পিতা-মাতার নৈতিক ও আইনী অধিকার

68

॥ মুহাম্মদ মনজুর হোসেন খান ॥

বাংলাদেশের বর্তমান সামাজিক প্রেক্ষাপটে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক পিতা-মাতার ভরণ-পোষণ আইন, ২০১৩ প্রণয়ন করা হয়েছে। প্রত্যেক মানুষের জীবনে পিতা-মাতার গুরুত্ব অপরিসীম। সন্তানের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ রচনায় পিতাÑমাতা তিলে তিলে নিজের জীবন ও সামর্থ্যকে ক্ষয় করে এক সময় বার্ধক্যে উপনীত হন, কর্মক্ষম হাত পাগুলো নিশ্চল হয়ে পড়ে নির্ভরশীল হয়ে পড়েন সন্তানের উপর। তাই সন্তান যখন সামর্থ্যবান হবে, তখন পিতাÑমাতার সার্বিক ভরণ-পোষণ তাদের দায়িত্ব ও আবশ্যকীয় কর্তব্য। আইনটি এ বিষয়ে বাংলাদেশের সর্বপ্রথম আইন। বাংলাদেশের অধিকাংশ লোক মুসলিম। ইসলামে ও পিতা-মাতার সার্বিক সেবাযতেœর প্রতি গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। আলোচ্য প্রবন্ধে কুরআন ও সুন্নাহর আলোকে বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক প্রণীত আইনটির পর্যালোচনা ও প্রয়োজনীয় সুপারিশ উপস্থাপন করা হবে। প্রবন্ধটি প্রণয়নে বিশ্লেষণ, পর্যালোচনা ও সমালোচনামূলক গবেষণা পদ্ধতি অবলম্বন করা হয়েছে। এ মাধ্যমে অত্র আইনের অনুষঙ্গের ইসলামী দৃষ্টিকোণ অবগত হওয়ার পাশাপাশি এ বিষয়ক ইসলামী আইনের সাথে তুলনা করা সম্ভব হবে।
মানুষ সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীব। আল্লাহ তা‘আলা মানুষকে তাঁর খলীফা হিসেবে পৃথিবীতে প্রেরণ করেছেন এবং তার জীবন পরিচালনার জন্য পথ দেখিয়েছেন। এজন্য যুগে যুগে অসংখ্য নবী ও রাসূল প্রেরণ করেছেন এবং তাদের মাধ্যমে মানব জতিকে সঠিক পথ প্রদর্শন করেছেন। মানুষের পৃথিবীতে আগমনের মাধ্যম হলো তার পিতা-মাতা। পৃথিবীতে একজন মানব সন্তান আগমনের পূর্বে ও পরে পিতা-মাতা তার জন্য অনেক কষ্ট স্বীকার করেন এবং অক্লান্ত পরিশ্রমের মাধ্যমে তাদের লালন পালন করেন। পিতা-মাতার মাধ্যমেই পৃথিবীতে মানুষের বিস্তার ও বংশ পরিক্রমা নির্ধারিত হয়। পৃথিবীতে আলোর মুখ দেখার সৌভাগ্য মানুষ পিতা-মাতার মাধ্যমেই পেয়ে থাকে। তাই মানুষের জীবনে পিতা-মাতার স্থান ও অধিকার অনেক গুরুত্বপূর্ণ।
আল্লাহ তা‘আলা পবিত্র কুরআনে তাঁর ইবাদত করার নির্দেশ দেয়ার সাথে সাথেই পিতা-মাতার প্রতি সদাচরণের নির্দেশ দিয়েছেন। কুরআনের বিভিন্ন স্থান আল্লাহর অধিকারের পাশাপাশি পিতা-মাতার অধিকারের কথা ব্যক্ত করা হয়েছে। সন্তানের নিকট থেকে শ্রদ্ধা, ভালোবাসা ও সদাচরণ পাওয়া পিতা-মাতার নৈতিক ও আইনী অধিকার। বিশেষভাবে তারা যখন বৃদ্ধাবস্থায় উপনীত হন এবং কর্মক্ষম থাকেন না, তখন তারা ভরণÑপোষণ ও সেবা-যতœ পাওয়ার জন্য সন্তানের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েন। সন্তানের কর্তব্য, তার পিতা-মাতার ভরণ-পোষণ- এর দায়িত্ব গ্রহণ করা, অসুস্থ হলে তাদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করা এবং তাঁদেরকে সঙ্গ দেয়া এবং তাদের মনে কষ্ট পাবার মতো কোন ব্যবহার না করা।
সন্তান কর্তৃক পিতা-মাতার ভরণ-পোষণ নিশ্চিতকরণের লক্ষ্যে বাংলাদেশ সরকার পিতা-মাতার ভরণ-পোষণ আইন ২০১৩ শিরোনামে একটি আইন প্রণয়ন করেছে। বাংলাদেশ জাতীয় সংসদ কর্তৃক গৃহীত আইনটি ২৭ অক্টোবর ২০১৩/১২ কার্তিক ১৪২০ তারিখ রবিবার রাষ্ট্রপতির সম্মতি লাভের পর আইন হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেছে। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক বাংলাদেশ গেজেট, অতিরিক্ত সংখ্যা হিসেবে বাংলাদেশ সরকারি মুদ্রাণালয় কর্তৃক বাংলাদেশ ফরম ও প্রকাশনা অফিস কর্র্র্তৃক প্রকাশিত হয়েছে।
‘পিতা-মাতার ভরণ-পোষণ’ আইনটি প্রণয়নের কারণ বা ব্যাখ্যা গেজেটে উল্লেখ করা হয়নি। তবে আইনে বলা হয়েছে, ‘যেহেতু সন্তান কর্তৃক পিতা-মাতার ভরণ-পোষণ নিশ্চিতকরণের লক্ষ্যে বিধান করা সমীচীণ ও প্রয়োজনীয়; সেহেতু এতদ্বারা নিম্নরূপ আইন করা হইল।’ মূলত বাংলাদেশের বর্তমান সমাজের নৈতিক অবক্ষয়, সামাজিক, পারিবারিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধের স্খলনের কারণে পারিবারিক বন্ধন ও দায়িত্ববোধে শিথিলতা লক্ষ্য করা যায়। পিতা-মাতাসহ সমাজের বৃদ্ধ ও প্রবীণ শ্রেণীর দায়িত্ব পালন ও তাঁদের প্রতি গুরুত্ব কমে যাচ্ছে। বিভিন্ন দৈনিকে প্রকাশিত সংবাদে প্রায়ই পিতা-মাতার প্রতি অসদারচণের সংবাদ পরিলক্ষিত হয়, এ দেশের নব্বই শতাংশ লোক মুসলিম হলেও পরিপূর্ণ ইসলামী শিক্ষার অনুপস্থিতিতে মুসলিম সমাজে ইসলামী অনুশাসনের যথাযথ চর্চা নেই এবং ইসলামের শিক্ষা, বিধি-বিধান ও আইন পরিপালনে শিথিলতা লক্ষণীয়। এ প্রেক্ষিতে পিতা-মাতার ভরণ-পোষণ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে আইনটি প্রণয়ন করা হয়েছে।
পিতা-মাতার ভরণ-পোষণের দায়িত্ব নিশ্চিতকরণের লক্ষ্যে আইনটি প্রণয়ন করা হয়েছে। বাংলাদেশে এ বিষয়ে প্রণীত এটিই প্রথম আইন। সাধারণ মানুষের মধ্যে পিতা-মাতার ভরণ-পোষণের প্রতি অবজ্ঞা ও অবহেলা বৃদ্ধি পাওয়ার প্রেক্ষিতে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক আইনটি প্রণয়ন করা হয়েছে। নিম্নে আইনটির পর্যালোচনা ও সীমাবদ্ধতাগুলো আলোচনা করা হলো:
“পিতা-মাতার ভরণ-পোষণ আইন, ২০১৩” শিরোনামে আইনটি ২০১৩ সনের ৪৯নং আইন, যা সংসদ কর্তৃক গৃহীত ও রাষ্ট্রপতি কর্তৃক সম্মতি লাভ করেছে। উক্ত আইনে ধারা ২(ক) তে পিতা বলতে সন্তানের জনককে বুঝানো হয়েছে।
‘ভরণ-পোষণ’ বলতে খাওয়া-দাওয়া, বস্ত্র, চিকিৎসা ও বাসস্থানের ব্যবস্থা এবং সঙ্গ প্রদানকে বুঝানো হয়েছে। ‘সন্তানের মাতা’ বলতে সন্তানের গর্ভধারিণী এবং ‘সন্তান’ বলতে পিতার ঔরসে ও মাতার গর্ভে জন্ম গ্রহণকারী সক্ষম ও সামর্থ্যবান পুত্র বা কন্যাকে বুঝানো হয়েছে। “পিতা-মাতার ভরণ-পোষণ আইন ২০১৩, বাংলাদেশ গেজেট, রেজিস্টার্ড নং ডি, এ-১ বাংলাদেশ সরকারী মুদ্রণালয় কর্তৃক মুদ্রিত ও বাংলাদেশ ফরম ও প্রকাশনা অফিস, তেজগাঁও, ঢাকা কর্তৃক প্রকাশিত। আইন নং ৪৯, ধারাÑ২”
উল্লিখিত আইনে ভরণ-পোষণ অর্থ খাওয়া-দাওয়া, বস্ত্র, চিকিৎসা ও বসবাসের সুবিধা এবং সঙ্গ প্রদানকে অন্তর্ভূক্ত করা হয়েছে। কিন্তু পিতা-মাতার প্রতি সদাচরণ, শ্রদ্ধাবোধ, কর্কশ ভাষায় কথা না বলা, কষ্ট না দেয়া, তাদের মর্যাদার প্রতি লক্ষ্য রাখা, তাদের আনুগত্য স্বীকার করা ইত্যাদি বিষয়কে অন্তুর্ভুক্ত করা হয়নি। অনেক সময় শারীরিকভাবে কষ্টের মতোই মানসিক কষ্টও পীড়াদায়ক এবং নির্যাতনের পর্যায়ে পড়ে।
আইনের ২নং ধারার (ঘ) অনুচ্ছেদে ‘সন্তান’ বলতে পিতার ঔরসে এবং মাতার গর্ভে জন্ম নেয়া সক্ষম ও সামর্থ্যবান পুত্র বা কন্যাকে বুঝানো হয়েছে। কিন্তু ‘সক্ষম’ ও ‘সামর্থ্যবান’Ñএর কোন ব্যাখ্যা দেয়া হয়নি। আমাদের সমাজে শিক্ষিত অনেক বেকার রয়েছেন, যারা যোগ্যতা অনুযায়ী কর্মসংস্থান পাচ্ছেন না। এ ছাড়া পিতা-মাতার সন্তান যদি বেকার থাকে অথবা যোগ্যতা অনুযায়ী চাকুরি না পায়, তাহলে এ আইনের আলোকে সে কীভাবে দায়িত্ব পালন করবে তার বিকল্প কোন দিকনির্দেশনা দেয়া হয়নি। ‘সক্ষম’ ও ‘সামর্থ্যবান’-এর বয়স নির্ধারিত নেই এবং সংজ্ঞাও দেয়া হয়নি।
আইনটির ২নং ধারার আলোকে বলা যায়, পিতা-মাতার ভরণ-পোষণের ক্ষেত্রে সক্ষম ও সামর্থ্যবান পুত্র বা কন্যাকে সমান ভাবে দায়িত্ব পুরুষ ও নারীর উপর সমানভাবে দায়িত্ব প্রদান করা হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশের সমাজ ব্যবস্থায় আর্থিক সংগতি ও দায় দায়িত্ব পুরুষ ও নারীর উপর সমানভাবে প্রযোজ্য হতে দেখা যায় না। আর্থিক বিষয়ে সামর্থ্য ও দায়িত্ব পুত্র বা পুরুষগণ বেশি পালন করে থাকেন। কন্যা বা নারীগণ বিবাহ-পরবর্তী জীবনে স্বামীর সংসারের দায়িত্ব পালনে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। অনেক সময় নারীদের কোন নিয়মিত আয়ের ব্যবস্থা থাকে না এবং আর্থিক সক্ষমতা সমান না হওয়া সত্ত্বেও সমান দায়িত্ব পাল কতটুকু সম্ভব তা ব্যাখ্যা সাপেক্ষ। যা উক্ত আইনে সুস্পষ্ট নয়।
‘পিতা ও মাতা’Ñএর সংজ্ঞায় ইসলামী ফিক্হ বিশ্বকোষ ‘আলÑমাওসূ‘আতুল ফিকইহয়্যাহতে বলা হয়েছে, পিতা এর অর্থ জন্মতাদা, যার বীর্য থেকে আরেকজন মানুষ জন্মগ্রহণ করে। এর আরবী প্রতিশব্দ হল ‘আব’। ‘আব’ শব্দটির কয়েকটি বহুবছন রয়েছে। এর মধ্যে সর্বাধিক বিশুদ্ধ হলো ‘আবা’। পরিভাষায়, এমন ব্যক্তিকে পিতা বলা হয়, সরাসরি যার শরীয়তসম্মত স্ত্রীর সাথে যৌন সংসর্গের ভিত্তিতে আরেক মানুষ জন্মগ্রহণ করে। যে নারী অপরের সন্তানকে দুধ পান করায়, সাধারণত তার স্বামীকেও দুধপানকারীর পিতা বলা হয়। “আব্দুল মান্নান তালিব (প্রধান সম্পা.) আল-মাওসূ‘আতুল ফিকইহয়্যাহ, ইসলামের পরিবারিক আইন(ঢাকা: বাংলাদেশ ইসলামিক ল’ রিচার্স এন্ড লিগ্যাল এইড সেন্টার, ২০১২), খ.১, পৃ.৯১”। পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে: মুহাম্মাদ তোমাদের কোন ব্যক্তির পিতা নন; বরং তিনি আল্লাহর রসূল এবং শেষ নবী। “আল-কুরআন, ৩৩:৪০”।
অভিধানে কোন কিছুর মূলকে উম্মুন বা মাতা বলা হয়। ‘উম্মুন’ অর্থ মাতা; জননী। আরবীতে শব্দটির বহুবচন ‘উম্মাহাত’ ও ‘উম্মাত’। কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রে প্রথম শব্দটি মানজাতির জন্য এবং দ্বিতীয় শব্দটি জীবজন্তুর জন্য ব্যবহৃত হয়। ফকীহগণ বলেন, যে নারীর গর্ভ থেকে মানুষ জন্মলাভ করে তিনি সেই মানুষের প্রকৃত মাতা। আর যে নারীর সন্তান কাউকে জন্ম দেয় সেই নারীও রূপকার্থে তার মাতা। পিতার মা হলে তিনি দাদী এবং মায়ের মা হলে তিনি নানী। যে মহিলা কোন শিশুকে দুধ পান করান, অথচ তাকে গর্ভে ধারণ করেননি, তিনি তার দুধমাতা। “আল-মাওসূ‘আতুল ফিকহিয়্যাহ, পৃ.৮৪” পবিত্র কুরআনে এ শব্দটির ব্যবহার পাওয়া যায়। আল্লাহ তা‘আলা বলেন: আর আমি মূসা-এর মায়ের প্রতি প্রত্যাদেশ করলাম যে, তাকে দুধ পান করাতে থাক। “অলÑকুরআন, ২৮:০৭”
আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন: তোমাদের মধ্যে যারা তাদের স্ত্রীগণকে মাতা বলে ফেলে, তাদের স্ত্রীগণ তাদের মাতা নয়। তাদের মাতা কেবল তারাই যারা তাদেরকে জন্মদান করেছেন। তারা তো অসমীচীন ও ভিত্তিহীন কথাই বলে। নিশ্চয়ই আল্লাহ মার্জনাকারী ও ক্ষমাশীল। “আল-কুরআন, ৫৮:০২”। আরবীতে জন্মদাতা ও জন্মদাত্রীকে যাথাক্রমে ওয়ালিদ ও ওয়ালিদাহ বলা হয়। অতএব পিতা-মাতার সংজ্ঞা ক্ষেত্রে এ আইন ও ফকীহগণের মতামতের মধ্যে পার্থক্য নেই।
‘ভরণ-পোষণ’ শব্দটির আরবী প্রতিশব্দ হলো নাফাকাতুন। এর অর্থ হলো খরচ, ব্যয়, জীবন নির্বাহের ব্যয়, খোরপোষ। পরিভাষায়, ‘নাফাকাহ’ বা খোরপোষ হলো অপচয় ছাড়া যার ওপর ভিত্তি করে মানুষ জীবনধারাণ করে। “আলÑমাওসূ‘আতুল ফিকহিয়্যাহ, খ.২, পৃ,১০৩”। অর্থাৎ যা জীবন ধারণের ভিত্তি। সুতরাং জীবন ধারণের মৌলিক চাহিদাসমূহ তথা খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা ইত্যাদি এর অন্তর্ভুক্ত। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তা‘আলা বলেন: তারা তোমাকে জিজ্ঞাসা করে, তারা কী ব্যয় করবে? বল, ‘তোমরা যে সম্পদ ব্যয় করবে, তা পিতা-মাতা, আত্মীয়, ইয়াতীম, মিসকীন ও মুসাফিরদের জন্য। আর যে কোন ভাল কাজ তোমরা কর, নিশ্চয় সে ব্যাপারে আল্লাহ সুপরিজ্ঞাত। “আল-কুরআন ০২:২১৫”। (অসমাপ্ত)