আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো…

16

কাজিরবাজার ডেস্ক :
কবি মাহবুব উল আলম চৌধুরীর ‘কাঁদতে আসিনি ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছি’ কবিতায়- ‘এখানে যারা প্রাণ দিয়েছে/রমনার ঊর্ধ্বমুখী কৃষ্ণচূড়ার তলায়/ যেখানে আগুনের ফুলকির মতো/ এখানে ওখানে জ্বলছে অসংখ্য রক্তের ছাপ/ সেখানে আমি কাঁদতে আসিনি’। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন ছিল তৎকালীন পূর্ব বাংলার একটি সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক আন্দোলন। মৌলিক অধিকার রক্ষাকল্পে বাংলা ভাষা ঘিরে সৃষ্ট এ আন্দোলনের মাধ্যমে তৎকালীন পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে গণদাবির বহিপ্রকাশ ঘটে। বায়ান্নর ২১ ফেব্রুয়ারিতে এ আন্দোলন চূড়ান্ত রূপধারণ করলেও বস্তুত এর বীজ বপন হয়েছিল বহু আগেই। অন্যদিকে এর প্রতিক্রিয়া ও ফল ছিল সুদূরপ্রসারী। বদরুদ্দীন উমরের ‘পূর্ব বাংলার ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতি (তৃতীয় খন্ড) বইয়ে উল্লেখ রয়েছে, ১৮ ফেব্রুয়ারি ভোরে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে একটি চিঠি গোপনে পাচার হয়ে আসে। তাতে বলা হয়, শেখ মুজিবুর রহমান ও বরিশালের মহিউদ্দীন আহমেদ নিজেদের মুক্তির জন্য জেলের মধ্যে অনশন ধর্মঘট শুরু করেছেন। ওই সংবাদের সঙ্গে চিঠিতে রাজবন্দীদের মুক্তির দাবিতে আন্দোলন শুরু করার অনুরোধ জানানো হয়।
গণপরিষদে ভাষাবিষয়ক প্রস্তাব নিয়ে গণপরিষদে কংগ্রেস সেক্রেটারি রাজকুমার চক্রবর্তী সংশোধনী প্রস্তাবের সমর্থনে বলেন, উর্দু পাকিস্তানের কোন প্রদেশেরই ‘কথ্য ভাষা’ নয়। উর্দু হচ্ছে পশ্চিম পাকিস্তানের উপরতলার কিছু মানুষের ভাষা। পূর্ববাংলা এমনিতেই কেন্দ্রীয় রাজধানী করাচী থেকে অনেক দূরে অবস্থিত। তার ওপর এখন তাদের ঘাড়ে একটা ভাষাও চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা হচ্ছে। একে গণতন্ত্র বলে না। আসলে এ হলো অন্যদের ওপর উচ্চশ্রেণীর আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা। বাংলাকে আমরা দুই অংশের সাধারণ ভাষা করার জন্য কোন চাপ দিচ্ছি না। আমরা শুধু চাই পরিষদের সরকারী ভাষা হিসাবে বাংলার স্বীকৃতি। ইংরেজীকে যদি সে মর্যাদা দেয়া হয় তাহলে বাংলাভাষা সে মর্যাদার অধিকারী। বদরুদ্দীন উমরের ‘পূর্ব বাংলার ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতি (প্রথম খন্ড) বইয়ে গণপরিষদে ভাষার এমন প্রস্তাবের বিষয়টির উল্লেখ হয়েছে।
’৪৭ সালে দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে ব্রিটিশ ভারত ভাগ হয়ে পাকিস্তান জন্ম হয়। কিন্তু পাকিস্তানের দুটি অংশ-পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে সাংস্কৃতিক, ভৌগোলিক ও ভাষাগত দিক থেকে অনেক মৌলিক পার্থক্য বিরাজ করছিল। ’৪৮ সালে পাকিস্তান সরকার ঘোষণা করে, উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা। এ ঘোষণার প্রেক্ষাপটে পূর্ব বাংলায় বাংলাভাষীদের মধ্যে গভীর ক্ষোভের জন্ম হয়, বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে। কার্যত পূর্ব পাকিস্তান অংশের বাংলাভাষী মানুষ আকস্মিক ও অন্যায্য এ সিদ্ধান্ত মেনে নিতে পারেনি। মোটেও প্রস্তুত ছিল না মানসিকভাবে। ফলে বাংলাভাষার সমমর্যাদার দাবিতে পূর্ব বাংলায় আন্দোলন দ্রুত দানা বেঁধে ওঠে। আন্দোলন দমনে পুলিশ ১৪৪ ধারা জারি করে ঢাকা শহরে সমাবেশ মিছিল বেআইনী ও নিষিদ্ধ ঘোষণা করে।
বদরুদ্দীন উমর তাঁর বইয়ে লিখেছেন, ১৮ ফেব্রুয়ারির ওই চিঠি পাওয়ার পরই ১৯ ফেব্রুয়ারি বন্দীদের মুক্তি দাবিতে বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি ছাত্রসভা ডাকা হয়। ওই সভায় সভাপতিত্ব করেন মোখলেছুর রহমান। সভায় যারা বক্তৃতা দেন তাদের মধ্যে ছিলেন জিল্লুর রহমান, নাদিরা বেগম ও শামসুল হক চৌধুরী। সভায় শেখ মুজিবুর রহমান ও মহিউদ্দীন আহমেদসহ সব রাজবন্দীর মুক্তি দাবি করে প্রস্তাব গ্রহণ ছাড়াও ‘বিশ্ববিদ্যালয় রাজবন্দী মুক্তি আন্দোলন কমিটি’ নামে একটি কমিটি গঠন করা হয়। এই কমিটি গঠনের কয়েকদিনের মধ্যে ঢাকা জেলা ম্যাজিস্ট্রেট বদলি হয়ে যান। ভাষা আন্দোলন শুরু হওয়ার পর ঢাকা জেলার ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন হায়দার নামে এক প্রবীণ অফিসার। এ বিষয়ে প্রাদেশিক মুসলিম লীগের তৎকালীন সম্পাদক মোহন মিয়ার বক্তব্য হলো, ‘ফরিদপুর জেলা বোর্ডের নির্বাচন উপলক্ষে ফরিদপুর রওনা হই। রাত দশটা/এগারোটার দিকে আমি নূরুল আমিনের বাড়ি হয়ে যাই। সে সময় ভাষা আন্দোলন নিয়ে নানা বিষয়ে আলাপ-আলোচনা করি। ছাত্ররা বড় ধরনের গ-গোল করতে পারে। এ বিষয়েও কথা হয়। এরপরই নানা পদক্ষেপ নেয়া হয়েছিল।
বায়ান্নর ২১ ফেব্রুয়ারি (৮ ফাল্গুন ১৩৫৮) ১৪৪ ধারা অমান্য করে ঢাবির বহু ছাত্র ও প্রগতিশীল কিছু রাজনৈতিক কর্মী মিলে মিছিল শুরু করেন। মিছিলটি ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের কাছাকাছি এলে ১৪৪ ধারা অমান্যের অজুহাতে পুলিশ আন্দোলনকারীদের ওপর গুলিবর্ষণ শুরু করে। গুলিতে নিহত হন রফিক শফিউল সালাম বরকতসহ আরও অনেকে। শহীদের রক্তে রঞ্জিত হয় রাজপথ। শোকাবহ এ ঘটনায় সমগ্র বাংলায় তীব্র ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে।
১৯৫২ সালের ২৭ জানুয়ারি পাকিস্তান মুসলিম লীগের সম্মেলন উপলক্ষে পল্টনের জনসভায় পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দীন দম্ভের সঙ্গে আবারও ঘোষণা করলেন উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা। পূর্ব পাকিস্তানের ছাত্রজনতা নাজিমুদ্দীনের এই ঘোষণা চ্যালেঞ্জ হিসেবে গ্রহণ করেন। ৩১ জানুয়ারি আওয়ামী লীগ সভাপতি মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর সভাপতিত্বে সর্বদলীয় কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। প্রাদেশিক পরিষদের বাজেট অধিবেশন সামনে রেখে ২১ ফেব্রুয়ারিকে ভাষা দিবস ঘোষণা করে সারাদেশে সর্বাত্মক হরতাল ডাকা হয়। ২০ ফেব্রুয়ারি বিকেলে মাইকযোগে পূর্ববঙ্গ সরকার ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় ১৪৪ ধারা জারির ঘোষণা দেয়। ১৪৪ ধারা জারির সঙ্গে সঙ্গে ছাত্রসমাজ উত্তেজিত হয়ে ওঠে।
২০ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যার পর নবাবপুর আওয়ামী মুসলিম লীগ অফিসে আবুল হাশিমের সভাপতিত্বে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের সভা হয়। অলি আহাদ মেডিক্যাল কলেজের ছাত্রসংসদের সভাপতি গোলাম মাওলা, আবদুল মতিন ১৪৪ ধারা ভাঙ্গার ওপর জোরাল বক্তব্য রাখেন। তাদের সমর্থন করেন ফজলুল হক মুসলিম হল ইউনিয়নের সহসভাপতি শামসুল আলম।