আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো

79

কাজিরবাজার ডেস্ক :
কবি আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ ‘কোন এক মাকে’ কবিতায় লিখেছেন, ‘কুমড়ো ফুলে ফুলে/নুয়ে পড়েছে লতাটা/ সজনে ডাঁটায়/আর, আমি ডালের বড়ি/শুকিয়ে রেখেছি/খোকা, তুই কবে আসবি/কবে ছুটি?’ চিঠিটা তার পকেটে ছিল/ ছেঁড়া আর রক্তে ভেজা।’ একুশের আবেগ বাংলার মানুষের ঘরে ঘরে পৌঁছে দিতে দেশের বুদ্ধিজীবী শিল্পী সাহিত্যিকরা ছিলেন দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। ভাষা অন্দোলনের পটভূমি, ঘটনাপঞ্জি ও বাঙালীর চেতনা নিয়ে রচিত হয়েছে বিভিন্ন প্রকার দেশাত্মবোধক গান, নাটক, গল্প, কবিতা, উপন্যাস ও চলচ্চিত্র। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী রচিত ও আলতাফ মাহমুদ সুরারোপিত আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো গানটি।
১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের পর থেকেই বাংলা সাহিত্যের বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে ভাষা আন্দোলনের প্রভাব সূচিত হয়ে আসছে। রচনাগুলোর মধ্যে শহীদ বুদ্ধিজীবী মুনীর চৌধুরী রচিত নাটক কবর, কবি শামসুর রাহমানের কবিতা বর্ণমালা, আমার দুঃখিনী বর্ণমালা এবং ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯, জহির রায়হানের উপন্যাস একুশে ফেব্রুয়ারি, কথাসাহিত্যিক শওকত ওসমানের আর্তনাদ উল্লেখযোগ্য। এছাড়া ভাষা আন্দোলনকে উপজীব্য করে নির্মিত হয়েছে জহির রায়হান পরিচালিত চলচ্চিত্র জীবন থেকে নেয়া।
তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের অনেক বাঙালি মনে করেন, বাংলাভাষা আন্দোলন হয়েছিল জাতিগত জাতীয়তাবাদের ওপর ভিত্তি করে। এ আন্দোলনের মাধ্যমে পাকিস্তানের দুই অংশের সংস্কৃতির পার্থক্যগুলো সুস্পষ্টভাবে পরিলক্ষিত হয়েছে। পশ্চিম পাকিস্তানে এ আন্দোলনটি পাকিস্তানী জাতীয় স্বার্থের বিরুদ্ধে বিভাগীয় উত্থান বলে মনে করা হয়। দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত পাকিস্তান রাষ্ট্রে ‘একমাত্র উর্দু’ নীতি প্রত্যাখ্যান করাকে মুসলমানদের পারসিক-আরবী সংস্কৃতি এবং পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠার মূল মতাদর্শের গুরুতর লঙ্ঘন হিসেবে দেখা হয়। পূর্ব পাকিস্তানের কয়েক শক্তিশালী রাজনীতিবিদ মনে করেন, ‘উর্দু’ হলো ভারতীয় ইসলামী সংস্কৃতির অংশ, আর বাংলাকে তারা হিন্দু সংস্কৃতির সংমিশ্রণে তৈরি বাংলা সংস্কৃতি হিসেবে বিবেচনা করতেন। অধিকাংশই যারা ‘একমাত্র উর্দু’ নীতির পক্ষে ছিলেন। তারা মনে করতেন যে, উর্দু কেবল পাকিস্তান দেশের ভাষা হিসেবেই নয়, বরং গোটা জাতির ভাষা হিসেবে উর্দুকে প্রতিষ্ঠা করা প্রয়োজন। এ ধরনের চিন্তা-ভাবনাও উর্দু নীতির বিপক্ষে অবস্থান নেয়ার অন্যতম কারণ হিসেবে বিবেচিত হয়েছিল। কেননা, পাকিস্তানে তখন আরও কিছু ভাষাগত পার্থক্যের সম্প্রদায় ছিল।
রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের প্রতিনিধিদলের সঙ্গে ২৪ মার্চ সন্ধ্যায় সাক্ষাত দেন। ওই সাক্ষাতকার হয় চীফ সেক্রেটারি আজিজ আহমদের বাসভবনে। সেদিন সংগ্রাম পরিষদের সদস্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন শামসুল হক, কমরুদ্দীন আহমদ, আবুল কাসেম, তাজউদ্দীন আহমদ, লিলি খান, মহম্মদ তোয়াহা, আজিজ আহমদ, অলি আহাদ, নঈমুদ্দীন আহমদ, শামসুল আলম ও সৈয়দ নজরুল ইসলাম। আলোচনার শুরুতেই জিন্নাহ রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের সদস্যদের বলেন, নাজিমুদ্দীনের সঙ্গে তাদের যে চুক্তি হয়েছে সেটা তিনি স্বীকার করেন না, কারণ নাজিমুদ্দীনের থেকে জোরপূর্বক সেই চুক্তিতে সই আদায় করা হয়েছে। এর প্রমাণ হিসেবে তিনি বলেন, আট দফা চুক্তির মধ্যে প্রত্যেকটি দফাতেই নাজিমুদ্দীনকে কি বলতে হবে তাই বলা হয়েছে কিন্তু অন্য পক্ষের কর্তব্য সম্পর্কে কোন উল্লেখ নেই। চুক্তি কখনও এক তরফা হয় না, সর্বোতভাবে তা একটা দ্বিপাক্ষিক বিষয়। কিন্তু আট দফা চুক্তি স্পষ্ট প্রমাণ করে যে, তা এক পক্ষের সুবিধার জন্য করা হয়েছে এবং চুক্তিতে স্বাক্ষর জোরপূর্বকই আদায় করা হয়েছে। এবং সেই অনুসারে চুক্তিটি সম্পূর্ণভাবে অবৈধ এবং অগ্রাহ্য। জিন্নাহর এমন বক্তব্যের পর সংগ্রাম পরিষদের নেতৃবৃন্দের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। ভাষার প্রশ্নে জিন্নাহর সঙ্গে তাদের তর্কবিতর্ক হয়। পরে রীতিমতো ঝগড়ায় রূপ নেয়। প্রথমেই মহম্মদ তোয়াহা তাকে সরাসরি বলেন যে তারা রাষ্ট্রভাষা বাংলা চান। এর উত্তরে জিন্নাহ বলেন, তিনি তাদের কাছে রাজনীতি শিক্ষা নিতে আসেননি।