মহাসড়কের ২১ পয়েন্টে মাপা হবে গাড়ির ওজন

27

কাজিরবাজার ডেস্ক :
যাতায়াত সহজ আর আরামদায়ক করতে একাধিক লেন করা হচ্ছে। কিন্তু যানবাহনের অতিরিক্ত ওজনের (ওভারলোড) কারণে নির্ধারিত সময়ের আগেই শেষ হচ্ছে সড়কের আয়ুষ্কাল। এতে অনেক ক্ষেত্রে ভোগান্তি বাড়ছে জনগণেরই। দেশের সড়কের এমন পরিণতি ঠেকাতে এবং মহাসড়ক টেকসই করতে বিশেষ উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। সড়ক-মহাসড়কের ক্ষতির হাত থেকে বাঁচাতে ২১ পয়েন্টে বসানো হবে এক্সেল লোড কন্ট্রোল স্টেশন (পণ্যবাহী গাড়ির ওজন নিয়ন্ত্রক যন্ত্র)। আর এই যন্ত্র বসাতে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগ ব্যয় করবে ১ হাজার ৬৩০ কোটি ২৭ লাখ ৯১ হাজার টাকা। আর এই প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে সড়কের ক্ষতিও কমে আসবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। এছাড়া প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও সড়কে লোড নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দিয়েছেন।
জানা গেছে, দেশের বিভিন্ন জেলার সঙ্গে সড়ক পথে যোগাযোগ ও আরামদায়ক করতে বিভিন্ন বিভাগে ইতোমধ্যেই ফোরলেন চালু রয়েছে। সরকার প্রতিবছর কোটি কোটি টাকা খরচ করছে সড়ক পথ ভাল রেখে যাতায়াতে মানুষের ভোগান্তি কমানোর জন্য। অথচ অনেক সময়ই দেখা যাচ্ছে যানবাহনের অতিরিক্ত ওজনের কারণে রাস্তা ভেঙ্গে যাচ্ছে, কোথাও দেবে যাচ্ছে। এতে ভোগান্তিও বাড়ছে। তাই ‘সড়ক ও জনপথ অধিদফতরের আওতাধীন গুরুত্বপূর্ণ মহাসড়কে পণ্য পরিবহনের উৎসমুখে এক্সেল লোড নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র স্থাপন’ নামে একটি প্রকল্প হাতে নিয়েছে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়। ইতোমধ্যেই জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় প্রকল্পটি অনুমোদনও দেয়া হয়েছে। প্রকল্প ব্যয়ের পুরোটাই অর্থায়ন করবে সরকারের নিজস্ব তহবিল।
সড়কে লোড নিয়ন্ত্রণ বিষয়ে পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নান বলেন, সড়কে যান বেড়েছে। ব্যবসায়ীরা প্রায়ই পণ্য বেশি নেন। সব সড়কেই বেশি লোড হচ্ছে। রাস্তা টেকাতে দুটি পদ্ধতি একটি হচ্ছে লোড মনিটরিং অন্যটি হচ্ছে রক্ষণাবেক্ষণ। আমাদের এই প্রকল্প সংশ্লিষ্ট বিভাগ লোড মনিটরিং করবে। এর জন্য যন্ত্র বসানো হবে। এছাড়াও সেপ্টেম্বরের ৩ তারিখে অনুষ্ঠিত একনেক সভায় এ বিষয়ে নির্দেশনাও দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। কেউ যেন ওভারলোডিং না করতে পারে প্রধানমন্ত্রীর সেই নির্দেশনার কথা উল্লেখ করে পরিকল্পনামন্ত্রী জানান, প্রধানমন্ত্রী মহাসড়কে যানবাহনে যাতে লোড টেম্পারিং না হয় সে দিকে খেয়াল রাখার নির্দেশ দিয়েছেন। এছাড়াও কেন্দ্রীয়ভাবে এটি মনিটরিংয়ের ব্যবস্থা রাখতে বলেছেন যাতে কেউ অতিরিক্ত পণ্য নিলে নাম, ঠিকানা, গাড়ি নম্বর অটোমেটিক কেন্দ্রীয় মনিটরে উঠে যাবে। অর্থাৎ এই যন্ত্র বসানোর ক্ষেত্রে অত্যাধুনিক প্রযুক্তির কথা বলেছেন বলেও জানান। এছাড়া সড়কের শৃঙ্খলা রক্ষার বিষয়েও প্রধানমন্ত্রী বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছেন ওই সভায়।
সড়ক ও জনপথ অধিদফতর সূত্র জানিয়েছেন, অধিদফতরের আওতায় সারা দেশে সড়ক ও জনপথ অধিদফতরের জাতীয়, আঞ্চলিক মহাসড়ক ও জেলা সড়কসহ মোট ২১ হাজার ৩০২ দশমিক ৮ কিলোমিটার মহাসড়ক রয়েছে। সড়কগুলোর ডিজাইন প্রণয়নে আরএইচডি পেভমেন্ট ডিজাইন গাইড এবং দ্য আমেরিকান এ্যাসোসিয়েশন অনুসরণ করা হয়। সাধারণত ১০-২০ বছর ডিজাইন লাইফ ধরে কমিউলেটিভ ইক্যুইভ্যালান্ট স্ট্যান্ডার্ড এক্সেল লোড (সিইএসএএল) হিসাব করে ডিজাইন করা হয়। বাংলাদেশ গেজেট অতিরিক্ত সংখ্যা ৫ মে ২০০৪ অনুযায়ী, দুই চাকাবিশিষ্ট ফ্রন্ট এক্সেল ও চার চাকাবিশিষ্ট রিয়ার এক্সেলের সর্বোচ্চ ওজন সীমা ইউনিট ধরা হয় ১৫ দশমিক ৫ টন। যা বাংলাদেশে চলাচলকারী অধিকাংশ ডাবল এক্সেল অর্থাৎ ছয় চাকাবিশিষ্ট যানবাহনের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। কিন্তু বাস্তবে দেখা যায় সড়কগুলোতে ২০-৩০ টন ওজনবিশিষ্ট ট্রাক বা কাভার্ডভ্যান চলাচল করে। ফলে নির্ধারিত আয়ুষ্কালের অনেক আগেই সড়কগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে যান চলাচলের অনুপযোগী হয়ে পড়ে। এ কারণে ক্ষতিগ্রস্ত সড়কগুলোর রক্ষণাবেক্ষণ ও পুনর্বাসন প্রয়োজন হয়। এ ছাড়াও অতিরিক্ত ওজন বহনকারী যানবাহনগুলো সড়ক দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ।
তাই যান চলাচল নিরাপদ এবং সড়কগুলো মজবুত ও টেকসই রাখার উদ্দেশে ওয়েবনির্ভর মনিটরিং সিস্টেম এবং আধুনিক প্রযুক্তি সংবলিত এক্সেল লোড নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র স্থাপন জরুরী মনে করে অধিদফতর। এ পরিপ্রেক্ষিতে মহাসড়কের ২১টি স্থানে পণ্য পরিবহনের উৎসমুখে পণ্যবাহী গাড়ির ওজন নিয়ন্ত্রক যন্ত্র স্থাপনের লক্ষ্যে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগ থেকে প্রকল্প প্রস্তাব পাঠানো হয়। যা পরবর্তীতে একনেক সভায় অনুমোদন পায়। প্রকল্পের মেয়াদ ধরা হয়েছে চলতি বছরের জুলাই থেকে ২০২২ সালের জুন পর্যন্ত।
যে সকল স্থানে বসবে নিয়ন্ত্রক যন্ত্র : সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগ ও পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, গাজীপুর সদর, কেরানীগঞ্জ, হালুয়াঘাট, নালিতাবাড়ী, বুড়িচং, ফেনী সদর, সাতকানীয়া, চট্টগ্রাম সদর, সীতাকুন্ড, নবীগঞ্জ, বিয়ানীবাজার, রামপাল, সাতক্ষীরা সদর, দামুড়হদা, শিবগঞ্জ, হাকিমপুর, রৌমারী, তেঁতুলিয়া, সৈয়দপুর, শিবচর, কালিহাতী উপজেলাকে প্রকল্প এলাকা হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে। প্রকল্প নেয়ার যৌক্তিকতায় বলা হয়েছে, মহাসড়কে প্রস্তাবিত ২১টি স্থানে পণ্য পরিবহনের উৎসমুখে এক্সেল লোড নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র স্থাপনের মাধ্যমে অনুমোদিত সীমার অতিরিক্ত পণ্য পরিবহন রোধ করা যাবে। এতে নির্ধারিত আয়ুষ্কালের আগেই সড়কগুলোর ক্ষতি রোধ করা সম্ভব হবে বলে প্রকল্প এলাকাগুলো নির্বাচন করা হয়েছে।
প্রকল্পের বিষয়ে মতামত দিতে গিয়ে পরিকল্পনা কমিশনের (ভৌত অবকাঠামো বিভাগ) সদস্য শামীমা নার্গিস বলেন, গুরুত্বপূর্ণ মহাসড়কে পণ্য পরিবহনের উৎসমুখে স্থাপন করা হবে এসব এক্সেল লোড নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র। প্রস্তাবিত প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে অনুমোদিত সীমার অতিরিক্ত পণ্য পরিবহন রোধের মাধ্যমে সড়কের ক্ষতি রোধ করে টেকসই সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে তোলা সম্ভব হবে। এদিকে, মন্ত্রণালয়ের সড়ক ও মহাসড়ক বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, সড়ক-মহাসড়কে অতিরিক্ত পণ্যবোঝাই যানবাহন নিয়ন্ত্রণে ২০০৪ সালে প্রথম গেজেট প্রকাশ করা হয়। তবে পরিবহন মালিক-শ্রমিকদের অসহযোগিতার কারণে সেটি বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি। পরবর্তীতে মোটরযান এক্সেল লোড নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র পরিচালনা সংক্রান্ত নীতিমালা-২০১২ প্রণয়ন করা হয়। ২০১৬ সালের ১৬ আগস্ট থেকে নীতিমালা অনুযায়ী অতিরিক্ত পণ্যবোঝাই যানবাহনের বিরুদ্ধে জরিমানা আদায় শুরু হয়। ব্যবসায়ীরা বার বার বিষয়টি নিয়ে আপত্তিও জানিয়েছেন। ব্যবসায়ীদের মতে এতে পণ্য পরিবহরে ব্যয় বাড়ছে। চট্টগ্রাম-ঢাকা মহাসড়কে বিদ্যমান গাড়ির ওজন মাপার স্কেলটি নিয়ে গত বছরও পরিবহর শ্রমিকদের সঙ্গে স্কেল নিয়ন্ত্রক সংস্থার কর্মচারীদের সঙ্গে একাধিকবার সংঘর্ষও হয়েছে। যদিও এরপরও বিভিন্ন বৈঠকে সরকার নানামুখী আলোচনাও করেছেন। সড়ক ও জনপথ বিভাগের একজন অতিরিক্ত চীফ ইঞ্জিনিয়ার বলেন, নানা কারণে এটি বাস্তবায়ন হয়নি সেসময়। তবে সরকার চায় এটির সঠিক বাস্তবায়ন। আর সেটির কারণেই প্রকল্পের মাধ্যমে আরও পরিধি বাড়াচ্ছে। মানুষের মধ্যেও সচেতনতা আসছে বলেও জানান ওই কর্মকর্তা। চট্টগ্রাম জোনের অতিরিক্ত চীফ ইঞ্জিনিয়ার মোঃ কামরুল আহসান বলেন, এটা ঠিক একসময় আমাদের কর্মকর্তা আর পরিবহন শ্রমিকদের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে সংঘর্ষ হয়েছে। তবে এখন আর সেটি নেই। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে ওভারলোড নিয়ন্ত্রণ যন্ত্র এখনো সচল আছে। সরকার আরও বাড়ানোর পরিকল্পনা নিয়েছে জেনেছি।