ইসলামী রাষ্ট্র কর্তৃক ভূমি বণ্টন নীতি

78

॥ মুহাম্মদ মনজুর হোসেন খান ॥

(পূর্ব প্রকাশের পর)
মহানবী (স.) বলেছেন: ‘যে ব্যক্তি কারো এক বিঘত পরিমাণ জমি জোর করে দখল করবে কিয়ামতের দিন মহান আল্লাহ তার গলায় সাত স্তর জমি বেড়ি রূপে পরিয়ে দিবেন।’ ইসলাম ব্যক্তি মালিকানা স্বীকার করে নিলেও তা শর্তহীন নয়। বরং ইসলামে ব্যক্তি মালিকানা কয়েকটি শর্তসাপেক্ষে স্বীকৃত। সম্পদের কল্যাণকর ও সর্বজনীন ব্যবহার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে এ শর্তগুলো আরোপ করা হয়েছে। শর্তগুলো হলো :
ভূমির নিরবচ্ছিন্ন ব্যবহার : ভূমির নিরবচ্ছিন্ন ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। অন্যথায় মালিকানা রহিত বলে গণ্য হবে। উদাহরণ স্বরূপ বলা যেতে পারে, হযরত বেলাল ইবনুল হারিস (রা.)কে মহানবী (স.) প্রচুর জমি আবাদ করার জন্য দিয়েছিলেন। হযরত উমর (রা.) খলীফা নিযুক্ত হওয়ার পর তাঁকে ডেকে বললেন, ‘মহানবী (স.) আপনাকে অনেক জমি দিয়েছেন। আর আপনি পুরো জমি চাষাবাদ করতে পারছেন না। অতঃপর বললেন, আপনি বিবেচনা করে দেখুন; যে পরিমাণ জমি আপনি নিজে চাষাবাদ করতে সক্ষম হবেন, সে পরিমাণই আপনি নিজের দখলে রাখুন। আর যা সামলাতে পারবেন না কিংবা যে পরিমাণ জমির ব্যবস্থাপনা করা আপনার পক্ষে সাধ্যাতীত, তা আমাদের (রাষ্ট্রের) নিকট ফেরত দিন, আমরা তা অন্যান্য মুসলমানদের মধ্যে বণ্টন করে দেব। হযরত বেলাল (রা.) তাঁর জমি ফেরত দিতে রাজি না হওয়া সত্ত্বেও তাঁর সাধ্যাতীত পরিমাণ জমি হযরত উমর (রা.) ফেরত নিলেন এবং মুসলমানদের মধ্যে পুনর্বণ্টন করলেন।’
ভূমির কল্যাণকর ব্যবহার : ভূমি হতে উৎপন্ন ফসলের কিছু অংশ মহান আল্লাহর রাস্তায় অর্থাৎ কল্যাণকর কাজে ব্যয় করতে হবে। ইসলামী অর্থনীতিতে ভূমি তথা সম্পদের ব্যবহার নীতি কুরআনের নিম্নোক্ত আয়াতে পরিষ্কারভাবে বর্ণিত হয়েছে। মহান আল্লাহ বলেন : ‘যারা নিজেদের ধন-সম্পদ আল্লাহর পথে ব্যয় করে তাদের উপমা একটি শস্যবীজ, যা সাতটি শীষ উৎপাদন করে, প্রত্যেক শীষে থাকে একশত শস্যদানা। আল্লাহ যাকে ইচ্ছে বহুগুণে বৃদ্ধি করে দেন। আল্লাহ প্রাচুর্যময়, সর্বজ্ঞ। যারা আল্লাহর পথে ধন-সম্পদ ব্যয় করে অতপর যা ব্যয় করে তার কথা বলে বেড়ায় না এবং ক্লেশও দেয় না, তাদের পুরষ্কার তাদের প্রতিপালকের নিকট। তাদের কোন ভয় নেই এবং তারা দুঃখিতও হবে না।’ অপর এক আয়াতে বলা হয়েছে : ‘তোমরা যদি প্রকাশ্যে দান কর তবে তা ভাল, আর যদি গোপনে কর এবং অভাবগ্রস্তকে দাও তা তোমাদের জন্য আরও ভালো।’
যাকাত প্রদান : সমাজের যে ক’জন লোক তাদের উচ্চতর যোগ্যতা ও সৌভাগ্যের কারণে নিজেদের প্রয়োজনের অতিরিক্ত ধন-সম্পদ আহরণ করেছে ইসলাম চায় তারা যেন এ সম্পদ পুঞ্জিভূত করে না রাখে বরং এগুলো ব্যয় করে এবং এমন সব ক্ষেত্রে ব্যয় করে যেখান থেকে সম্পদের আবর্তনের ফলে সমাজের স্বল্পবিত্ত ভোগীরাও যথেষ্ট অংশ লাভ করতে সক্ষম হয়। এ লক্ষ্যেই ইসলাম যাকাত ব্যবস্থার প্রবর্তন করেছে। ইসলামের নির্দেশ অনুযায়ী নিসাব পরিমাণ যাকাত প্রদান করতে হবে। যাকাতের বিধানাবলী পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, কৃষিজ পণ্যই এর অত্যাবশ্যকীয় বিষয়। ভূমি একটি রাষ্ট্রের অপরিহার্য উপাদান। ভূমি মানুষের রিযক ও জীবন ধারণের মূল উৎস এবং স্থিতি স্থাপনের ক্ষেত্র। এটা যাকাত আইনেরও মূল ভিত্তি। ইসলামের ভূমি ব্যবস্থা ইনসাফপূর্ণ। ভূমি ব্যবস্থারই অন্যতম দিক হল উশর ও খারাজ। কোন কোন অবস্থায় উৎপাদিত ফসলের এক-দশমাংশ রাষ্ট্রীয় কোষাগারে দেয়া ফরজ হয়, আবার কোন কোন ক্ষেত্রে শতকরা বিশ ভাগ দিতে হয়। ইসলামী সরকার কর্তৃক ফসল ও ভূমির উপর আরোপিত করকে উশর ও খারাজ বলা হয়। উশর মুসলমানদের জমির সাথে সংশ্লিষ্ট ও নির্দিষ্ট। অমুসলিমদের জমিতে উশর নেই, আছে খারাজ। উশর মুসলমানদের ওপর কুরআন, হাদীস, ইজমা ও কিয়াস দ্বারা প্রামাণ্য ফরয।
ভূমির অকল্যাণকর ব্যবহার রোধ : ইসলাম ভূমি তথা সম্পদের কল্যাণমূলক ব্যবহারকে উৎসাহিত এবং অকল্যাণকর ব্যবহারকে নিরুৎসাহিত করেছে। যেহেতু ভূমির প্রকৃত এবং অবিমিশ্র মালিক মহান আল্লাহ, কাজেই এর ব্যবহার করার অধিকার প্রত্যেক মানুষেরই রয়েছে, তবে উক্ত ব্যবহারের ফলে সমাজের অপরাপর ব্যক্তি ও জনগোষ্ঠীর যাতে কোন ক্ষতি না হয় সেদিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে। কেননা অপরের ক্ষতি হলে তা আগ্রাসন হিসাবে বিবেচিত হবে এবং আগ্রাসন সব সময়েই নিষিদ্ধ। কুরআনুল করীমে বলা হয়েছে : ‘হে মু’মিনগণ! তোমরা যা উপার্জন কর এবং আমি যা ভূমি হতে তোমাদের জন্য উৎপাদন করে দেই তন্মধ্যে যা উৎকৃষ্ট তা ব্যয় কর এবং এর নিকৃষ্ট বস্তু ব্যয় করার সংকল্পও করো না।’ হযরত আবু হুরায়রা (রা.) হতে বর্ণিত আছে যে, মহানবী (স.) বলেছেন : ‘প্রয়োজনের অতিরিক্ত পানি আটকিয়ে রাখা উচিত নয়, তাতে তৃণভূমির উন্নয়ন ব্যাহত হবে।’ এই হাদীসের তাৎপর্য হচ্ছে মুসলমানদের অবশ্যই নিজের প্রয়োজন সম্পর্কে সতর্ক থাকতে হবে এবং সমাজের অপরাপর ব্যক্তির যাতে ক্ষতি না হয় সে ব্যাপারে সজাগ থাকতে হবে।
বহু মুসলিম দেশেই লক্ষ করা যাচ্ছে, ভূমির ব্যক্তিগত মালিকানার সুযোগে কিছু সংখ্যক ব্যক্তির হাতে দেশের মোট ভূমির বিপুল অংশ কুক্ষিগত হচ্ছে। ইসলামী আইনে এ জাতীয় অবস্থা মোটেই সমর্থিত নয়। কারণ ইসলামী বিধানে ভূমি কিছু সংখ্যক ব্যক্তির সুবিধার জন্য নয়, বরং সাধারণ জনসাধারণের কল্যাণের জন্য ব্যবহার করতে হবে। বিশিষ্ট ইসলামী আইন বিশেষজ্ঞ ইবনুল কাইয়িম এ সম্পর্কে বলেন : ‘আল্লাহ তাঁর সৃষ্ট মানুষের জন্য যে বিধান দিয়েছেন তা বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে, এসব বিধান মানুষর মধ্যে সুযোগ-সুবিধার সমতা বিধানের জন্য তৈরি। যখনই বিভিন্ন মানুষের কাঙ্খিত সুবিধার মধ্যে দ্বন্দ্ব দেখা দেয় তখনই অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ ও প্রয়োজনীয় বিষয়ের উপর প্রাধান্য দেয়া হয়। ইসলামী বিধান মানুষের উপকার করার জন্য পরিকল্পিত, কিন্তু যখন কোন স্বার্থহানী অনিবার্য হয়ে পড়ে তখন অপেক্ষাকৃত কম অনিষ্ট সাধনের প্রতি প্রয়াস লক্ষ করা যায়। মহান আল্লাহর দেয়া বিধানের এই হচ্ছে মৌলিক নীতি যা আল্লাহর বিজ্ঞতা ও উদারতার পরিচায়ক।’
আইনানুগ দখলস্বত্ব : ভূমি দখল আইন সংগত হতে হবে। মহানবী (স.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি কারও এক বিঘত জমি জোর করে দখল করবে কিয়ামতের দিন আল্লাহ তার গলায় সাত তবক জমীন বেড়ি রূপে পরিয়ে দিবেন।’ মিথ্যা দলিল ও ভুয়া সাক্ষী প্রমাণের মাধ্যমে কোর্টের রায় নিজের অনুকূলে নেয়ার প্রচেষ্টা তথা দুর্নীতির মাধ্যমে সম্পত্তি ভোগ দখল করা ইসলামী ব্যবস্থায় সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ।
সুষম ব্যবহার : ব্যক্তি মালিকানা সম্পর্কে শরীয়তের স্পষ্ট নীতি হচ্ছে মালিককে তার ভূমি তথা সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহার করতে হবে। ব্যক্তি মালিকানা অবশ্যই কুরআনুল করীম ও সুন্নাহ প্রবর্তিত নীতি থেকে যাতে বিচ্যুত না হয় সেজন্য সমাজ তথা রাষ্ট্রকে সদা সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে। সম্পদের মালিককে কৃপণ কিংবা অপচয়কারী হওয়া যাবে না। কেননা মহান আল্লাহ উদ্ধত, দাম্ভিক, কৃপণ ও অপচয়কারী ব্যক্তিকে পছন্দ করেন না। অন্যায়ভাবে অপরিমিত সম্পদের মালিক হওয়া ইসলামে গ্রহণযোগ্য নয়। অমিতব্যয়িতাকে পরিহার করে মহান আল্লাহ প্রদত্ত সম্পদ তাঁর রাস্তায় ও মানবতার সেবায় ব্যয় করার জন্য ইসলাম কঠোর তাগিদ দিয়েছে। প্রকৃতপক্ষে ইসলাম কৃপণতা ও অপচয় এ দুয়ের মধ্যবর্তী অবস্থা সমর্থন করে।
ভূমি দ্বারা যথার্থ উপকার লাভ : ব্যক্তি মালিকানা সম্পর্কে ইসলামের অন্যতম নীতি হচ্ছে ভূমি তথা সম্পদ মালিকের যথার্থ উপকারে আসতে হবে। লক্ষ্যণীয় যে, বহু ক্ষেত্রে মানুষ তার সম্পদ জাতীয় কল্যাণে নিয়োজিত না করে ব্যক্তির স্বেচ্ছাচারিতার ইন্ধন হিসাবে ব্যবহার করে। এটা অবশ্যই ইসলামের মৌলিক নীতির বিরোধী। এ বিধানে অবশ্যই নিশ্চিত হতে হবে যে, ভূমি কখনো ব্যক্তিস্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য ব্যবহার করা যাবে না। ইসলামী আইন সকল আর্থিক চাপ ও প্রভাব থেকে মুক্ত থেকে অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক স্বাধীনতা নিশ্চিত করার প্রয়াসী। ব্যক্তি মালিকানা সম্পর্কে শর্ত হচ্ছে, ভূমি তথা সম্পদ জীবিত ব্যক্তির স্বার্থে ব্যয়িত হতে হবে। মৃত্যুর পর মৃত ব্যক্তির কোন ভূমি বা সম্পত্তি নিয়ন্ত্রণ বা ভোগ করার প্রশ্নই আসে না। কাজেই ইসলামী বিধান মোতাবেক মৃত্যুর পর মৃত ব্যক্তির স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি তার উত্তরাধিকারদের মধ্যে বণ্টন করে দিতে হবে।
হালাল হারাম বিবেচনা : ভূমি তথা সম্পদ ব্যবহারে হালাল হারামের বিবেচনা করতে হবে। অবৈধভাবে কোন ভূমি কিংবা সম্পদ দখল বা ভোগ করা সম্পূর্ণ হারাম। আল্লাহ বলেন : ‘হে মানব জাতি! পৃথিবীতে যা কিছু বৈধ ও পবিত্র খাদ্য বস্তু রয়েছে তা থেকে তোমরা আহার কর এবং শয়তানের পদাংক অনুসরণ করো না, নিশ্চয় সে তোমাদের প্রকাশ্য শক্র।’
উপরোক্ত আলোচনা দ্বারা একথা স্পষ্টতই উপলব্ধি করা যাচ্ছে যে, ইসলামে ভূমি মালিকানা তথা ব্যক্তি মালিকানা নৈতিক ও ধর্মীয় অনুশাসন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। কোন ব্যক্তি তার মালিকানাধীন ভূমি বা সম্পদ ইসলামের মৌলিক নীতি বিরোধী কাজে ব্যবহার করলে ইসলামী রাষ্ট্র তার মালিকানা রহিত করার অধিকার রাখে।
মালিকানার অধিকার বিশ্লেষণ : মহান আল্লাহর মালিকানার অধীনে ব্যক্তি মালিকানার অধিকারকে স্বীকার করে নেয়ার জন্য চারটি বিষয়ের প্রতি লক্ষ রাখতে হবে। যথা : ১. অপব্যবহার রোধ ২. অন্যায় ব্যবহার রোধ ৩. যথার্থ ব্যবহার ৪. স্থায়ী ব্যবহার। এই চার ধরনের অধিকার কেবলমাত্র একটি শর্ত দ্বারা সীমাবদ্ধ। শর্তটি হচ্ছে, এই সকল অধিকার সমাজের অন্যান্য মানুষের একইরূপ অধিকারের ক্ষেত্রে কোন প্রকার বাধার সৃষ্টি করতে পারবে না।
অপব্যবহার রোধ : বিশ্ব জগতের প্রতিটি বস্তুই কোন না কোন উদ্দেশ্যে এবং কোন না কোন নির্দিষ্ট কাজের জন্য সৃষ্টি করা হয়েছে। কাজেই কোন কিছু ধ্বংস বা অপব্যবহার করার অধিকার কারো নেই। ইসলামে অপচয়কে শুধু নিষেধ করা হয়নি, বরং তা নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়েছে। ৪০ কুরআনে বলা হয়েছে : ‘কিছুতেই অপব্যয় করো না, যারা অপব্যয় করে তারা শয়তানের ভাই। (অসমাপ্ত)