অগ্নিঝরা মার্চ

97

কাজিরবাজার ডেস্ক :
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশে সারাদেশে সরকারী ও আধাসরকারী অফিসের কর্মচারীরা দশম দিনের মতো কাজে যোগদানে বিরত থাকেন। বেসরকারী অফিস, ব্যাংক ও ব্যবসা কেন্দ্র খোলা থাকে। ঘরে ঘরে বাংলাদেশের মানচিত্র খচিত স্বাধীন বাংলার পতাকা ওড়ে। সরকারী ও বেসরকারী ভবন, ব্যবসা ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শীর্ষে কালো পতাকা ওড়ে। এমনকি রাজারবাগ পুলিশ লাইন, থানা ও হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতির বাসভবনেও কলো পতাকা উত্তোলিত হয়। সকালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নিজ বাসভবনে একদল বিদেশী সাংবাদিকের সঙ্গে সাক্ষাতকার বৈঠকে মিলিত হন। বঙ্গবন্ধু এ-সময় বলেন, সাতকোটি বাঙালি আজ নিজেদের অধিকার সম্পর্কে অত্যন্ত সচেতন। যে কোন মূল্যে তারা এই অধিকার আদায়ে দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ। তিনি বলেন, এ পর্যন্ত বাঙালীরা অনেক রক্ত দিয়েছে। এবার আমরা এই রক্ত দেয়ার পালা শেষ করতে চাই। বিকেলে ওয়ালী পন্থী ন্যাপের উদ্যোগে শোষণমুক্ত স্বাধীন বাংলার দাবিতে ঢাকা নিউমার্কেট এলাকায় পথসভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ সভাপতিত্ব করেন। ‘লেখক-শিল্পী মুক্তি সংগ্রাম পরিষদ’-এর ব্যানারে লেখক ও শিল্পীরা রাজধানীতে বিক্ষোভ মিছিল বের করেন। নিউইয়র্কে প্রবাসী বাঙালি ছাত্ররা জাতিসংঘ সদর দফতরের সামনে বিক্ষোভ প্রদর্শন করেন। ছাত্ররা নিরস্ত্র বাঙালিদের হত্যা বিষয়ে জাতিসংঘের হস্তক্ষেপ দাবি করে মহাসচিব উ-থান্টের কাছে স্মারকলিপি পেশ করেন। সকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্জেন্ট জহুরুল হক হল প্রাঙ্গণে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের উদ্যোগে এক কর্মীসভা অনুষ্ঠিত হয়। ওই কর্মীসভায় ছাত্রলীগ ও ডাকসু নেতৃবৃন্দের স্বাক্ষরিত স্বাধীন- বাংলাদেশ ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের এক বিবৃতিতে বাঙালি সৈন্য, ইপিআর ও পুলিশ বাহিনীর সদস্যদের প্রতি পাকিস্তানী উপনিবেশবাদী সরকারের সঙ্গে সহযোগিতা না করার আবেদন জানানো হয়। ঢাকায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এক বিবৃতিতে বলেন, বাংলাদেশের জনগণের নামে আমি যে নির্দেশ দিয়েছি সচিবালয়-সহ সরকারী ও আধাসরকারী অফিস আদালত, রেলওয়ে ও বন্দরগুলোতে তা পালিত হচ্ছে। বঙ্গবন্ধু তাঁর বিবৃতিতে আরও বলেন, ক্ষমতাসীন চক্র প্রতিহিংসাপরায়ণ মনেবৃত্তি নিয়ে বাংলাদেশের জনগণের বিরুদ্ধে গভীর চক্রান্তে লিপ্ত। সমরসজ্জা অব্যাহত রেখে বাংলার বুকে এক জরুরী অবস্থা কায়েম রাখার প্রয়াসী। করাচীতে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলোচনাকালে ন্যাপ প্রধান ওয়ালী খান বলেন, তিনি বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে মতবিনিময়ের জন্য ১৩ মার্চ ঢাকায় আসবেন। তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ক্ষমতা যাতে হস্তান্তর করা যায় সেজন্য আগে আমাদের শাসনতন্ত্র প্রণয়নের চেষ্টা করতে হবে। অগ্নিগর্ভ বিক্ষুব্ধ বাংলায় বিদ্রোহ-বিক্ষোভের তরঙ্গ প্রবাহমান ছিল টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া পর্যন্ত। নারায়ণগঞ্জের কারাগার থেকে এদিন ৪০ জন কয়েদী পালিয়ে যায়। পালানোর সময় সংঘর্ষে ১ জন নিহত ও ২৫ জন আহত হয়। সেনাবাহিনী যাতে বাজার থেকে কোন দ্রব্য ক্রয় করতে না পারে তার জন্য সর্বত্রই জনগণ সচেতন প্রহরা দেয়। ঢাকা, যশোর, খুলনা ও আরও অনেক জায়গায় সেনাবাহিনীকে বাধা দেয়া হয়। ফলে সেনাবাহিনীর চলাচল নির্বিঘœ করতে সামরিক কর্তৃপক্ষ ১১৪ নম্বর সামরিক আদেশ জারি করে। যাতে বলা হয় সেনাবাহিনীর কর্মকান্ডে বাধা সৃষ্টি করা তাদের ওপর হামলা বলে গণ্য হবে। তবে জনগণ এই আদেশ গ্রাহ্য করেনি। তাই অনেকস্থানে সেনাবাহিনীর সঙ্গে জনতার অনিবার্য সংঘর্ষ হয়। এই সময়ে সেনাবাহিনীর জন্য পশ্চিম পাকিস্তান থেকে অপরিহার্য খাদ্যবস্তু আনতে হয়। দেশজুড়ে বঙ্গবন্ধুর ডাকা অসহযোগ আন্দোলন চলছে। কোর্ট-কাচারি, অফিস-আদালত ছিল বন্ধ। সারাদেশে অসহযোগ আন্দোলনের পাশাপাশি চলছে চূড়ান্ত লড়াইয়ের প্রস্তুতি। বাংলাদেশের অসহযোগ আন্দোলনের প্রভাব পড়ে পশ্চিম পাকিস্তানেও। আন্দোলনের তীব্রতা বুঝতে পেরে পশ্চিম পাকিস্তানের পত্রিকাগুলো তাদের সুর পাল্টে ফেলে। তারা বাংলাদেশের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের বিষয়ে পাকিস্তানের সামরিক সরকারকে চাপ দিয়ে নিবন্ধ প্রকাশ করে। ইংরেজী দৈনিক ‘দি পিপলস’ পত্রিকায় সেদিন ভুট্টোর কার্যকলাপের সমালোচনা করা হয়েছিল। সেখানে অতিসত্বর জনপ্রতিনিধিদের কাছে শাসনভার বুঝিয়ে দেয়ার অনুরোধ জানানো হয়। দেশমায়ের এই সঙ্কটময় সময়ে লেখক-শিল্পী-সংস্কৃতিকর্মীরা সক্রিয়ভাবে সম্পৃক্ত ছিলেন স্বাধীনতা অর্জনের লড়াইয়ে। কবি-কথাশিল্পী হাসান হাফিজুর রহমানের নেতৃত্বে ঢাকায় কবি- সাহিত্যিকরা গঠন করেছিলেন ‘লেখক সংগ্রাম শিবির।’ অগ্নিঝরা মার্চের প্রথম থেকেই বেতার, টেলিভিশন, চলচ্চিত্র সব মাধ্যমের শিল্পীই অসহযোগ আন্দোলনে অংশ নিয়ে মিটিং, মিছিল, গণসঙ্গীতের অনুষ্ঠান করে আসছিলেন। বিভিন্ন শিল্পী সংস্থা থেকে প্রতিনিধি নিয়ে গঠন করা হয়েছিল ‘বিক্ষুব্ধ শিল্পী সংগ্রাম পরিষদ।’এসবের পাশাপাশি পূর্ব পাকিস্তানের দামাল ছেলেরা সংঘবদ্ধ হচ্ছিল কঠিন সময় মোকাবেলা করতে। ঘরে ঘরে তখন একই সুর ‘তোমাদের ঘরে যা কিছু আছে তাই নিয়ে প্রস্তুত থাকো, রক্ত যখন দিয়েছি, আরও রক্ত দেবো’ এ স্পন্দন বাঙালী ছেলেদের মনেপ্রাণে উদ্দামতা এনে দেয়। বঙ্গবন্ধুর আহ্বান তাদের নতুন পথের দিশারী। জহুর আহমেদ চৌধুরী, এম.আর.সিদ্দিকী, এম.এ.হান্নান, এম.এ.মান্নান, সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, মৌলভী সৈয়দ আহমেদ, এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী প্রমুখের নেতৃত্বে চট্টগ্রাম সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। কেন্দ্রীয় কমিটি থেকে আসা যেকোন সিদ্ধান্ত চট্টগ্রামে বাস্তবায়নে বদ্ধপরিকর চট্টগ্রাম সংগ্রাম পরিষদ। স্বাধীনতার চূড়ান্ত সংগ্রামের জন্য সর্বাত্মক প্রস্তুতি নিতে থাকে চট্টগ্রামবাসী। অধ্যাপক মমতাজ উদ্দিন লিখিত ‘এবারের সংগ্রাম’ নাটকের মহড়া দেয় ‘চট্টগ্রাম শিল্প-সাহিত্য পরিষদ’-এর শিল্পীরা।