এক বিলিয়ন ডলার পাবে বাংলাদেশ, মামলায় হেরে গেল নাইকো

15

কাজিরবাজার ডেস্ক :
নাইকো দুর্নীতি মামলায় আন্তর্জাতিক বিনিয়োগ বিরোধ নিষ্পত্তি আদালত (ইকসিড) বাংলাদেশের পক্ষে রায় দিয়েছে। রায়ে ইকসিড বলেছে কানাডিয়ান কোম্পানি নাইকোর গাফিলতিতে ছাতক গ্যাস ক্ষেত্রে বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে। এতে নাইকোর কাছে বাংলাদেশ এক বিলিয়ন ডলারের বেশি বা আট হাজার কোটি টাকার উপরে ক্ষতিপূরণ পাবে। তবে ইকসিড পার্শিয়াল (আংশিক) রায়ে বলছে শুধু গ্যাস পুড়ে যাওয়া নয় বিশাল এলাকার পরিবেশ, প্রতিবেশের পাশাপাশি স্বাস্থ্যগত ক্ষতির হিসেব পুনর্মূল্যায়ন করে প্রতিবেদন জমা দেয়ার পরই আসল ক্ষতির পরিমাণ নির্ধারণ হবে। রবিবার দুপুরে এক অনলাইন সংবাদ সম্মেলনে মামলা জয়ের বিষয়টি আনুষ্ঠানিকভাবে সরকারের তরফ থেকে জানানো হয়েছে। বিদ্যুৎ জ্বালানি এবং খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ এ সময় বলেন, বাংলাদেশে গিয়ে যা ইচ্ছা তাই করা সম্ভব নয়, এই রায়ে বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর কাছে সেই বার্তা পৌঁছেছে। এটি বাংলাদেশের অবস্থাকে পরিষ্কার করেছে। এখানে এসে দুর্নীতি করার কোন সুযোগ নেই। আর এই বার্তাটি দেয়ার জন্যই আমরা ২০১৫ সাল থেকে চেষ্টা করে আসছিলাম। সঙ্গত কারণে আন্তর্জাতিক এই বিরোধ নিষ্পত্তি আদালতে বাংলাদেশ আরও বেশি মনোযোগী হয়। সঠিকভাবে তথ্য উপাত্ত উপস্থাপনের ফলে আমাদের পক্ষে মামলাটির রায় আসে। তিনি বলেন, ২০০৩ সালে দুর্নীতির মাধ্যমে বিএনপি সরকার নাইকোকো কাজ দিয়েছিল। নাইকো দুর্নীতির মাধ্যমে বাংলাদেশে কাজ পাওয়ার কথা এর আগে কানাডার আদালতে স্বীকার করেছে।
ইকসিড ফৌজদারি আদালত নয় বলে এখানে কোন অপরাধীকে জেল দেয়ার আদেশের সুযোগ নেই। এজন্য দেশে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে মামলা চলছে। গত ২৮ ফেব্রুয়ারি মামলাটিতে বাংলাদেশের পক্ষে রায় দেয় ইকসিড। তবে বড় আয়োজনে আনুষ্ঠানিক ঘোষণায় বাদ সাধে কোভিড-১৯। যদিও শেষমেশ গুরুত্বপূর্ণ চেপে রাখা অর্জন প্রকাশ করতে অনলাইন সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়।
ইকসিডে এই মামলা জয়ের ফলে বাংলাদেশ কি পেল ॥ ইকসিড তার রায়ে বলেছে, নাইকো দক্ষতার সঙ্গে তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করতে এবং পেট্রোলিয়াম শিল্পের আন্তর্জাতিক মানের সঙ্গে সামঞ্জস্য বজায় রাখতে ব্যর্থ হওয়ার কারণে এই বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে। তেল গ্যাস অনুসন্ধান এবং উত্তোলনে পেট্রোবাংলা এবং বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে করা চুক্তির শর্ত ভঙ্গের দায় নাইকোর রয়েছে বলে রায়ে উল্লেখ করেছে ইকসিড। তবে এই ক্ষতির পরিমাণ কতটা সে বিষয়ে পরবর্তীতে শুনানি করার কথা জানিয়েছে ইকসিড। সঙ্গত কারণে এখনই বলা সম্ভব নয় বাংলাদেশ কি পরিমাণ ক্ষতিপূরণ নাইকোর কাছ থেকে পাবে। সংবাদ সম্মেলনে ইকসিডে মামলাটির সমন্বয়কারী ব্যারিস্টার মঈন গনি বলেন, বাপেক্স-এর ১১৮ মিলিয়ন ডলার এবং পেট্রোবাংলা এবং সরকারের ৮৯৬ মিলিয়ন ডলার ক্ষতি হয়েছে বলে আমরা ইকসিডে জানিয়েছি। সেই হিসেবে ক্ষতির পরিমাণ এক বিলিয়র ডলার বা তার কিছুটা বেশি হতে পারে। তবে ইকসিড গ্যাস পুড়ে যাওয়ার ক্ষতির সঙ্গে ছাতক এলাকার পরিবেশ প্রতিবেশ এবং স্বাস্থ্যগত ক্ষতির বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করতে বলেছে। এজন্য মার্কিন আইন সহায়তা প্রতিষ্ঠান ফলিহগ এলএলপিকে দিয়ে পুনরায় বিষয়টি মূল্যায়ন করা হবে। সব শেষ ২০১৬ সালে এটি মূল্যায়ন করে ২০১৮ সালে যে প্রতিবেদন ইকসিডে দেয়া হয়েছিল তাতে এক দশমিক ১৪ বিলিয়ন ডলারের ক্ষতির দাবি করেছিল বাংলাদেশ।
কতটা ক্ষতিপূরণ আদায় করা সম্ভব ॥ কানাডার মূল কোম্পানি নাইকো রিসোর্সেস-এর মাধ্যমে দক্ষিণ এশিয়াতে বিশেষ করে ভারত এবং বাংলাদেশে কাজ করার জন্য নাইকো রিসোর্সেস বাংলাদেশ, নাইকো রিসোর্সেস ইন্ডিয়া নামে প্রথম দুটি কোম্পানি নিবন্ধন নেয়া হয়। পরে বাংলাদেশের ব্লক-৯ এর জন্য নাইকো রিসোর্সেস ব্লক-৯ নামে আরও একটি কোম্পানির নিবন্ধন নেয়া হয়। এখন কানাডার মূল কোম্পানি নাইকো রিসোর্সেস সম্পদ শূন্য দেখিয়ে শেয়ার বাজার থেকে তাদের বের করে দেয়া হয়েছে। আর কোম্পানিতে ঋণদাতারা সব সম্পদ নিয়ে গেছে। কজেই আনুষ্ঠানিকভাবে নিজেদের দেউলিয়া ঘোষণা না করলেও নাইকোর সম্পদের পরিমাণ এখন শূন্য। ভারতে তাদের সম্পদও সেই দেশের বিনিয়োগকারীরা কিনে নিয়েছেন। বাংলাদেশে ব্লক-৯ এ নাইকোর যে সম্পদ রয়েছে তার দাম বড়জোর ২৮০ মিলিয়ন ডলার। আর বাংলাদেশের কাছে গ্যাস বিক্রি বাবদ আরও ৩০ মিলিয়ন ডলার পাবে নাইকো। যেহেতু কোম্পানির সম্পদ শূন্য তাই নাইকোর কাছ থেকে ক্ষতিপূরণের পুরো অর্থ পাওয়া কোনক্রমেই সম্ভব নয়। দেশে নাইকোর যে সম্পদ রয়েছে তা জব্দ করলে ৩১০ মিলিয়ন ডলার পাওয়ার আশা করছে বাংলাদেশ। এর আগে নাইকো বাংলাদেশ অংশে থাকা সম্পদ বিক্রি করতে চাইলে পেট্রোবাংলা অনুমোদন দেয়নি। নাইকো বাংলাদেশের কাছে গ্যাস বিক্রির টাকা চাইলে তা দেয়া হয়নি বলে সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়। জ্বালানি বিভাগের সিনিয়র সচিব আনিসুর রহমান সংবাদ সম্মেলনে বলেন, আমাদের তাদের এই অর্থ দিয়ে দিতে হতো এখন আর দিতে হচ্ছে না। রায়ের ফলে আমাদের এখানে দুর্নীতি করা সম্ভব নয় এই বার্তা বিশ্ববাসীর কাছে পৌঁছে গেছে এটিও আমাদের একটি বড় পাওয়া।
নাইকো দুর্নীতির সঙ্গে বিএনপি সরকার জড়িত ॥ দেশে নাইকোর ইতিহাস বলছে ভারতের প্রতিষ্ঠিত একটি শিল্প গ্রুপের সঙ্গে দেশটিতে নাইকোর ব্যবসা ছিল। যৌথ উদ্যোগে দেশটিতে তেল গ্যাস অনুসন্ধানে কোম্পানি খোলে কানাডার এই কোম্পানি। লক্ষ্য ছিল দক্ষিণ এশিয়াতে ব্যবসা সম্প্রসারণ করা। বাংলাদেশে ঢাকা ক্লাবের সাবেক প্রেসিডেন্ট সেলিম ভূঁইয়া নাইকোকে বাংলাদেশে নিয়ে আসেন। তিনিই ছিলেন নাইকোর লোকাল এজেন্ট। তিনি তৎকালীন জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী একেএম মোশাররফ হোসেনের বন্ধু হিসেবে বিভিন্ন মহলে পরিচিত ছিলেন। এর সঙ্গে তৎকালীন জ্বালানি সচিবের ঘনিষ্ঠ জন হিসেবে পরিচিত কাশেম শরীফ এবং তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর ছেলে তারেক রহমানের বন্ধু গিয়াস উদ্দিন আল মামুন বিএনপির হাইকমান্ডের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে নাইকোর হয়ে। জানা যায়, বিএনপি ক্ষমতায় আসার আগেই নাইকো বাংলাদেশে কাজ করতে এসেছিল। গ্যাসক্ষেত্রটিকে প্রান্তিক দেখানোর জোর তৎপরতার মধ্যে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা (১৯৯৬-২০০০ সময়ে) বাদ সাধেন। অনুসন্ধান চালানো হয়নি এরকম একটি গ্যাসক্ষেত্রকে শেখ হাসিনা প্রান্তিক বিবেচনা করতে সম্মত না হওয়াতে নাইকোর তৎপরতা ভেস্তে যায়। গ্যাসক্ষেত্রটি প্রান্তিক কি না তা আগে পর্যালোচনার নির্দেশ দিয়েছিলেন শেখ হাসিনা। পরে ক্ষমতার পালা বদল হলে ২০০০ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট ক্ষমতায় আসে। তখন সেলিম ভূঁইয়া এবং তৎকালীন জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী একেএম মোশাররফ, কাশেম শরীফ এবং গিয়াস উদ্দিন আল মামুনের তৎপরতায় নাইকোর মতো একটি আনাড়ি প্রতিষ্ঠানের হাতে ছাতক গ্যাস ক্ষেত্র তুলে দেয় বিএনপি। আর নাইকো প্রান্তিক ক্ষেত্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয় বিএনপির আইনমন্ত্রী মওদুদ আহমদের আইনী প্রতিষ্ঠানের প্রতিবেদনের ভিত্তিতে। পরে একেএম মোশাররফ চাকরি হারান জ্বালানি মন্ত্রণালয় থেকে। কানাডার আদালতে নাইকো স্বীকার করেছে বিএনপি নেতা একেএম মোশাররফ তাদের কাছ থেকে ঘুষ নিয়েছিলেন। নাইকোর সঙ্গে ২০০৩ সালে পেট্রোবাংলা চুক্তি করে। তখন গ্যাসক্ষেত্রটিকে প্রান্তিক অর্থাৎ কোন গ্যাস নেই এমন দেখানো হয়।
ইকসিডে নাইকোর মামলা ॥ ছাতক গ্যাস ক্ষেত্র পুড়ে গেলেও ব্লক-৯ এ যৌথ একটি অসুসন্ধান কাজ করছিল নাইকো। এখানে গ্যাস পাওয়ার পর নাইকোর গ্যাস বাবদ পাওনা ৩০ মিলিয়ন ডলার আটকে দেয় বাংলাদেশ। এতে ২০১০ সালে নাইকো ইকসিডে মামলা করে। নাইকো দাবি করে তারা ছাতক গ্যাস ক্ষেত্রে বিস্ফোরণের জন্য কোনভাবে দায়ী নয়। একই সঙ্গে বাংলাদেশ গ্যাসের বিল বাবদ যে ৩০ মিলিয়ন ডলার আটকে রেখেছে তা ফেরত চায়। বাপেক্স ২০১৬ সালে আন্তর্জাতিক পরামর্শক দিয়ে ক্ষতি মূল্যায়ন করে নিজেদের ১১৮ মিলিয়ন ডলার এবং পেট্রোবাংলা এবং সরকারের ৮৯৬ মিলিয়ন ডলার ক্ষতিপূরণ দাবি করে নাইকোর কাছে। প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেন, ১০ বছর সময় লেগেছে এই শুনানি হতে। এরপরও আশার কথা হচ্ছে রায় আমাদের পক্ষে এসেছে। ব্যারিস্টার মঈন গনি বলেন, আমরা ইকসিডে স্বীকার করেছি আমরা তাদের কাছ থেকে গ্যাস নিয়েছি। তারা আমাদের কাছে টাকা পায়। একই সঙ্গে আমাদের ক্ষতির বিষয়টি আমরা প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করেছি। সঙ্গত কারণে আমাদের বিপুল ক্ষতির চেয়ে তাদের পাওনা খুব সামান্য।
কি হবে নাইকোর সঙ্গে জড়িতদের ॥ ইকসিড যেহেতু শুধু বিনিয়োগ বিরোধ নিষ্পত্তি করে তাই এখানে ফৌজদারি কোন বিষয়ে সুরাহা পাওয়া সম্ভব নয়। বাংলাদেশের অভ্যন্তরে কারা দুর্নীতি করে কাজ দিয়েছে বিষয়টি ইকসিড বিবেচনা করেনি। এর বিচার পেতে হলে অপেক্ষা করতে হবে দেশের আদালতে বিচার প্রক্রিয়া শেষ হওয়া পর্যন্ত। মামলার আইনজীবী ব্যারিস্টার মঈন গনি সেই কথাই জানিয়েছেন।
দুর্নীতি দমন কমিশন ২০০৭ সালের ৯ ডিসেম্বর তেজগাঁও থানায় ক্ষমতার অপব্যবহার করে তিনটি গ্যাসক্ষেত্র পরিত্যক্ত দেখিয়ে নাইকোর হাতে তুলে দিয়ে রাষ্ট্রের প্রায় ১৩ হাজার ৭৭৭ কোটি টাকার ক্ষতি করার অভিযোগে মামলা দায়ের করে। গত ৩১ মার্চ মামলার অভিযোগ গঠনের শুনানির দিন ধার্য ছিল। তবে কোভিডের কারণে আদালত বন্ধ থাকায় তা সম্ভব হয়নি। আন্তর্জাতিক আদালতে ১০ বছরে রায় এলেও দেশের আদালত ১৩ বছরেও মামলার অভিযোগ গঠনের শুনানিই করতে পারেনি। এই মামলায় বেগম খালেদা জিয়া ছাড়া মামলার অন্য আসামিরা হলেন- সাবেক মন্ত্রী মওদুদ আহমদ, সাবেক প্রতিমন্ত্রী এ কে এম মোশাররফ হোসেন, সাবেক মুখ্য সচিব কামাল উদ্দিন সিদ্দিকী, সাবেক সচিব খন্দকার শহীদুল ইসলাম, সাবেক জ্যেষ্ঠ সহকারী সচিব সি এম ইউছুফ হোসাইন, বাপেক্সের সাবেক মহাব্যবস্থাপক মীর ময়নুল হক, বাপেক্সে সাবেক সচিব মোঃ শফিউর রহমান, ব্যবসায়ী গিয়াস উদ্দিন আল মামুন, ঢাকা ক্লাবের সাবেক সভাপতি সেলিম ভূঁইয়া এবং নাইকোর দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক ভাইস প্রেসিডেন্ট কাশেম শরীফ।