বিশ্ব বিস্ময়ে দেখবে বাংলাদেশকে – প্রধানমন্ত্রী

128
চট্টগ্রামের পতেঙ্গায় কনস্ট্রাকসন ইয়ার্ড টানেলে প্রকল্প এলাকায় চট্টগ্রাম শহরের লালখানবাজার থেকে শাহ আমানত বিমানবন্দর পর্যন্ত এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের পিলার পাইলিং প্রকল্পের নির্মাণ কাজ উদ্বোধন করে মোনাজাত করছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

কাজিরবাজার ডেস্ক :
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনের মধ্য দিয়ে রবিবার শুরু হলো কর্ণফুলীর তলদেশে দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম সুড়ঙ্গপথ ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল’-এর বোরিং কার্যক্রম। এই টানেলের মাধ্যমে নদীর দক্ষিণপাড় যুক্ত হবে মহানগরীর সঙ্গে। চট্টগ্রাম পরিণত হবে চীনের সাংহাইয়ের আদলে ওয়ান সিটি টু টাউনে। সকালে তিনি পতেঙ্গা প্রান্তের কনস্ট্রাকশন ইয়ার্ডে সুইচ টিপে এই কার্যক্রম উদ্বোধন করেন। সেখানেই স্থাপিত আরেকটি মঞ্চে ফলক উন্মোচন করেন চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (চউক) আরেক মেগা প্রকল্পের নির্মাণ কাজ। যার নাম এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে। যেটি চট্টগ্রামের প্রথম এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে। এই দুই প্রকল্পে ব্যয় ধরা হয়েছে ১৩ হাজার ১৩০ কোটি টাকা।
এ দুই মেগা প্রকল্পের উদ্বোধনের পর পতেঙ্গা রিং রোডে আয়োজিত এক সুধী সমাবেশে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁর সরকারের উন্নয়নমূলক কর্মকা-ের নানা চিত্র তুলে ধরে বলেন, বাংলাদেশ ধাপে ধাপে উন্নয়নের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। সারাবিশ্ব বিস্ময়ে তাকিয়ে দেখবে বাংলাদেশকে। প্রধানমন্ত্রী পদে পদে নানা বাধা বিপত্তি ও প্রতিকূলতা অতিক্রম করে পদ্মা সেতুসহ সরকারের বড় বড় প্রকল্প বাস্তবায়নের কথা তুলে ধরেন প্রধানমন্ত্রী। জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের সেই ঐতিহাসিক ভাষণের একটি লাইন উদ্ধৃত করে এর অনুকরণে বলেন, ‘আমাদের কেউ দাবায়ে রাখতে পারবে না।’ রক্তের বিনিময়ে পেয়েছি আমাদের স্বাধীনতা। এই স্বাধীনতা যেন ব্যর্থ না হয়। দেশ এগিয়ে যাচ্ছে, এগিয়ে যাবে। আমাদের কেউ দাবায়ে রাখতে পারেনি, পারবে না। ভবিষ্যত পরিকল্পনার কথা জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, ২০৪১ সালে বাংলাদেশ হবে দক্ষিণ এশিয়ার একটি উন্নত সমৃদ্ধ দেশ। সে লক্ষ্য নিয়েই কাজ করছি। ২০২০ সালে আমরা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী পালন করা হবে। ২০২০ ও ২০২১ সালকে আমরা মুজিববর্ষ হিসেবে ঘোষণা দিয়েছি। চট্টগ্রামেও মুজিববর্ষ উদযাপনে স্থানীয়ভাবে উদ্যোগ নেয়া হবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন। বক্তব্যে তিনি শতবর্ষের বদ্বীপ পরিকল্পনা এবং ২০৭১ সালে স্বাধীনতার শতবর্ষ উদযাপনের বিষয় তুলে ধরে বলেন, ততদিন আমি বেঁচে থাকব না। কিন্তু ভবিষ্যত প্রজন্ম একটি উন্নত দেশে স্বাধীনতার শতবর্ষ পালন করবে।
সুধী সমাবেশে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, যে আদর্শ নিয়ে এদেশ স্বাধীন করে গেছেন জাতির পিতা, তা তিনি শেষ করে যেতে পারেননি। আমরা তাঁর অসমাপ্ত কাজ শেষ করব। সেই প্রচেষ্টাই চালিয়ে যাচ্ছি। আমার প্রাণের বিনিময়ও যদি করতে পারি তাহলে বাবা শান্তি পাবেন। এটাই আমার চাওয়া। আমার আর কোন চাওয়া পাওয়া নেই। সব হারিয়ে রিক্ত ও নিঃস্ব আমি।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশ আজ উন্নয়নের রোড মডেল। দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম টানেল হতে যাচ্ছে বাংলাদেশে। ২০১০ সালে টানেল নির্মাণের ঘোষণা দিয়েছিলাম। ২০১৪ সালে চীন সফরে যাই। চীনের প্রধানমন্ত্রী আমাদের সম্মানে রাতের খাবারের আয়োজন করেন। সেখানেই কর্ণফুলীর তলদেশে একটি টানেল নির্মাণের ইচ্ছার কথা বলতেই তিনি রাজি হয়ে যান। ওই রাতেই দুদেশের মধ্যে এমওইউ (সমঝোতা স্মারক) সই হয়। সাধারণত চীন কোন প্রকল্প ব্যয়ের ৮৫ শতাংশের বেশি ঋণ দেয় না। কিন্তু আমাদের আগ্রহ দেখে চীন কর্ণফুলী টানেলের ব্যাপারে শতভাগ ঋণ সহায়তা দিয়েছে। ২০১৬ সালের ১৪ অক্টোবর চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং নিজে টানেলের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছেন। আগামী ২০২২ সালের মধ্যে এই টানেল নির্মাণের কাজ শেষ হবে। বক্তব্যে তিনি চীনের প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রীর প্রতি বিশেষভাবে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন।
কর্ণফুলী তলদেশে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল নির্মাণের ফলে চট্টগ্রামে যোগাযোগ ব্যবস্থার আমূল উন্নতির কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, চার লেনের এই টানেলের মাধ্যমে নগরীর সঙ্গে যুক্ত হবে আনোয়ারা উপজেলা। আনোয়ারা থেকে ১০ কিলোমিটার একটি সড়ক কক্সবাজার ফোর লেন সড়কের সঙ্গে যুক্ত করলে এ টানেল দিয়ে যানবাহন কক্সবাজার পর্যন্ত চলাচল করতে পারবে। তিনি বলেন, চট্টগ্রামের লালখান বাজার হতে বিমানবন্দর পর্যন্ত এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মিত হচ্ছে। এ প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে নগরীতে যানজট হবে না।
দেশের উন্নয়নে সরকারের গৃহীত প্রকল্প ও পরিকল্পনা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা প্রত্যেক এলাকায় বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল করে দিচ্ছি। চট্টগ্রামেও হচ্ছে। বিনিয়োগের জন্য বিভিন্ন দেশ আমাদের কাছে জায়গা বরাদ্দ চাচ্ছে। বিদেশী বিনিয়োগের মাধ্যমে দেশে কর্মসংস্থান বৃদ্ধি পাবে বলে উল্লেখ করেন তিনি।
পদ্মা সেতু নির্মাণের চ্যালেঞ্জ প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ২০০১ সালে আমরা পদ্মা সেতুর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করি। কিন্তু পরে বিএনপি সরকার ক্ষমতায় এসে সে কাজ বন্ধ করে দেয়। তারা বলে এ সেতুর এলাইনমেন্ট ঠিক নেই। অন্য স্থানে পদ্মা সেতু করা হবে। এরপর পদ্মা সেতু নিয়ে দুর্নীতির অভিযোগ আনে বিশ্বব্যাংক। যেখানে কোন টাকাই ব্যয় হয়নি সেখানে দুর্নীতি হয় কিভাবে? আমি চ্যালেঞ্জ দিয়ে বলেছিলাম দুর্নীতির প্রমাণ থাকলে দেখান। কানাডার আদালতে মামলা হল। কিন্তু সেখানে বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতুতে দুর্নীতির কোন প্রমাণ দেখাতে পারেনি। প্রধানমন্ত্রী বলেন, দেশের দুটি পত্রিকার এডিটর ও মালিক এবং চট্টগ্রামের একজন সুদখোর ব্যবসায়ী ও নোবেল বিজয়ী মিলে বিশ্বব্যাংকের কাছে কিছু মিথ্যা অপপ্রচার তুলে ধরেছে। দুর্ভাগ্য যে, এ জন্য পদ্মা সেতুর কাজ দুই বছর পিছিয়েছে।
পর্যটন খাতে সরকারের গৃহীত নানা পদক্ষেপের উল্লেখ করে তিনি বলেন, কক্সবাজার যেন পরিকল্পিতভাবে গড়ে ওঠে সেজন্য কাজ করছি। চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত মেরিন ড্রাইভ হচ্ছে। এ টানেল নির্মিত হলে যোগাযোগের সমস্যা আর থাকবে না। পটিয়া বাইপাসের সঙ্গে সড়ক সংযুক্ত করে দিলে আপনারা কক্সবাজার পর্যন্ত চলে যেতে পারবেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, চট্টগ্রাম শুধু বাণিজ্যিক নগরী নয়, প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি। এই টানেল হলে চট্টগ্রামসহ উপকূল ঘিরে হবে মহাপরিকল্পনা। টানেলের ক্ষেত্রে দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম দেশ হবে বাংলাদেশ। তিনি ঢাকার বাইরে গ্রামীণ জনপদের উন্নয়নে সরকারের পদক্ষেপ উল্লেখ করে বলেন, গ্রামের মানুষ যেন শহরের সুবিধা পায় সে লক্ষ্যে আমরা কাজ করে যাচ্ছি। কাজ করতে চাই দেশের জন্য, উন্নয়নের জন্য।
উদ্বোধনের পর রিং রোডের এই সুধী সমাবেশে আরও বক্তব্য রাখেন সড়ক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, ঢাকায় নিযুক্ত চীনের রাষ্ট্রদূত ঝাং জুও এবং সেতু বিভাগের সিনিয়র সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম। উপস্থিত ছিলেন মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক, তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ, গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রী স.ম. রেজাউল করিম, ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদ, নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী, শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল, চট্টগ্রাম সিটি মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দিন, সাবেক মন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন, স্থানীয় সংসদ সদস্য এমএ লতিফ, চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান আবদুচ ছালাম এবং চট্টগ্রামের সংসদ সদস্য এবং প্রশাসন ও সংশ্লিষ্ট বিভাগের দায়িত্বশীল উর্ধতন কর্মকর্তাগণ।
সড়ক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের তার বক্তব্যে চট্টগ্রামকে ঘিরে সরকারের নানা উন্নয়ন পরিকল্পনার পাশাপাশি দেশের উন্নয়নে বর্তমান সরকারের গৃহীত পদক্ষেপ ও বাস্তবায়নাধীন প্রকল্পগুলো তুলে ধরেন। তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁর কর্মের মধ্য দিয়ে নিজকে নিজে অতিক্রম করে গেছেন। গত ৪৩ বছরে সবচেয়ে সৎ, সাহসী ও দক্ষ নেতার নাম শেখ হাসিনা। কর্ণফুলী টানেল নির্মিত হলে নদীর দুপারে দুটি শহর হবে। চট্টগ্রাম-কক্সবাজার ফোরলেন সড়ক বিষয়ে তিনি বলেন, এ সড়ক হবে পিপিপি (পাবলিক-প্রাইভেট) ভিত্তিতে। চট্টগ্রাম নগরীতে মেট্রোরেল করার চিন্তা ভাবনার কথাও তিনি উল্লেখ করেন।