অগ্নিঝরা মহান স্বাধীনতা দিবস

94

মো: শামসুল ইসলাম সাদিক

বা ংলাদেশের ইতিহাসের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত মহান স্বাধীনতা দিবস। এই মাসে রক্তের স্রোতে এসেছিল বাঙালির জাতির বহুকাক্সিক্ষত মহান স্বাধীনতা। ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিজয়ের পর পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর ক্ষমতা হস্তান্তরে গড়িমসির প্রেক্ষাপটে ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ ঢাকার রমনা রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) জাতির উদ্দেশ্যে প্রদত্ত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এর ঐতিহাসিক যে ভাষণ দেন যার ঐতিহাসিকতা অন্য সকল ভাষণকে ছাড়িয়ে গেছে। ঐতিহাসিক ভাষণের সময় মুহূর্তে গর্জনে উত্তাল ছিল জনসমুদ্রে, লাখো লাখো কন্ঠে একই আওয়াজ উচ্চারিত হতে থাকে। এক দফা এক দাবি, ঢাকাসহ গোটা দেশে পত পত করে উড়ছিল সবুজ জমিনের ওপর লাল সূর্যের পতাকা। ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি মায়ের ভাষার জন্য যে আগুন জ্বলে উঠেছিল সে আগুন যেন ছড়িয়ে পড়ে বাংলার সর্বত্র। এরপর যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, ৬২-এর শিক্ষা আন্দোলন, ৬৬-এর ছয়দফা এবং ঊনসত্তরের গণ অভ্যুত্থানের সিঁড়ি বেয়ে একাত্তরের অগ্নিঝরা মহান স্বাধীনতা দিবসে বাঙালির জীবনে নিয়ে আসে নতুন বার্তা। স্বাধীনতা সংগ্রামের অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ২৬ মার্চ ঘোষণা করেন বাংলাদেশের স্বাধীনতা। স্বাধীনতা ঘোষণা করার পরপরই স্বাধীনতা সংগ্রামের অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে পাকিস্তান বাহিনী তাকে গ্রেফতার করে পশ্চিম পাকিস্তান নিয়ে যায়। ২৫ মার্চের কালরাতে পাকিস্তান বাহিনীরা স্বাধীনতা ও মুক্তিকামী বাঙালির কন্ঠ চিরতরে স্তব্ধ করে দেয়ার লক্ষ্যে অপারেশন সার্চ লাইট নামে বীর বাঙালি নিধনে নামে। ঢাকার রাস্তায় বেরিয়ে সেনারা নির্বিচারে হাজার হাজার বাঙালিকে হত্যা করে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে হামলা চালিয়ে ছাত্র-শিক্ষককে নির্বিচারে হত্যা করে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আহ্বানে ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলা হয়। এতে বাঙালিরা স্বত:স্ফূর্ত ভাবে আবাল- বৃদ্ধ-বণিতা অংশ গ্রহণ করে চিনিয়ে আনে স্বাধীন প্রিয় বাঙালি।
হাজার বছরের ইতিহাসে বাঙালি তাদের আত্মপরিচয়ের সন্ধান লাভ করে মহান স্বাধীনতার মধ্যদিয়ে। অর্জন করে মহান স্বাধীনতার কয়েক শতাব্দীর ঔপনিবেশিক দু:শাসনের পথ পাথার পেরিয়ে ১৯৪৭ সালে ‘পাকিস্তান’ নামে বাঙালির ভাগ্যে যা জুটেছে, তা অন্যরুপে আরেক অপারেশন, নির্যাতন আর বঞ্চনা ছাড়া কিছুই নয়। বাঙালি জাতি ওই শোষণ-বঞ্চনার হাত থেকে মুক্তি পেতে নেমে আসে রাজপথে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সীমাহীন দেশপ্রেম, রাজনৈতিক প্রজ্ঞা, অসীম সাহস, দূরদর্শিতা আর দৃঢ় নেতৃত্বে ৩০ লাখ শহীদের রক্তস্নাত মুক্তিযুদ্ধের সূচনা হয়েছিল। হাজার বছরের শোষণ-বঞ্চনার পাপমুক্ত হওয়ার যাত্রা শুরু হয়েছিল এই মাসেই। এই মহান দিনে আমরা মুক্তিযুদ্ধের সব শহীদকে গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করছি। স্বাধীনতাসংগ্রামের অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, প্রবাসী সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদসহ সব নেতার স্মৃতির প্রতি আন্তরিক শ্রদ্ধা ও সম্মান নিবেদন করছি। আন্তরিক সংহতি ও সহমর্মিতা জানাচ্ছি মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের পরিবার-পরিজন এবং বর্বর নৃশংসতার শিকার নারীদের প্রতি। ৪৯ বছর আগে ১৯৭১ সালের আজকের এ মাসটিতে আনুষ্ঠানিক সূচনা ঘটেছিল বাঙালির সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের। পাকিস্তানি শোষকদের কবল থেকে মাতৃভূমি বাংলাকে স্বাধীন করতে রণাঙ্গনে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন বাংলা মায়ের দামাল ছেলেরা। ৯ মাস বহু ত্যাগ-তিতিক্ষা আর রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর ১৬ ডিসেম্বর অর্জিত হয় বিজয় ও সার্বভৌমত্ব। জাতি অর্জন করে একটি নিদিষ্ট দেশ, জাতীয় পতাকা ও জাতীয় সঙ্গীত এবং স্বাধীনতা।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ গভীর রাতে নৃশংস গণহত্যার শিকার পূর্ব বাংলার জনগণ যে সশস্ত্র প্রতিরোধ গড়ে তোলে এবং পরবর্তী নয় মাস ধরে প্রাণপণে যে যুদ্ধ চালিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের বিজয় সম্পন্ন করে, তা ছিল প্রকৃত অর্থে সর্বাত্মক জনযুদ্ধ। কেননা, সেই যুদ্ধে পুরো জাতি ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল এবং প্রত্যেকে নিজ নিজ অবস্থান ও সাধ্য অনুযায়ী অবদান রেখেছেন। অনেকে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সম্মুখযুদ্ধে লড়াই করেছেন, তাঁদের কেউ কেউ শহীদ হয়েছেন। ফলে তাঁদের পরিবার-পরিজন দীর্ঘ দুঃখ-বেদনার মুখোমুখি হয়েছে, অনেক পরিবার বৈষয়িকভাবেও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আবার অস্ত্র হাতে লড়াই করেননি কিন্তু মুক্তিযোদ্ধাদের সাধ্যমতো জীবন বাজি রেখে সহযোগিতা করেছেন, বাংলার মাটিকে দখলদার পাকিস্তানি বাহিনীর জন্য বিপজ্জনক ও বৈরী করে তুলেছিলেন, এমন মানুষের সংখ্যাও প্রচুর। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী মানুষের পাশে ছিল সমগ্র জাতি। সে কারণেই আমরা বলি, পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে মুক্ত হয়ে স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্নে জাতীয় ঐক্য, প্রত্যয় ও অঙ্গীকারের এক অভূতপূর্ব সময় আমাদের জীবনে; সেটা স্বাধীনতার ১৯৭১ সাল।
সেই জনযুদ্ধের পর ৪৯ বছর পেরিয়ে গেছে, আমরা আগামি বছর স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদ্যাপন করব। স্বাধীনতা দিবসে আমাদের ফিরে দেখা ও আত্মজিজ্ঞাসার মুখোমুখি হওয়ার সুযোগ আসে। যে স্বপ্ন ও চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে বাঙালি বীর জাতি মুক্তিযুদ্ধ করেছিলেন, তাদের কতটা পূরণ হয়েছে। এতে কোনো ভুল নেই, এই সময়ের মধ্যে বাংলাদেশ অনেক ক্ষেত্রে অনেক অগ্রগতি অর্জন করেছে। মুক্তিযুদ্ধের সময়ের তুলনায় দেশের জনসংখ্যা দ্বিগুণের বেশি বেড়ে যাওয়ার পরও মৌলিক খাদ্যচাহিদা পূরণ হয়েছে, শিক্ষার ব্যাপক প্রসার ঘটেছে, বিশেষত প্রাথমিক শিক্ষায়। স্বাস্থ্য পরিস্থিতির উন্নতি ঘটেছে, শিশু ও মাতৃমৃত্যুর হার উল্লেখযোগ্যভাবে কমে এসেছে, অর্থনৈতিক কর্মকান্ডে- নারীর অংশগ্রহণ বেড়েছে, মানবসম্পদ উন্নয়নের অনেক সূচকে আমাদের উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি ঘটেছে। আর এই স্বাধীনতার মাসেই একটা সুসংবাদ হলো প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের যোগ্যতা অর্জন করেছে। অবশ্য এই উত্তরণের সঙ্গে সঙ্গে আমরা কিছু চ্যালেঞ্জেরও মুখোমুখি হব, যা দক্ষতার সঙ্গে মোকাবিলার প্রস্তুতি এখন থেকেই আমাদের নিতে হবে। মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনা ছিল গণতন্ত্র ও সামগ্রিক ন্যায়। আমাদের স্বপ্ন ছিল স্বাধীন বাংলাদেশে সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে সব ধরনের অন্যায়-অবিচার ও বৈষম্য থেকে মানুষের মুক্তি ঘটবে। বাংলাদেশ হবে গণতান্ত্রিক, সমৃদ্ধ ও সুখী একটি রাষ্ট্র, যা পরিচালিত হবে আইনের শাসনের ভিত্তিতে। রাজনৈতিক সংস্কৃতির ভিত্তি হবে গণতান্ত্রিক রীতিনীতি, মতপ্রকাশের পরিপূর্ণ স্বাধীনতা, বিরুদ্ধ মতের প্রতি সহনশীলতা, সব রাজনৈতিক কর্মকান্ডে হবে নিয়মতান্ত্রিক ও শান্তিপূর্ণ। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে এসব ক্ষেত্রে বাংলাদেশ অনেক পিছিয়ে রয়েছে। গণতন্ত্র ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা সংকুচিত হয়ে চলেছে, রাজনৈতিক সংস্কৃতি অগণতান্ত্রিক ও বৈরিতামূলক, সুশাসন দুর্বলতর, দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহার বেড়েই চলেছে।
পুরো জাতি আজ শোক ও গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে অবনতচিত্তে স্মরণ করবে স্বাধীনতার জন্য আত্মোৎসর্গকারী বীর শহীদদের। শ্রদ্ধা জানাবে মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী, স্বাধীনতার স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, তার অবর্তমানে যুদ্ধ পরিচালনাকারী তারই সহকর্মী চার জাতীয় নেতা এবং ৯ মাসে অসামান্য আত্মত্যাগকারী বাংলার বীর সেনানী মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি। পাশাপাশি দেশ আজ মেতে উঠবে স্বাধীনতা উৎসবের আমেজে।
৯ মাস চলা মুক্তিযুদ্ধে একদিকে রচিত হয় ইতিহাসের মহীয়ান অধ্যায়, মুক্তিকামী বাংলার মানুষের বীরত্বগাঁথা; আরেকদিকে ছিল হানাদার বাহিনীর নির্বিচার হত্যা, গণহত্যা, ধর্ষণ ও লুটতরাজের কলঙ্কিত অধ্যায়। একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বর ঢাকায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর আত্মসমর্পণের মাধ্যমে চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত হয়। ৩০ লাখ মানুষের রক্ত আর দুই লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে বিশ্ব মানচিত্রে ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ’ নামের স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্রের আত্মপ্রকাশ ঘটে।
লেখক : শিক্ষার্থী, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ, এম, সি বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ, সিলেট।