কানাইঘাটে শিশু ধর্ষণ ও হত্যার দায়ে ৪ জনের মৃত্যুদন্ড

53

সিন্টু রঞ্জন চন্দ :
কানাইঘাটে ইসলামী শিক্ষার্থী সুলতানা বেগম (১২) গণধর্ষণ করে হত্যা করে লাশ গুম করার দায়েরকৃত মামলায় ৪ লম্পটকে ফাঁসি (মৃত্যুদন্ড) ও ১ লক্ষ টাকা জরিমানা করেছেন আদালত। পাশাপাশি অপর দু’টি ধারায় তাদের প্রত্যেককে ৭ বছরের সশ্রম কারাদন্ড ১০ হাজার টাকা করে জরিমানা অনাদায়ে আরো ১ বছরের বিনাশ্রমে কারাদন্ড দেয়া হয়। গতকাল রবিবার সিলেটের অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ প্রথম ও শিশু আদালতের বিচারক এ. এম. জুলফিকার হায়াত চাঞ্চল্যকর এ রায় ঘোষণা করেন।
ফাঁসির দন্ডপ্রাপ্ত আসামীরা হচ্ছে- কানাইঘাট উপজেলার লক্ষী প্রসাদ র্প্বূ ইউনিয়নের বড়খেওর গ্রামের ইমাম উদ্দিনের পুত্র আবুল উদ্দিন (২৩), একই এলাকার মৃত লিয়াকত আলীর পুত্র রাসেল আহমদ (২০), সুরুজ আলীর পুত্র সাদেক উদ্দিন (২৮) এবং ভারত হতে আগত (ভাসমান) নিমার আলী উরফে মিজান আলীর পুত্র বর্তমানে স্ত্রী রাহেনা বেগমের কানাইঘাট থানার এরালিগুল গ্রামের বাসিন্দা বাবুল আহমদ উরফে রুহুল (৩২)। রায় ঘোষণার পর পুলিশ ফাঁসির দন্ডপ্রাপ্ত আবুল উদ্দিন, রাসেল আহমদ ও সাদেক উদ্দিনকে সিলেট কেন্দ্রীয় কারাগারে প্রেরণ করা হলেও অপর ফাঁসির সাজাপ্রাপ্ত আসামী বাবুল আহমদ উরফে রুহুল বর্তমানে পলাতক রয়েছেন।
মামলা সূত্রে জানা যায়, কানাইঘাট থানার এরালিগুল গ্রামের তেরা মিয়া মেয়ে সুলতানা বেগমের সাথে আসামী আবুল উদ্দিনের বোন ফারহানা বেগমের (১৩) বান্ধবী থাকায় তারা একই মক্তবে ইসলামী শিক্ষা গ্রহণ করে আসছিল। ২০১৬ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর ভোর বেলা স্থানীয় এরালিগুল পাঁচঘরি জামে মসজিদে ইসলামী শিক্ষা গ্রহণের জন্য সুলতানা বেগম মসজিদে যায়। ইসলামী শিক্ষা গ্রহণ শেষে সে ওইদিন বাড়িতে না আসায় তার পরিবারের লোকজন তাকে খোঁজাখুজি করতে থাকেন। খোঁজাখুজি করা কালে তারা জানতে পারেন কোরআন শিক্ষা শেষে তার বান্ধবী ফারহানার সাথে তার বাড়িতে গেছে। তখন তার আত্মীয় স্বজন আবুল উদ্দিনের বাড়িতে গিয়ে সুলতানা বেগমের বিষয়ে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করলে সে একেক সময় একেক কথা বলে। এক পর্যায়ে তারা তাকে খোঁজাখুজি করে না পেয়ে ২০১৬ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর কানাইঘাট থানা পুলিশকে বিষয়টি জানান।
পরে থানা পুলিশ সুলতানা বেগমের বান্ধবী ফারানাকে জিজ্ঞাসাবাদ করে এবং পুলিশ জানতে পারে ২৫ সেপ্টেম্বর সকাল ৯ টার দিকে ইসলামী শিক্ষা শেষে তারা ২ বান্ধবী একত্রে ফারহানার বাড়িতে যায়। ঐ সময় আবুল উদ্দিন তার বাড়ীস্থ দক্ষিণ দিকে টিলার উপরে অন্যান্য আসামীগণকে নিয়া গাছ বাগান পরিচর্যা করছিল। তখন আবুল উদ্দিন তার বোন ফারহানাকে পান-সুপারী ও পানি নিয়ে টিলার উপরে যাওয়ার জন্য ডাকাডাকি করলে ফারহানা বেগম না গিয়ে সুলতানা বেগমকে পান-সুপারী ও পানির জগ দিয়ে টিলার উপরে পাঠায়। এরপর টিলার উপর হতে সুলতানা আর ফিরে আসেনি। পরে ফারহানা বেগমের স্বীকারোক্তি মতে থানা পুলিশ আবুল উদ্দিনকে আটক করে। এক পর্যায়ে সে পুলিশের কাছে স্বীকার করে যে, সে ও অন্যান্যরা মিলে সুলতানা বেগমকে পালাক্রমে ধর্ষণ করে হত্যা করে। এরপর লাশ টিলার পূর্ব পাশের মাটিতে পুতে রাখে।
আটককৃত আবুল উদ্দিনের স্বীকারোক্তি মতে থানা পুলিশ তাৎক্ষণিকভাবে ঐদিন বিকেল সাড়ে ৪ টার দিকে সুলতানার মৃতদেহ গর্ত হতে পচনশীল অবস্থায় উদ্ধার করে এবং এ ঘটনায় জড়িত থাকায় অপর আসামী রাসেল আহমদ ও সাদেক উদ্দিন গংকে গ্রেফতার করতে সক্ষম হয়। পরে পুলিশ লাশের সুরতহাল রিপোর্ট তৈরী করে লাশ ময়না তদন্তের জন্য সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে প্রেরণ করে। একই বছরের ২৫ সেপ্টেম্বর গ্রেফতারকৃত আসামী আবুল উদ্দিন সিলেটের জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে এ হত্যার দায় স্বীকার করে ফৌজদারী কার্য্যবিধি আইনের ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী প্রদান করেন। এ ঘটনায় নিহত শিশু সুলতানা বেগমের ভাই একলিম উদ্দিন বাদি হয়ে আবুল উদ্দিনকে প্রধান আসামী করে ৪ জনের বিরুদ্ধে গণধর্ষণ পূর্বক হত্যা ও লাশ গুমের অপরাধে এনে কানাইঘাট থানায় একটি মামলা দায়ের করেন। যার নং- ২৪ (২৯-০৯-২০১৬)। শিশু মামলার নং-২০/২০১৭।
দীর্ঘ তদন্ত শেষে ২০১৬ সালের ২৯ ডিসেম্বর কানাইঘাট থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মো: হুমায়ুন কবির ৪ আসামীকে অভিযুক্ত করে আদালতে চার্জশিট (অভিযোগপত্র) দাখিল করেন এবং চলতি বছরের ২৬ এপ্রিল থেকে আদালত এ মামলার বিচারকার্য্য শুরু করেন।
দীর্ঘ শুনানী ও ১৮ জন সাক্ষীর মধ্যে ১২ জনের সাক্ষ্যগ্রহণ শেষে আদালত আসামী আবুল উদ্দিন, রাসেল আহমদ, সাদেক উদ্দিন ও বাবুল আহমদ উরফে রুহুলকে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ৯ (৩) ধারায় দোষী সাব্যস্ত করে প্রত্যেককে মৃত্যুদন্ড (ফাঁসি) ও ১ লক্ষ টাকা করে জরিমানা করা হয়। এছাড়া ভিকটিম সুলতানা বেগমের মৃতদেহ মাটি চাপা দিয়ে প্রমান লোপাটের অপরাধে প্রত্যেক আসামীকে পেনাল কোড এর ২০১ ধারা ও তৎসহ পঠিত পেনাল কোড ৩৪ ধারায় দোষী সাব্যস্ত করে প্রত্যেককে ৭ বছরের সশ্রম কারাদন্ড ও ১০ হাজার টাকা করে জরিমানা অনাদায়ে আরো ১ বছরের বিনাশ্রমে কারাদন্ডে দন্ডিত করা হয়েছে। এদিকে দন্ডিত আসামীগণ গতকাল রবিবার হতে ৭ দিনের মধ্যে তামাদি আইন এর আর্টিক্যাল ১৫০ অনুসারে উচ্চ আদালতে আপীল দায়ের করতে পারবেন।
রাষ্ট্রপক্ষে এপিপি এডভোকেট মো: নিজাম উদ্দিন ও এপিপি এডভোকেট মো: ফখরুল ইসলাম এবং আসামীপক্ষে স্ট্রেট ডিফেন্স এডভোকেট এম.এম হাসান সজল ও এডভোকেট মো: আজম খান মামলাটি পরিচালনা করেন।
আদালতের এপিপি এডভোকেট ফখরুল ইসলাম জানান, উক্ত ঘটনায় সুলতানার ভাই একলিম উদ্দিন বাদী হয়ে ৪ আসামির বিরুদ্ধে ধর্ষণ, হত্যা ও লাশ গুমের অভিযোগে মামলা করেন। তদন্ত শেষে ৪ জনকেই অভিযুক্ত করে আদালতে অভিযোগপত্র দেয় পুলিশ। দীর্ঘ শুনানি শেষে সাক্ষ্য প্রমাণের ভিত্তিতে আদালত ওই ৪ আসামিকে মৃত্যুদন্ডদেশ (ফাঁসি) দিয়েছেন আদালত। আসামীরা ইচ্ছা করলে আগামী ৭ দিনের মধ্যে উচ্চ আদালতে আপীল দায়ের করতে পারবেন বলে জানান তিনি।