতে পেপারবুক তৈরির নির্দেশ দেন। মামলাটি শুনানির জন্য প্রস্তুত শেষে কার্যতালিকায় দেয়া হয়।
পরে ২০১৮ সালের ২ এপ্রিল বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেন সেলিম ও বিচারপতি মো. জাহাঙ্গীর হোসেনের বেঞ্চে মামলাটির শুনানি শুরু হয়। কিন্তু প্রধান বিচারপতি বেঞ্চ পুনর্গঠন করায় মামলার শুনানি বন্ধ হয়ে যায়। পরবর্তীতে ২০২০ সালের ১৭ জানুয়ারি বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেন সেলিম ও বিচারপতি মো. রিয়াজ উদ্দিন খানের হাইকোর্ট বেঞ্চে নতুন করে শুনানি শুরু হয়।
এই আদালতে মামলাটি বিচারাধীন থাকা অবস্থায় রাষ্ট্রপক্ষ কয়েকদফা সময় নেয়। পরবর্তীতে এই বেঞ্চও পুনর্গঠন করা হলে শুনানি থমকে যায়। এ অবস্থায় আবারও বেঞ্চ পুনর্গঠন করা হয়। সর্বশেষ গঠিত বেঞ্চে ২০২০ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর থেকে নতুন করে শুনানি শুরু হয় যা গত ১ ফেব্রুয়ারি শেষ হয়।
মামলা সূত্রে আরও জানা গেছে, ২০০০ সালের ২০ জুলাই গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়ায় তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সমাবেশস্থলের পাশে তাকে হত্যার উদ্দেশ্যে ৭৬ কেজি ওজনের বোমা পুঁতে রাখা হয়। শেখ লুৎফর রহমান মহাবিদ্যালয়ের উত্তর পাশের একটি চায়ের দোকানের পেছনে এ বোমা বিস্ফোরণের মাধ্যমে শেখ হাসিনাকে হত্যার পরিকল্পনা করা হয়েছিল বলে তদন্তে উঠে আসে। এ ঘটনায় তৎকালীন কোটালীপাড়া থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) নূর হোসেন মামলা দায়ের করেন।
২০০১ সালের ৮ এপ্রিল ১৬ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেয়া হয়। পরবর্তীকালে ২০০৯ সালের ২৯ জুন আরও নয়জনকে আসামি হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করে সম্পূরক অভিযোগপত্র দেয়া হয়। এরপর ২০১০ সালে মামলাটি নিষ্পত্তির জন্য ঢাকা-২ নম্বর দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে পাঠানো হয়। সেখানে এই মামলার বিচার সম্পন্ন হওয়ার পর ২০১৭ সালের ২০ আগস্ট রায় ঘোষণা হয়। পরে এই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করেন আসামিরা।