২৫ বছর আগে শেখ হাসিনার ট্রেন বহনে হামলার মামলা ॥ ৯ জনের ফাঁসি, ২৫ জনের যাবজ্জীবন, ১৩ জনের ১০ বছর কারাদন্ড

25

কাজিরবাজার ডেস্ক :
মামলা যে কখনও তামাদি হয় না, তা আবারও প্রমাণ হলো। ২১ আগস্ট ভয়াল গ্রেনেড হামলার মতোই ১৯৯৪ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর বঙ্গবন্ধুর কন্যা ও তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেত্রী শেখ হাসিনাকে প্রকাশ্য দিবালোকে প্রাণনাশের চেষ্টা করেছিল তৎকালীন ক্ষমতাসীন বিএনপি সন্ত্রাসীরা। মুত্যুজাল ছিন্ন করে ওই হামলায়ও অল্পের জন্য প্রাণে বেঁচে গিয়েছিলেন বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার মতো পাবনার ঈশ্বরদীতে ট্রেন বহরে হামলার ঘটনা ভিন্নখাতে প্রবাহিত করার চেষ্টা করেছিল তৎকালীন ক্ষমতাসীন বিএনপি সরকার। কিন্তু অপরাধীরা পার পায়নি। ২৫ বছর পর হলেও ১৯৯৪ সালের সবচেয়ে বহুল আলোচিত চাঞ্চল্যকর এই হামলা মামলার রায় ঘোষণা হয়েছে।
পাবনার ঈশ্বরদীতে ২৫ বছর আগে আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনাকে বহনকারী ট্রেনে বোমা হামলা ও গুলির ঘটনায় বিএনপির ৯ নেতাকর্মীকে মৃত্যুদন্ড দিয়েছে আদালত। এ মামলার ৫২ আসামির মধ্যে ২৫ জনের যাবজ্জীবন কারাদন্ড এবং ১৩ জনকে ১০ বছর করে কারাদন্ড দেয়া হয়েছে। বাকি পাঁচ আসামি বিচার চলার মধ্যেই বিভিন্ন সময়ে মারা গেছেন। পলাতক রয়েছে ১৪ আসামি। পাবনার অতিরিক্ত দায়রা জজ আদালতে বিচারক রোস্তম আলী বুধবার জনাকীর্ণ আদালতে চাঞ্চল্যকর এই মামলার রায় ঘোষণা করেন।
দেশের বহুল এ হামলার রায় নিয়ে বুধবার সকাল থেকেই পাবনা শহরে ছিল টানটান উত্তেজনা। জনাকীর্ণ আদালতে বিএনপির নেতাকর্মীরা রায়ের বিরুদ্ধে স্লোগান দিতে শুরু করলে দু’পক্ষের মধ্যে উত্তেজনার সৃষ্টি হয়। এরপর ছাত্রলীগ ও যুবলীগের কর্মীরা মিছিল নিয়ে তাদের ধাওয়া করে আদালত চত্বর থেকে হটিয়ে দেয়। এ সময় ধাওয়া, পাল্টাধাওয়ার ঘটনা ঘটে। আদালতে উপস্থিত লোকজন এ সময় আতঙ্কে ছোটাছুটি শুরু করে। পরে পুলিশ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। পুরো শহর ও ঈশ্বরদীতে পুলিশী টহল বৃদ্ধি করা হয়েছে। এদিকে দীর্ঘ ২৫ বছর পর শেখ হাসিনার হত্যা চেষ্টা মামলার রায় ঘোষণার পর আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগ, কৃষক লীগসহ সরকার সমর্থকরা শহরে আনন্দ মিছিল বের করে এবং আওয়ামী লীগ কার্যালয়ে মিষ্টি বিতরণ করে।
আদালতের রায়ে সর্বোচ্চ সাজা মৃত্যুদন্ড পাওয়া নয় আসামি হলেন- বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ও ঈশ্বরদী পৌরসভার সাবেক মেয়র মোকলেছুর রহমান, পাবনা জেলা বিএনপির মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক সম্পাদক একেএম আকতারুজ্জামান আকতার, ঈশ্বরদী পৌর বিএনপির সাধারণ সম্পাদক জাকারিয়া পিন্টু, ঈশ্বরদী পৌর যুবদলের সভাপতি মোস্তফা নূরে আলম শ্যামল, স্থানীয় বিএনপি নেতা মাহবুবুল রহমান পলাশ, রেজাউল করিম ওরফে শাহীন, শামছুল আলম, আজিজুর রহমান ভিপি শাহীন ও শহীদুল ইসলাম অটল। মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত নয়জনের মধ্যে জাকারিয়া পিন্টু পলাতক; বাকিরা রায়ের সময় আদালতে উপস্থিত ছিলেন।
যাবজ্জীবনপ্রাপ্তরা হলেন- ইসলাম হোসেন জুয়েল, আলাউদ্দিন বিশ্বাস, আল আমিন, শিমু, আনিস শেখ, খোকন, নুরুল ইসলাম, আক্কেল আলী, সেলিম আহমেদ, মামুনুর রহমান, রবি, মামুন, তুহিন, এনাম, কল্লোল, কালা বাবু, লিটন, আবদুল্লাহ আল মামুন রিপন, লাইজু, আবদুল জব্বার, আবুল কালাম, আবদুল হাকিম টেনু, আলমগীর হোসেন, পায়েল ও পলাশ। বিচারক এদের প্রত্যেককে ৩ লাখ টাকা করে জরিমানা, অনাদায়ে আরও ২ বছর করে সশ্রম কারাদন্ড দিয়েছে।
এছাড়া আসামি তুহিন বিন ছিদ্দিক, দুলাল সরদার, ফজলুর রহমান, আবদুর বারিক, আনোয়ার হোসেন জনি, রুস্তম, মওলা, জামরুল, রাজু, বাবলু, বরকত, মুক্তা ও মুকুলকে দেয়া হয়েছে ১০ বছর করে সশ্রম কারাদন্ড। এদের আরও এক লাখ টাকা জরিমানা অনাদায়ে ১ বছরের সশ্রম কারাদন্ডাদেশ দিয়েছে আদালত। এ মামলায় এ পর্যন্ত ৩৩ আসামি কারাগারে রয়েছে। এছাড়া পলাতক ১৪ জন।
রাষ্ট্রপক্ষে এ মামলায় শুনানি করেন পিপি আক্তারুজ্জামান মুক্তা। আসামিদের পক্ষে ছিলেন আইনজীবী নুরুল ইসলাম গ্যাদা, মাসুদ খন্দকারসহ কয়েকজন। রায়ের পর তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় মাসুদ খন্দকার বলেন, এই রায় একটি প্রহসনের রায়। আমরা উচ্চ আদালতে আপীল করব।
মামলার নথি ও প্রত্যক্ষদর্শীদের বিবরণে জানা যায়, ১৯৯৪ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর বিরোধী দলীয় নেত্রী ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দলীয় কর্মসূচীতে ট্রেনবহর নিয়ে রেলপথে খুলনা হতে ঈশ্বরদী হয়ে সৈয়দপুর যাচ্ছিলেন। সৈয়দপুর যাওয়ার পথে ঈশ্বরদী স্টেশনে তার যাত্রাবিরতি ও পথসভা করার কথা ছিল। ট্রেনটি ঈশ্বরদী পাকশী জংশন স্টেশনে থামলে আওয়ামী লীগ নেতা পাবনা পৌর মেয়র মরহুম শেখ শহীদুল্লাহ বাচ্চু, বর্তমান পাবনা-৫ আসনের এমপি গোলাম ফারুক প্রিন্স, সদর উপজেলা চেয়ারম্যান মোশাররফ হোসেনের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ নেতা কর্মীরা শেখ হাসিনার কামরায় অবস্থান নিয়ে মানবঢাল তৈরি করেন।
ঈশ্বরদী রেলওয়ে জংশন স্টেশনে ট্রেনটি প্রবেশের মুহূর্তে তৎকালীন ক্ষমতাসীন বিএনপি, ছাত্রদল ও যুবদলের সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা শেখ হাসিনার কামরা লক্ষ্য করে বৃষ্টির মতো গুলি ও বোমা হামলা চালায়। এতে বঙ্গবন্ধুর কন্যা শেখ হাসিনার ট্রেনের কামরার জানালা-দরজার কাঁচ ভেঙ্গে যায়। ২১ আগস্টের মতো এখানেও নেতাকর্মীরা মানবঢাল তৈরি করে শেখ হাসিনাকে নিরাপত্তা দিয়ে প্রাণ বাঁচান। সে সময় শেখ হাসিনার নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা পুলিশ গুলি চালিয়ে বিএনপি নেতাকর্মীদের হটিয়ে দেয় । এ পরিস্থিতিতে পুলিশ শেখ হাসিনাকে ঈশ^রদী স্টেশনে না নামতে অনুরোধ করলে তিনি তা না মেনে বলেন, ঈশ^রদী স্টেশনের জনসভায় যদি আমাকে মৃত্যুবরণ করতে হয় তাও করব, কিন্তু সন্ত্রাসীদের ভয়ে পালাব না। শেখ হাসিনা স্টেশনে নেমে মাইকে বক্তব্য রাখার সময় আবারও হামলা করা হয়। এ সময় কেন্দ্রীয় নেতাসহ বেশ কয়েকজন আহত হয়।
সাবেক ভূমিমন্ত্রী শামসুর রহমান শরীফ ডিলুর বাড়ির সামনে থেকে সাবেক এমপি ওয়াজি উদ্দীন খান, বর্তমান জেলা পরিষদ চেয়্যারমান রেজাউল রহিম লাল ও আওয়ামী লীগ নেতা এম সাইদুল হক চুন্নুর নেতৃত্বে নেতাকর্মীরা স্টেশনের পথসভার দিকে এগিয়ে গেলে বিএনপি নেতা জাকারিয়া পিন্টুর নেতৃত্বে সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা মিছিলের ওপর আবারও হামলা করে। এ হামলায় অর্ধশতাধিক নেতাকর্মী আহত হয়। এর মধ্যে পাবনা কমার্শিয়াল কলেজের ভিপি শেখ রাসেল আলী মাসুদ গুরুতর আহত হয়। এ সময় দলীয় কর্মসূচী সংক্ষিপ্ত করে শেখ হাসিনা ঈশ্বরদী ত্যাগ করেন।
এ ঘটনার পর ঈশ্বরদী রেলওয়ে জিআরপি থানার তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) নজরুল ইসলাম বাদী হয়ে বর্তমানে ঈশ্বরদী পৌর বিএনপির সাধারণ সম্পাদক জাকারিয়া পিন্টুসহ সাতজনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাত আরও ১০০ জনকে আসামি করে মামলা করেন। ক্ষমতার দাপটের কারণে ওই সময় কোন সাক্ষী না পাওয়ার কথা জানিয়ে একই বছর আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদনও দেয় পুলিশ। কিন্তু আদালত প্রতিবেদন গ্রহণ না করে পুনরায় তদন্তের জন্য সিআইডিকে নির্দেশ দেয়।
১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করার পর সিআইডি মামলাটি পুনঃতদন্ত করে ১৯৯৭ সালের ৩ এপ্রিল চার্জশীট জমা দেয়। এতে বিএনপি নেতা মোখলেছুর রহমান বাবলু, জাকারিয়া পিন্টুসহ দলের অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনর ৫২ নেতাকর্মীকে আসামি করা হয়। গত ২৫ বছরে এই মামলায় চার্জশীটভুক্ত আসামিদের মধ্যে ওসিয়া, আলী আজগর, খোকন, তুহিন ও আলমগীর নামের পাঁচ আসামি মৃত্যুবরণ করেছেন। পুলিশ এ মামলায় মোট ৩০ জনকে গ্রেফতার করলেও তাদের সবাইকে জামিন দিয়েছিল আদালত।
গত ৩০ জুন মামলার সাক্ষ্য ও জেরা শেষ হলে বিচারক আসামিদের জামিন বাতিল করে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন। তাদের মধ্যে ঈশ্বরদী পৌরসভার সাবেক মেয়র মোখলেছুর রহমান বাবলু এবং বিএনপি নেতা আবদুল হাকিম টেনু মঙ্গলবার আদালতে আত্মসমর্পণ করেন। সেদিন রাতে আরেক আসামিকে গ্রেফতার করে পুলিশ। মামলায় ৩৮ সাক্ষী এবং ৫৬ সাফাই সাক্ষী শেষ হওয়ার পর বুধবার জনাকীর্ণ আদালতে শেখ হাসিনার প্রাণনাশের মামলাগুলোর অন্যতম চাঞ্চল্যকর মামলাটির রায় হলো। দীর্ঘ বিচার প্রক্রিয়া শেষ আদালত আসামিদের সবাইকে দোষী সাব্যস্ত করে রায় ঘোষণা করে। সাজা ঘোষণা হলে আদালতে উপস্থিত আসামির স্বজনদের কান্নায় ভেঙ্গে পড়তে দেখা যায়।